পুনর্গঠনে বিকৃত বগুড়ার ‘বীর বাঙালি’, সঠিক আদলে ফেরানোর দাবি

বগুড়া শহরে মুক্তিযোদ্ধার ভাস্কর্য ‘বীর বাঙালি’ পুনর্গঠন করতে গিয়ে চার বছর আগে যে ‘বিকৃত’ চেহারা দেওয়া হয়েছে, তাতে ক্ষুব্ধ নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা পুরনো আদলে ফিরিয়ে আনার দাবি জানিয়েছেন।

জিয়া শাহীনবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 Dec 2020, 03:20 AM
Updated : 15 Dec 2020, 05:17 AM

গত শতকের নব্বইয়ের দশকে সাতটি সড়কের মিলনস্থল বগুড়ার জিরো পয়েন্ট খ্যাত সাতমাথায় স্থাপন করা হয়েছিল ‘বীর বাঙালি’ নামের এই ভাস্কর্যটি। ধূসর বর্ণের ভাস্কর্যটি ছিল যুবক একজন মুক্তিযোদ্ধার প্রতিকৃতি। কাঁধে রাইফেল, খালি পা, হাতে শান্তির পায়রা ছিল।

পরে রাস্তা বড় করতে গিয়ে সেটি সরিয়ে নেওয়া হয় শহরের বনানী এলাকায়। ২০১৬ সালে ‘ট্রাকের ধাক্কায়’ ভাস্কর্যটি ভেঙে যায়। পৌর কর্তৃপক্ষ পরে সেটি পুনর্গঠন করে আবার বসালেও ভাস্কর্যের রূপ যায় পাল্টে।

নতুন ভাস্কর্যের হাতে শান্তির পায়রা হয়ে গেছে ‘হাঁস’, খালি পায়ে উঠেছে বুট, পরনের পোশাক আর কাঁধে রাইফেলের বেল্ট বদলে গেছে, চেহারাতেও বিকৃতি ঘটেছে।

বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী এবং বিজয়ের মাসে বিষয়টি নিয়ে নতুন করে আলোচনা তৈরি হয়েছে বগুড়ার সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনের কর্মীদের মাঝে। তারা চান, ‘বীর বাঙালিকে’ আগের আদলে ফিরিয়ে আনা হোক।

মূল ভাস্কর্যের নির্মাতা বগুড়ার সন্তান সুলতানুর ইসলামও আবার সেটি পুনর্নির্মাণ করতে চান।

বগুড়া শহরের সাত মাথায় গত শতকের নব্বইয়ের দশকের শুরুতে স্থাপিত মুক্তিযোদ্ধার ভাস্কর্য ‘বীর বাঙালি’ ২০০৫ সালে সরিয়ে নেওয়া হয় শহরের বনানী এলাকায়

জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শাহাদৎ আলম ঝুনু বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, অসাম্প্রদায়িক, মুক্তচিন্তা এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারকদের কাছে ‘বীর বাঙালি’ ভাস্কর্যটির পাদদেশ ছিল আন্দোলনের মিলনস্থল।

গত শতকের নব্বই দশকের শুরুতে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন, শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে গণ আদালতের আন্দোলনসহ সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী সব ছাত্র আন্দোলনের সমাবেশস্থল ছিল এই ‘বীর বাঙালি’ ভাস্কর্যের পাদদেশ। 

তিনি বলেন, ভাস্কর সুলতানুর ইসলাম ওই ভাস্কর্যটি নির্মাণ করে বিসিক শিল্প নগরীতে রেখেছিলেন। সেখান থেকে তৎকালীন মুক্তিযোদ্ধা ডেপুটি কমান্ডার প্রয়াত ইলিয়াস হোসেন সাতমাথায় নিয়ে আসেন। মুক্তিযোদ্ধা রেজাউল করিম মন্টু, আব্দুল বাকীসহ প্রগতিশীল ছাত্রনেতাদের নিয়ে নাম রাখা হয় ‘বীর বাঙালি’।

১৯৯৩ সালে গণ আদালতকে কেন্দ্র করে জামায়াতসহ বিভিন্ন মৌলবাদী সংগঠন বগুড়ায় হরতাল ডাকলে ছাত্রসমাজ প্রতিহত করার ঘোষণা দেয়। সাত মাথায় দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়।

“ওই সময় মৌলবাদীরা ভাস্কর্যের হাত কবুতরসহ ভেঙে নিয়ে যায়। পরে শহরের কামারগাড়ী থেকে উদ্ধার করে আবার হাতটি প্রতিস্থাপন করা হয়। পরে ভাস্কর্য বিষয়ে সবাইকে অবহিত করার জন্য একটি লিফলেট প্রকাশ করে শহরে বিলি করা হয়। লিফলেটের শীরোনাম ছিল ‘অপমানে তুমি জ্বলে ওঠো বার বার’।”

ঝুনু বলেন, “ভাস্কর্যটি স্বরূপে দৃশ্যমান স্থানে প্রতিস্থাপিত হোক। যেহেতু ভাস্কর সুলতান বেঁচে আছেন, তাই তাকে দিয়ে আবার তৈরি করা হোক। পাশাপাশি কেন এই বিকৃতি, কী উদ্দেশ্য ছিল, তা তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক।

স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ছাত্র ইউনিয়নের তখনকার নেতা ফিরোজ হামিদ খান রিজভী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মৌলবাদী গোষ্ঠীর উদ্দেশ্য ছিল ভাস্কর্যটি দৃষ্টির আড়াল করা; তা-ই করেছে তারা। শুধু তাই নয়, বিকৃত রূপ দিয়ে ব্যঙ্গও করেছে।”

তিনি বলেন, “ভাস্কর্ষ ভাঙচুরের দিন সাবেক মেয়র রেজাউল করিম মন্টু ভাইয়ের মাথা ফাটিয়ে দিয়েছিল মৌলবাদীরা। শুধু তাই নয়, মামলাও করেছিল, যার আসামি ছিলাম আমিসহ সাবেক জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক প্রয়াত ফেরদৌস জামান মুকুল, সাবেক মেয়র ও বর্তমান জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি রেজাউল করিম মন্টু, তৎকালীন জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি বর্তমান জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক আসাদুর রহমান দুলু, তৎকালীন জেলা ছাত্রলীগে সাধারণ সম্পাদক বর্তমান আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শাহাদাৎ আলম ঝুনু।”

বগুড়া শহর জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির শহিদুল ইসলাম নান্নু ওই মামলার বাদী ছিলেন বলে জানান ফিরোজ।

তিনি ভাস্কর্যটি আগের আদলে প্রতিস্থাপনের পাশাপাশি বিকৃতকারীদের শাস্তি দাবি করেন।

বগুড়া সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি তৌফিক হাসান ময়না বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা ভাস্কর্য সরানোর বিরোধিতা করেছিলাম; কিন্তু শোনা হয়নি। এটা নিয়ে বগুড়া পৌরসভায় আমরা আবেদনও দিয়েছিলাম। অবশ্যই ভাস্কর্যের বিকৃত রূপ পরিবর্তন করে আগের আদলে প্রতিস্থাপন করা হোক।”

গত শতকের নব্বইয়ের দশকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে সবাবেশ স্থল ছিল বগুড়া শহরের সাত মাথায় প্রথম স্থাপিত মুক্তিযোদ্ধার ভাস্কর্য ‘বীর বাঙালির’ পাদদেশ

সংশপ্তক থিয়েটারের সভাপতি সাদেকুর রহমান সুজন বলেন, “প্রতিস্থাপনের সময়ও আদল ঠিক ছিল। পরে বনানীতে ওটা ট্রাক দিয়ে ভাঙা হয়। এখন আদল পরিবর্তন করে যেন ‘পাক সেনা’ বানানো হয়েছে। জঘন্য এই কাজের জন্য ঘৃণা জানাই, এর বিচার চাই।”

বনানীতে স্থাপিত ভাস্কর্যটির কাছেই নূর আলমের চায়ের দোকান।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “পাঁচ বছর ধরে এখানে চা বিক্রি করছি। দিন তারিখ মনে নেই। রাতে চা বিক্রি করে বাড়ি গিয়েছি। পরদিন সকালে এসে দেখি ওইটা রাস্তায় পড়ে আছে ভাঙা অবস্থায়। কিছুদিন পর পৌরসভার লোকজন এসে আবার সেখানে বসিয়ে চলে গেছে। আগে যেমন ছিল পরে দেখি অন্যরকম।”

এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে বগুড়া পৌরসভার সহকারী প্রকৌশলী আবু জাফর মো. রেজা বলেন, ২০০৫ সালে রাস্তা সম্প্রসারণের সময় সড়ক ও জনপথ বিভাগ ভাস্কর্যটি নিয়ে বনানী এলাকায় তিন রাস্তায় প্রতিস্থাপন করে। তখনও মেয়র ছিলেন বর্তমান মেয়র মাহবুবুর রহমান। জেলা প্রসাশক ছিলেন রফিকুল মোহামেদ।

“২০১৬ সালে গাড়ির ধাক্কায় ভাস্কর্যটি ভেঙে গেলে পৌরসভা থেকে আট হাজার টাকা খরচ করে আবার বসানো হয়। তখন প্রকৌশলীর দায়িত্বে ছিলেন আমিনুল হক এবং মেয়র ছিলেন মাহবুবুর রহমান।”

তিনি বলেন, “শুনেছি ওটা কোনো ভাস্কর দিয়ে মেরামত করা হয়নি। মিস্ত্রি ধরনের কাউকে দিয়ে করা হয়েছিল।”

ভাস্কর্যের বিকৃতি নিয়ে প্রশ্ন করলে বগুড়ার পৌর মেয়র ও বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মাহবুবুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বিষয়টি আমার মনে নেই। যতদূর মনে পড়ে তৎকালীন জেলা প্রসাশক ওটা স্থানান্তর করেছিলেন। আমি এখন অসুস্থ।”

এরপর আর কোনো কথা না বলে ফোন কেটে দেন এই বিএনপি নেতা।

বগুড়া জেলা প্রসাশক জিয়াউল হক বলেন, “ওটা পৌরসভার অধীন। তবুও আমি যোগাযোগ করব যেন আগের আদলে ফিরিয়ে সেটি প্রতিস্থাপন করা হয়।”

‘বীর বাঙালির’ ভাস্কর সুলতানুর ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তিনি বাণিজ্যিকভাবে ওই ভাস্কর্য নির্মাণ করেননি, করেছিলেন ‘অনুভূতি ও চেতনার জায়গা’ থেকে।

“আমি বগুড়ার সন্তান; বাড়ি বগুড়ার গাবতলীর উপজেলার দুর্গাহাটায়। আমি এখনও বেঁচে আছি। কোনো মহল কিংবা সরকারি দপ্তর থেকে যদি আমাকে বলা হয়, তাহলে আগের সব অবয়ব ঠিক রেখে ভাস্কর্য তৈরি করে দিতে পারব।”