চিকিৎসার অভাবে আগুনে পোড়া তার ডান পা বেঁকে গেলে পঙ্গু হয়ে পড়েন চাঁদপুরের স্বপন গাজী (৪৫) । সদর উপজেলার খুলিশাডুলির ফজলুর রহমান গাজীর ছেলে তিনি।
চাঁদপুর সরকারি জেনারেল হাসপাতালের অর্থপেডিক্স সার্জারি বিভাগের চিকিৎসকরা তার বাঁকা পা সারিয়ে তোলার পর বৃহস্পতিবার তাকে হাসপাতাল ছাড়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
অর্থপেডিক্স বিভাগের সিনিয়র কনসালটেন্ট ডা. শাহাদাত হোসেন বলেন, স্বপন গাজী এখন নিজের দুই পা দিয়ে স্বাভাবিকভাবে হাঁটাচলা শুরু করছেন। যা গত ৩৫ বছর যাবত তার কাছে স্বপ্নের মতো ছিল।
“পায়ের এ জটিল রোগ চাঁদপুরের বাইরে চিকিৎসা করতে হলে ব্যয় হতো প্রায় তিন লাখ টাকার মতো। কিন্তু আমরা তাকে এক টাকাও খরচ করতে দিইনি।
“স্বপনের ৩৫ বছরের অভিশপ্ত জীবনের অবসানে তার মতো আমরাও অনেক আনন্দিত।’
এদিকে, আবারো দুই পায়ে ভর দিয়ে হাঁটতে পারার আনন্দে অশ্রুসিক্ত স্বপন।
স্বপন বলেন, “প্রায় ৩৫ বছর আগে এক শীতের সকালে আমার বড় বোনের সাথে আগুন পোহাচ্ছিলাম। এক সময় আমার বোন কোনো এক কাজে ঘরের ভেতর যায়।
“ফিরে এসে দেখে আমার লুঙ্গিতে আগুন জ্বলছে। আমাকে উদ্ধার করতে করতে আমার ডান পায়ের হাটুর অংশের অনেকটুকু জায়গা পুড়ে যায়।”
তার রিকশাচালক বাবার পক্ষে উন্নত হাসপাতালে নিয়ে তার চিকিৎসা করানো সম্ভব হয়নি। প্রয়োজনীয় চিকিৎসার অভাবে তার ডান পা বেঁকে যায়।
“পা বেঁকে গিয়ে পঙ্গু হয়ে যাই আমি। পরে ক্রাচ ব্যবহার করে চলাফেরা শুরু করি।”
বড় হয়ে এক পা নিয়েই রিকশা চালানো শুরু করেন তিনি। পঙ্গুত্ব নিয়েই মানবেতর জীবন কাটাচ্ছিলেন তিনি।
তার আর্থিক অবস্থার কথা জানতে পেরে অর্থপেডিক্স সার্জারি বিভাগের চিকিৎসকরা বিনা পয়সায় তাকে চিকিৎসার আশ্বাস দেন।
চিকিৎসকদের পরামর্শে গত ৮ অক্টোবর চাঁদপুর সরকারি জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি হন তিনি। সেখানে তার পায়ে অপারেশন করা হয়।
পঙ্গুত্বের অবসানে স্বপন বলেন, “আমি যে কী আনন্দিত তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব না। আমি এ হাসপাতালের চিকিৎসকসহ সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।”
চাঁদপুর সরকারি জেনারেল হাসপাতালের অর্থপেডিক্স বিভাগের চিকিৎসক আনিসুর রহমান সূফী বলেন, ‘স্বপন গাজী হাসপাতালে এসে যোগাযোগ করলে তাকে আমরা বিনামূল্যে চিকিৎসা করার সিদ্ধান্ত নিই।
হাসপাতালের অর্থপেডিক্স বিভাগের সিনিয়র কনসালটেন্ট ডা. শাহাদাত হোসেন ও সহকারী রেজিস্ট্রার ফরিদ আহমেদ চৌধুরীসহ একটি মেডিকেল বোর্ড গঠন করে তার চিকিৎসা শুরু করেন তারা।
স্বপন গাজীর রোগটির নাম ‘পোস্ট বার্ন কন্ট্রাকচার’ —আগুনে পুড়ে শরীরের কোনো অংশ কুঁচকে যাওয়া রোগ।
সম্প্রতি স্বপনের সেই কুঁচকানো অংশে ক্ষত সৃষ্টি হয়, চিকিৎসাশাস্ত্রের পরিভাষায় একে ‘মারজলিন আলসার’ বলা হয়—যা ক্যান্সারের দিকে যাচ্ছিল বলেন ডা. আনিসুর রহমান সূফী।
তিনি বলেন, “কয়েকটি ধাপে আমরা স্বপন গাজীর অপারেশনের কাজ করি। প্রথম ধাপে তার পায়ের সমস্ত পোড়া অংশ অপারেশনের মাধ্যমে অপসারণ করি। বিষয়টি যথেষ্ট জটিল এবং ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। পরে বাঁকা পা সোজা করি।
“তার শরীরে ক্যান্সারের কোনো অস্তিত্ব আছে কিনা তা জানতে আক্রান্ত স্থানের মাংস পরীক্ষার জন্য ঢাকায় পাঠাই। খুশির সংবাদ হল ঢাকা থেকে আসা রিপোর্টে দেখা যায় তার শরীরে ক্যান্সারের কোনো অস্তিত্ব নেই।”
রোগীকে নিয়মিত ফলোআপ করে তারা দ্বিতীয় দফা অপারেশনে স্কিন গ্রাফট করেন চিকিৎসকরা।
চিকিৎসকদের পরামর্শ অনুযায়ী নিয়মিত কয়েকটি ব্যায়াম করলে স্বপনের চলাফেরায় আর সমস্যা থাকবে না বলেন তিনি।
স্বপনের রয়েছে এক ছেলে আর দুই মেয়ে।
তার স্ত্রী তাসলিমা বেগম বলেন, আমি এত টাকা ব্যয় করে স্বামীর চিকিৎসা করতে পারতাম না। হাসপাতালের চিকিৎসকরা আমার স্বামীর যে উপকার করেছেন, আজীবন আমরা এই হাসপাতালের চিকিৎসকদের কাছে ঋণী হয়ে রইলাম।