মহেশ ভট্টাচার্যের ভিটায় আশ্রয়ন প্রকল্পে ক্ষুব্ধ গ্রামবাসী

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরের খ্যাতিমান ব্যবসায়ী ও সমাজসেবক মহেশ ভট্টাচার্যের বসতভিটায় সরকারের আশ্রয়ন প্রকল্প গড়ার প্রতিবাদে আন্দোলনে নেমেছে এলাকাবাসী।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 Nov 2020, 04:07 AM
Updated : 27 Nov 2020, 06:07 AM

ইতিমধ্যে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছে এলাকার লোকজন। এরপরও সরকারের পক্ষে কোনো পদক্ষেপ না হলে তারা কঠোর আন্দোলনের হুমকি দেন। একই সঙ্গে ট্রাস্টিদের পক্ষ থেকে উচ্চ আদালতে যাওয়ার কথাও বলা হয়েছে।

নবীনগর উপজেলার বিটঘর গ্রামে মহেশ ভট্টাচার্যের রেখে যাওয়া বসতভিটাসহ ৭৪ শতক সম্পতি সরকার খাস খতিয়ানভুক্ত করে সেখানে মুজিববর্ষে গৃহ ও ভূমিহীনদের জন্য ৩২টি ঘর নির্মাণ করছে।

মহেশ ভট্টাচার্যের স্মৃতি রক্ষায় মঙ্গলবার বিকালে বিটঘর এলাকায় একটি বিক্ষোভ সমাবেশ হয়েছে।

বিটঘর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল কাইয়ুমের সভাপতিত্বে এই সমাবেশ হয়। সমাবেশে কয়েকশ লোক উপস্থিত ছিলেন। 

সমাবেশে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন প্রিন্সিপাল মোস্তফা কামাল, আওয়ামী লীগ নেতা আহাম্মদ আলী খাঁ, শফিকুল ইসলাম, যুবলীগ নেতা সেহেদী জাফর দস্তগীর, মাখন মুন্সি প্রমুখ।

সমাবেশ বক্তারা মহেশ ভট্টাচার্যের রেখে যাওয়া বসতভিটাসহ কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি রক্ষায় প্রথানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন।

এদিকে, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বিটঘরের গৃহনির্মাণ প্রকল্প পরিদর্শন করেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) আশরাফ আহমেদ রাসেল, নবীনগরের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা একরামুল ছিদ্দিক ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) ইকবাল হাসান।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) আশরাফ আহমেদ রাসেল বলেন, মুজিববর্ষ উপলক্ষে ভূমিহীনদের মধ্যে ৩২টি ঘর নির্মাণের কাজ চলছে এখানে। পুরো জায়গাটিই এখন সরকারের খাস খতিয়ানভুক্ত। এই জমির কোনো মালিকানা না থাকায় সরকার এটিকে খাস খতিয়ানে অন্তর্ভুক্ত করেছে।

আশরাফ বলেন, “এটি সরকারের একটি উন্নয়নমূলক কাজ। ট্রাস্টিরা যথাযথ দেখভাল করলে হয়ত জমিগুলো সরকারের খাস খতিয়ানে স্থানান্তর হতো না।”

তিনি জানান, জেলা প্রশাসক একটি প্রশিক্ষণে আছেন। তিনি কর্মস্থলে যোগদানের পর বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা হবে।

মহেশ চ্যারিটেবল ট্রাস্ট্রের সদস্য অসীম দত্ত বলেন, “বিটঘরের আশপাশের ১৪টি গ্রামে অনেক খাস খতিয়ানভুক্ত জমি রয়েছে। তবু কেন মহেশ ভট্টাচার্যের স্মৃতি নষ্ট করে আশ্রয়ন প্রকল্প করা হচ্ছে তা আমার বোধগম্য নয়।”

তিনি বলেন, মহেষ ভট্টাচর্যের সম্পত্তি দেখভালের জন্যে তিন সদস্যের একটি ট্রাস্টি বোর্ড আছে। এই বোর্ডের ম্যানেজিং ট্রাস্টি হচ্ছেন সাবেক অ্যটর্নি জেনারেল নিখিলেশ দত্ত। নবতিপর এই ম্যানেজিং ট্রাস্টি গুরুতর অসুস্থ। আর দুই সদস্যের একজন হলেন স্বরূপ কান্তি দেব এবং আরেকজন তিনি নিজে (অসীম দত্ত)।

অসীম দত্ত নিজেদের অবহেলার কথা স্বীকার করে বলেন, প্রশাসন মহেশ চ্যারিটেবল ট্রাস্ট্রের সাথে যোগাযোগ না করেই এক নম্বর খাস খতিয়ানে অন্তর্ভুক্ত করেছে এই সম্পত্তি।

তিনি বলেন, “আমরা শিগগির এই কাজ বন্ধ করতে এবং খাস খতিয়ান থেকে ফিরিয়ে দিতে হাই কোর্টে রিট করব।”

শুধু ব্রাহ্মণবাড়িয়াতেই নয়, কুমিল্লা শহরেও ট্রাস্টের অনেক সম্পত্তি বেদখল  হয়ে গেছে বলে অভিযোগ করেন অসীম দত্ত।

তিনি মহেশ ভট্টাচার্যের স্মৃতি বিজরিত ৭৪ শতক সম্পত্তি থেকে সরকারের গৃহ নির্মাণ প্রকল্পটি গ্রামের অন্য কোনো খাস জায়গায় সরিয়ে নিতে প্রশাসনের কাছে দাবি জানান।

নবীনগর উপজেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি বাচ্চু ভদ্র বলেন, “মুজিববর্ষ উপলক্ষে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উপহার হিসেবে ৩২টি ঘর নির্মাণকে আমরা স্বাগত জানাই। কিন্তু দানবীর মহেশ ভট্টাচার্যের স্মৃতি ধ্বংস করে তা করা উচিৎ নয়। আমাদের দাবি হচ্ছে মহেশ ভট্টাচার্যের স্মৃতি রক্ষা করে অন্য কোনো স্থানে এই ঘর নির্মাণ করা হোক।”

বিটঘর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য আবদুল কাইয়ুম বলেন, “আমাদের বিটঘরবাসীর আবেগ অনুভূতি মহেশ ভট্টাচার্যের পক্ষে। কিন্ত জেলা প্রশাসন আমাদের আবেগ, অনুভূতি, ক্ষোভকে উপেক্ষা করে এই আশ্রয়ন প্রকল্প করছে। আমরাও চাই আশ্রয়ন প্রকল্প হোক। কিন্ত মহেশ বাবুর স্মৃতিকে খুণ্ন করে নয়।”

তিনি বলেন, “আশেপাশে আরও খাস জমি রয়েছে। আমরা এডিসিকে (রাজস্ব) বলেছি পাশের দেওয়ান বাড়ির খাস জমিতে এই প্রকল্পটি করা হউক। আমরা প্রয়োজনে গ্রামবাসী অর্থ দিয়ে সহায়তা করব। গ্রামবাসী গত মঙ্গলবার থেকে কাজ বন্ধ রেখেছিল।

“কিন্ত নবীনগর উপজেলা এসি (ল্যান্ড) এসে আজ বৃহস্পতিবার সকাল থেকে সবার অনুভূতি ক্ষোভ উপেক্ষা করে আশ্রয়ণ প্রকল্পের কাজ শুরু করে দিয়েছে।”

সমাজসেবক মহেশ ভট্টাচার্য 

বাংলাপিডিয়ায় দেওয়া তথ্যে জানা যায়, মহেশচন্দ্র ভট্টাচার্য ১৮৫৮ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলার বিটঘর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ঈশ্বরদাস তর্কসিদ্ধান্ত ছিলেন একজন পণ্ডিত। তার মায়ের নাম রামমালা দেবী।

চরম দারিদ্র্যের কারণে মহেশচন্দ্রের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ হয়নি। তবে তিনি ঘরে বসে লেখাপড়া করেছিলেন। তিনি বঙ্গ বিদ্যালয়ে কিছুদিন শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

১৮৮৩ সালে পঞ্চান্ন টাকা পুঁজি করে ব্যবসায়ের লক্ষ্যে কলকাতা যান তিনি। সেখানে ওষুধের ব্যবসা শুরু করেন। পরিশ্রম ও অধ্যবসায় বলে তিনি এ ব্যবসায় সফলতা লাভ করেন।

আজীবন সমাজসেবক মহেশচন্দ্র ভট্টাচার্য  বাবার স্মৃতি রক্ষায় ১৯২৩ সালে কুমিল্লা শহরে প্রতিষ্ঠা করেন ঈশ্বর পাঠশালা। ১৯২০ সালে কুমিল্লা শহরের উপকণ্ঠে শাকতলা পল্লীতে রামমালা ছাত্রাবাস এবং ১৯৩৫ সালে রামমালা গ্রন্থাগার স্থাপন করেন। নারী শিক্ষার অগ্রযাত্রায় তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় কুমিল্লায় নির্মিত হয় নিবেদিতা বালিকা বিদ্যালয় ও নিবেদিতা ছাত্রীনিবাস।

তার নিজ গ্রামে প্রতিষ্ঠা করেন শিক্ষা সংসদ। তিনি কাশীধামে প্রতিষ্ঠা করেন ঈশ্বর পাঠশালা টোল। তার প্রচেষ্টায় ১৯৩৫ সালে স্থাপিত হয় রামমালা রোড ও রামমালা ডাকঘর। গ্রামের লোকের পানীয় জলের অভাব দূরীকরণের জন্য নিজ গ্রামে একটি পুকুর খনন করেন।

তীর্থ-ভ্রমণের সময় এক পর্যায়ে বৈদ্যনাথে দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে তিনি দরিদ্র লোকদের সাহায্য করেন। তিনি এ সময় প্রতিদিন ৪০০/৫০০ জন মানুষকে খাওয়াতেন।

১৯৩৫ সালে তিনি কালীঘাটে যাত্রীদের সুবিধার্থে একুশ নম্বর টালিগঞ্জে কালীঘাট যাত্রীনিবাস নির্মাণ করেন। এই যাত্রী নিবাসে যাত্রীরা ৪/৫ দিন বিনা ভাড়ায় থাকতে পারত।

তিনি বারানসীতে তার সহধর্মিণী হরসুন্দরী দেবীর নামে একটি ধর্মশালা প্রতিষ্ঠা করেন।