একাত্তরে আলবদর বাহিনীর উত্তরাঞ্চলের বিভাগীয় সদরদপ্তর ছিল রাজশাহীতে। শহরের রাণীবাজার মোড় এলাকার পণ্ডিত অমরেশ দাস চৌধুরীর বাড়ি ‘মোহিনী নিকেতন’ দখল করে ‘আলবদর বাহিনী’ তাদের সদর দপ্তরের কার্যালয় গড়ে তোলে। সেখান থেকে তারা মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কার্যক্রম পরিচালনা করেছিল।
যুদ্ধ শেষে আলবদর বাহিনীর পরিত্যক্ত বেশকিছু নথিপত্র ওই দপ্তরে পাওয়া যায়। রাজশাহীর যুদ্ধকালীন সাংবাদিক আহমেদ শফি উদ্দিন সেখান থেকে বেশ কিছু নথিপত্র উদ্ধার করেন, যা তিনি গবেষণার জন্য বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলামকে দিয়েছিলেন।
এছাড়া সম্প্রতি তিনি তার বাড়ির পুরাতন কাগজপত্রের মধ্যে আলবদরদের তিন পৃষ্ঠার একটি নথি পান।
অপর দুই পৃষ্ঠার চিঠিতে সম্বোধন করা হয় ডেপুটি সাব মার্শাল ল এডমিনিস্ট্রেটরকে এবং চিঠির শেষে নামের জায়গায় লেখা হয়- আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, ভারপ্রাপ্ত সভাপতি, ইসলামী জমিয়ত-এ-তালাবা পাকিস্তান, পূর্ব পাকিস্তান।
ওই সময় আহমেদ শফি উদ্দিন দৈনিক পাকিস্তান (পরে দৈনিক বাংলা) পত্রিকার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি এবং রাজশাহী থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক সোনার দেশ পত্রিকার চিফ রিপোর্টার ছিলেন।
এই সাপ্তাহিক ১৯৭০ সালে জাতীয় চার নেতার অন্যতম এএইচএম কামারুজ্জামান প্রকাশ করেছিলেন। ভাষা আন্দোলনের সৈনিক সাঈদ উদ্দিন আহমেদ এর সম্পাদক ছিলেন।
শফি উদ্দিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, একাত্তরের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী রাজশাহী শহরের রাণীবাজার এলাকায় সাপ্তাহিক সোনার দেশের অফিস ভাঙচুর করে এবং পত্রিকার সব সাংবাদিকদের ‘মৃত্যু পরোয়ানা’ ঘোষণা করে। সেসময় সাংবাদিকরা গ্রামে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন।
“স্বাধীনতার পর রাজশাহী শহরে ফিরে আমি যুদ্ধের প্রমাণগুলো বিভিন্ন স্পট থেকে সংগ্রহ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। আমাদের বাড়ির ১০টি বাড়ি পরে শহরের রানীবাজারে আলবদর বাহিনী ক্যাম্প করেছিল। আলবদরের ডিভিশনাল সদরদপ্তর ‘মোহিনী নিকেতন’ ঘুরে দেখার সময় কুয়োর ভেতরে পানির ময়লার স্তরের উপর আমি একটি ব্যাগসহ কিছু কাগজপত্র দেখতে পাই।”
পরে বাড়ি থেকে দড়ি নিয়ে এসে চাচাত ভাই রাজশাহী বেতারের কর্মচারী আমজাদ আলীর সহায়তায় ওই ব্যাগসহ কাগজপত্র উদ্ধার করেন শফি।
তিনি বলেন, “সেখানে আলবদর বাহিনী গঠনের নথি পাওয়া যায়। গবেষণার জন্য ওই নথিগুলো বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলামকে দিয়েছিলাম, যেগুলোর একাধিক কপি ছিল সেগুলো রেখে দিয়েছিলাম।”
যুদ্ধের শেষ দিকে পরাজয় নিশ্চিত জেনে তারা পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, চিকিৎসক ও শিল্পীদের বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে নির্যাতন করে হত্যা করেছিল।
পরে বিভিন্ন বধ্যভূমিতে অনেকের মরদেহ বিকৃত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল, তাদের অনেকের পরিচয় আর জানা যায়নি।
আহমেদ শফি উদ্দিন বলেন, ইংরেজিতে লেখা দিন, তারিখ ও স্বাক্ষরহীন এসব নথিপত্রে আলবদর বাহিনী গঠনের বর্ণনা আছে। সেই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে ‘শত্রু’ এবং ‘দুর্বৃত্ত’ বলে তাদের নির্মূল করার লক্ষ্যে আলবদর বাহিনীর কর্মপরিকল্পনা, উদ্দেশ্য ও তৎপরতার কথা বলা হয়েছে।
ওইসব নথিতে আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ পাকিস্তানি সামরিক শাসকদের কাছে আলবদর বাহিনী গঠনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন; দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে থাকা ইসলামি ছাত্র সংঘের (আইসিএস) কর্মীদের এই সংগঠনের সদস্য করার প্রস্তাব করেন।
সংঘের কর্মীদের ‘অনুগত, আন্তরিক ও সৎ পাকিস্তানি’ এবং তারা ওই ‘দুঃসময়ে’ সর্বোত্তমভাবে জাতির সেবা করতে প্রস্তুত বলেও বর্ণনা করা হয় মুজাহিদের ওই নথিতে।
ওই সময়ের পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্র সংঘের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মুজাহিদ নিজেকে ‘ইসলামী জামিয়ত-ই-তালাবা পাকিস্তান’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
তিনি আলবদর বাহিনীতে ‘কেবলমাত্র সেই পরীক্ষিত কর্মীদের নিয়োগ করতে প্রস্তাব করেন, যারা তাদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হলেও পাকিস্তানের অখণ্ডতার জন্য কাজ করবে’। আলবদর কর্মীদের সংখ্যার চেয়ে ‘মানের দিকে’ খেয়াল রাখার কথাও তিনি চিঠিতে বলেন।
পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে ‘দুর্বৃত্তদের’ বাছাই ও জিজ্ঞাসাবাদ করতে এবং তাদের বিরুদ্ধে গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে আলবদর বাহিনীর সহায়তা নেওয়ার কথা তিনি প্রস্তাব করেন।
চিঠিতে মুজাহিদ বলেন, “রাজাকার ও মুজাহিদদের উপরে স্বেচ্ছাসেবীদের একটি নতুন দল সংগঠিত করা যেতে পারে, যার বেশিরভাগই হবে ছাত্র। অবশ্য ছাত্র নয়, এমন যুবকদের মধ্যে যারা বুদ্ধিমান ও সৎ, তাদের এই বাহিনীর অধীনে রাখা যেতে পারে।”
মুজাহিদ আলবদর বাহিনীকে এতটা শক্তিশালী ও সাহসী হিসেবে প্রস্তুত করার পরামর্শ দিয়েছিলেন, যেন তারা পাকিস্তানের অখণ্ডতার বিরুদ্ধে ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে অবস্থানকারীদের নিকটাত্মীয়দেরও ‘রেহাই না দেওয়ার সক্ষমতা’ অর্জন করে।
এক পৃষ্ঠার নথিটি সামরিক প্রশাসনের একটি চিঠি, যেটা ‘গোপনীয়’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তাতে আলবদর গঠনের রূপরেখা বর্ণনা করা হয়েছে।
সেখানে বলা হয়, আলবদরকে কমান্ডো ধরনের বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলা হবে, যাদের লক্ষ্যগুলো হবে সরকার/সেনাবাহিনীকে সহায়তা করা এবং নাশকতা কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা।
২০০১ সালে জামায়াতে ইসলামীকে সঙ্গে নিয়ে বিএনপি জোট ক্ষমতায় এসে যুদ্ধাপরাধ সংঘটনকারী এই দলটির সেক্রেটারি জেনারেল মুজাহিদকে সমাজকল্যাণমন্ত্রী করে।
বুদ্ধিজীবী গণহত্যার ষড়যন্ত্র ও ইন্ধনের দায়ে ২০১৩ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল মুজাহিদকে মৃত্যুদণ্ড দেয়। দুই বছর পর ২০১৫ সালের ২২ নভেম্বর তার ফাঁসি কার্যকর করা হয়।