ময়মনসিংহে ব্যক্তির জমির উপর সরকারি রাস্তা

ময়মনসিংহের ধোবাউড়ায় ব্যক্তি মালিকানার জমির উপর দিয়ে সরকারি রাস্তা নির্মাণের উদ্যোগে ওই জমির মালিকরা ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন।

ইলিয়াস আহমেদ ময়মনসিংহ প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 Nov 2020, 01:52 PM
Updated : 26 Nov 2020, 01:52 PM

ধোবাউড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার ভাষ্য, কাজ শুরু হওয়ার আগে কেউ কোনো অভিযোগ করেনি; এখন কিছু লোক জমির মালিক বলে দাবি করছে।

তবে জেলা প্রশাসক বিষয়টি ‘জানেন না’ উল্লেখ করে বলেন, কেউ অভিযোগ করলে তিনি ব্যবস্থা নেবেন।

এদিকে, জমির মালিকদের একজন মামলা করার পর আদালত রাস্তার কাজ বন্ধ রাখার আদেশ দিয়েছে।

সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, ধোবাউড়া উপজেলা পরিষদের সামনে থেকে বহুমুখী সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় খেলার মাঠ ও শ্মশান ঘাট পর্যন্ত একটি রাস্তা নির্মাণ করছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর-এলজিইডি। স্থানীয়দের অভিযোগ নির্মাণাধীন আধ কিলোমিটার রাস্তা সরকারি রাস্তা দিয়ে না নিয়ে ব্যক্তি মালিকানার জমির উপর দিয়ে নেওয়া হচ্ছে। এতে স্থানীয় কয়েকজনের প্রায় কোটি টাকার জমি হারাতে হচ্ছে বলে তাদের ভাষ্য।

জমির মালিকানা দাবিদারদের একজন মতিউর রহমান ফকির বলেন, স্বাধীনতা সংগ্রামের আগ থেকেই তার বাব-দাদারা এখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। ৩০ বছর আগে স্কুলের খেলার মাঠে যাওয়ার জন্য কোনো রাস্তা ছিল না। তাই তারা তাদের জমিতে ব্যক্তি উদ্যোগে চলাচলের জন্য একটি রাস্তা করে দিয়ে ছিলেন। এখন তাদের এলাকায় মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স, সাব-রেজিস্ট্রি অফিস এবং ভূমি অফিসের কার্যালয় নির্মাণ করা হয়েছে। জমির শতাংশও হয়েছে ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকা।

তিনি বলেন, সম্প্রতি এলজিইডি জমির মালিকদের উদ্যোগে নির্মিত রাস্তার উপর পাকা রাস্তা নির্মাণ শুরু করেছে; যদিও পাশ দিয়ে সরকারি রাস্তা নির্মাণ করার মতো জায়গা রয়েছে।

প্রশাসনের এই উদ্যোগে হতাশা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন মতিউর রহমান।

জমির আরেক মালিক সোহেল ফকির বলেন, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তাদের জমির উপর দিয়ে জোরপূর্বক রাস্তা নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেছেন। বিষয়টি বারবার অবগত করার পরেও রাস্তার কাজ বন্ধ করা হয়নি।

“এলাকার সমস্ত লোকজন অবগত রয়েছে যে এটি আমাদের ব্যক্তি মালিকানার রাস্তা। তবুও সরকারি লোকজন আমাদের কোনো কথাই মানছে না।”

লুৎফর রহমান ফকির নামের আরেকজন বলেন, “এদিক দিয়ে রাস্তা নেওয়ার মতো যদি সরকারি জায়গা না থাকত তাহলে আমরা আমাদের জমি দিয়ে রাস্তা দিতাম, কোনো সমস্যা ছিল না। সরকারি জায়গা থাকা সত্বেও কেন আমাদের জমির উপর দিয়ে রাস্তা তা কোনোভাবেই বুঝে উঠতে পারছি না। আমাদের প্রায় কোটি টাকা ক্ষতি হচ্ছে।”

স্থানীয় বাসিন্দা নজরুল ইসলাম ও জুলহাস উদ্দিন বলেন, তারা মতিউর রহমান ফকিরদের কাছ থেকে জমি কিনে ২৫ থেকে ৩০ বছর ধরে এখানে বসবাস করছেন। রাস্তাটি তারা ব্যক্তি উদ্যোগেই চলাচলের জন্য তৈরি করেছিলেন। এখন সরকারি জায়গা থাকতেও তাদের না জিজ্ঞেস করেই রাস্তা নির্মাণ করা হচ্ছে।

স্থানীয় শিক্ষার্থী আশরাফুল আলম বলেন, “এই রাস্তাটি শুধু ব্যক্তি মালিকানার জমির উপর দিয়েই যাচ্ছে তা নয় আমাদের খেলার মাঠের উপর দিয়েও যাচ্ছে। খেলার মাঠের উপর দিয়ে রাস্তা যাওয়ায় মাঠটি ছোটো হয়ে গেছে। খেলাধুলার সমস্যা হচ্ছে।”

স্থানীয় জরিপকারী আবুল কালাম বলেন, এখানে কিছুদিন পরপর জমি বিক্রি হয়। তাই তাকে জমি মেপে দিতে হয়।

দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি বলেন, নির্মাণাধীন রাস্তাটি ব্যক্তি মালিকানা জমির উপর দিয়ে নেওয়া হচ্ছে। প্রশাসন ইচ্ছা করলেই তাদের জমি দিয়ে রাস্তা নিতে পারে।

সদর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান এরশাদুল হক বলেন, রাস্তাটি ইউনিয়ন পরিষদের কিনা তার জানা নেই। তবে চলাচলের সুবিধার জন্য ১৫-২০ বছর আগে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে কিছু মাটি কাটা হয়েছিল। তার ধারণা রাস্তাটি ব্যক্তি মালিকানার।

তিনি বলেন, “এই নিয়ে ভ্রান্ত ধারণা দূর করতে ইউএনও স্যারকে সার্ভেয়ার দিয়ে রাস্তা মাপানোর সুপারিশ করা হলেও তিনি কর্ণপাত করেননি। ইউএনও স্যার উদ্যোগ নিলেই বিষয়টির সুন্দর একটি সমাধান হতে পারত।”

বেসরকারি সংস্থা জেলা জনউদ্যোগের আহবায়ক জ্যেষ্ঠ আইনজীবী নজরুল ইসলাম চুন্নু বলেন, একটি রাস্তা দিয়ে দীর্ঘ সময় লোকজন চলাফেরা করলে সেটি সরকারি রাস্তা হিসেবেই স্বীকৃতি পায়। তবে ব্যক্তি মালিকানার জমি হলে প্রশাসন চাইলে সরকারি ‘হালট’ [পথ] ব্যবহার করে রাস্তা নির্মাণ করতে পারে।

ধোবাউড়া উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ডেভিড রানা চিসিম বলেন, উপজেলার সকল উন্নয়ণমূলক কাজে ইউএনওর তদারকি করার সুযোগ রয়েছে। রাস্তা নির্মাণে জটিলতা সৃষ্টি হওয়ায় ইউএনওকে সমাধানের জন্য বেশ কয়েকবার বলা হয়েছে। কিন্তু তিনি অজানা কারণে উদ্যোগী হননি।

ধোবাউড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রাফিকুজ্জামান বলেন, দীর্ঘদিন ধরে সাধারণ মানুষ এই রাস্তা দিয়ে চলাচল করে আসছে। কখনও কেউ বলেনি এটি ব্যক্তি মালিকানার রাস্তা। কাজ শুরু করার পর থেকেই একটি পক্ষ রাস্তাটি তাদের বলে দাবি করছে।

“আদালতের নির্দেশে আপাতত রাস্তার কাজ বন্ধ রয়েছে।”

ময়মনসিংহ এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শহিদুজ্জামান খান বলেন, দেশের সব জমির মালিক সরকার। সেই অনুযায়ী জেলাতে জেলা প্রশাসক এবং উপজেলায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সকল জমির মালিক।

“যেহেতু উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রাস্তাটি অনুমোদন দিয়েছেন এবং রাস্তার কাজও চলছে সেহেতু সেখানে আমাদের করার কিছু নেই। কাজ শুরুর আগে বললে হয়ত বিষয়টি বিবেচনা করা যেত।”

জেলা প্রশাসক মিজানুর রহমান বলেন, সরকারি রাস্তা রেখে ব্যক্তি মালিকানার জমি দিয়ে রাস্তা নির্মাণের বিষয়ে তিনি অবগত নন। কেউ যদি লিখিত অভিযোগ করে তাহলে বিষয়টি তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এই বিষয়ে করা মামলার আইনজীবী ইসলাম উদ্দিন খান জানান, গত ১২ নভেম্বর সোহেল ফকির বাদী হয়ে একটি মামলা করেছেন। এই মামলায় আদালত রাস্তা নির্মাণ বন্ধ রাখার আদেশ দিয়েছে। আগামী রোববার এই মামলার পরবর্তী শুনানির দিন রয়েছে।