পাহাড়ে বন টিকিয়ে রাখতে পাহাড়ে বিভিন্ন জনগোষ্ঠী এই উদ্যোগ নেওয়া শুরু করে। কোনো বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে এই বনের সম্পদ ব্যবহার করা হয় না।
নির্দিস্ট কোনো মৌজার কোনো পাড়ার ব্যক্তি অথবা সামাজিক প্রয়োজনে বন থেকে বাঁশ ও কাঠ ব্যবহার করার জন্য প্রথাগতভাবে এই পাড়াবন করা হয়। সামাজিক ও যৌথ মালিকানার এই ব্যবস্থার নাম পাড়াবন বা মৌজা বন।
বান্দরবান, রাঙামাটি ও খাগড়াছড়িতে বহু পাড়াবন রয়েছে।
পাড়াবন রক্ষণাবেক্ষণ ও বনজ সম্পদ ব্যবহার ও ব্যবস্থাপনার জন্য প্রতিটি পাড়াবনের কমিটি থাকে।
কয়েকটি পাড়াবন কমিটির সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কেউ ইচ্ছামত এই বন থেকে কিছু সংগ্রহ করতে পারে না। কোনো ব্যক্তি অথবা সামাজিকভাবে প্রয়োজন হলে যাচাই-বাছাই করে দেখার পরে বাঁশ অথবা কাঠ সংগ্রহের চূড়ান্ত অনুমতি দেয় এই কমিটি। তবে বনের বড়ো কোনো গাছ ও পানি ধরে রাখে এমন কিছু গাছ কাটার নিয়ম নেই।
বান্দরবানে ২৩১টি পাড়াবনের হিসাব রয়েছে বলে বন ও ভূমি অধিকার সংরক্ষণ আন্দোলন বান্দরবান জেলা কমিটির সভাপতি জুয়ামলিয়ান আমলাই জানিয়েছেন।
“পাড়াবনের মাধ্যমে একদিকে স্থানীয়রা উপকৃত হচ্ছে, অন্যদিকে বিপন্ন বিভিন্ন প্রজাতির গাছ রক্ষা পাচ্ছে। এছাড়া পাড়াবনে কিছু বিরল গাছ পানির উৎস ধরে রাখে এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে পাড়াবাসীরা রক্ষা পায়।”
আয়তনে একেকটি পাড়াবনে ৪০ থেকে প্রায় ৪০০ একর পর্যন্ত রয়েছে জানিয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডকমকে জুয়ামলিয়ান বলেন, বন ও ভূমি অধিকার সংরক্ষণ আন্দোলন কমিটির উদ্যোগে বিভিন্ন সময়ে করা জরিপে ২৩১টি পাড়াবনের সংখ্যা পাওয়া গেলেও বেশি দুর্গম এলাকার কিছু পাড়াবনের আয়তন পরিমাপ করা যায়নি।
বহু পাড়াবনের মধ্যে একটি হলো চিম্বুক পাহাড়ের ‘রেনিক্ষ্যং ম্রো পাড়াবন’।
সম্প্রতি বান্দরবানের চিম্বুক পাহাড়ে ১২ মাইল এলাকায় একটি পাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, বাগানপাড়ায় একটি সামাজিক অনুষ্ঠান চলছে। দুই থেকে তিনশ জনের খাবারের আয়োজন। রান্নার জন্য দরকার জ্বালানি কাঠ। এসব কাঠ সংগ্রহ করা হয়েছিল রেনিক্ষ্যং পাড়াবন থেকে।
এই অনুষ্ঠানের আয়োজক ইয়াংরু ম্রো বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বন-জঙ্গলে আগের মত বাঁশ ও কাঠ পাওয়া যায় না। বড়ো কোনো অনুষ্ঠান করতে গেলে জ্বালানি কাঠের জন্য একমাত্র পাড়াবনই ভরসা।
“অথচ এক সময় যখন যা প্রয়োজন হাতের নাগালেই ছিল। কিছু একটা করতে গেলে বাঁশ ও কাঠের প্রয়োজন। আশপাশে প্রাকৃতিক বন ধ্বংস হওয়ায় আমরা সংকটে পড়েছি। পাড়াবন না থাকলে আমাদের আরও অসুবিধা হত।”
কনয়াং ম্রো বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গত বছর পাড়াবন থেকে বাঁশ কেটে ঘর নির্মাণ করেছি। কিনতে গেলে আকার ভেদে একটি বাঁশের দাম ৩০ থেকে ৬০ টাকা পড়ে। পাড়াবন থেকে পাওয়ায় খরচ করতে হয়নি।”
তবে ঘর তৈরি ছাড়া এক পরিবারে শুধু ২০০টি বাঁশ কাটার অনুমতি রয়েছে বলে জানান কনয়াং ম্রো ও থংপং ম্রো।
লেংতুই ম্রো ও পাওরুং ম্রো বলেন, পানি ধরে রাখে এমন কিছু গাছ রয়েছে পাড়াবনে যেখানে কোনো সময় পানি শুকায় না। পর্যাপ্ত না হলেও সাময়িক সুবিধা পাওয়া যায়।
পাড়ার বয়স্ক ব্যক্তি রেংরাং ম্রো বলেন, আগে বড়ো বড়ো গাছ ও ঘন বন থাকাতে প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকেও রক্ষা পাওয়া যেত। না বুঝে অনেকেই কেটে বিক্রি করে ফেলেছে। এখন পাড়াবন হিসেবে রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর গাছগুলো আরও বড়ো হতে সময় লাগবে।
রেনিক্ষ্যং পাড়াবন কমটিরি সভাপতি পায়া ম্রো বলেন, রক্ষণাবেক্ষণ ও বনের সম্পদ ব্যবহার নিয়ে ‘ম্রো রেনিক্ষ্যং বাগানপাড়া কমিটি’ নামে ১১ সদস্যের একটি কমিটি রয়েছে। সামাজিক ও ব্যক্তির প্রয়োজনে বাঁশ, কাঠ ও গাছ কাটার জন্য এই কমিটি অনুমতি দিয়ে থাকে। তবে বড় গাছ কাটার অনুমতি দেওয়া হয় না।
রেনিক্ষ্যং মৌজার হেডম্যান রাংলাই ম্রো এই পাড়াবন প্রসঙ্গে বলেন, তার এলাকায় এটি একমাত্র পাড়াবন, যে কারণে বন হিসেবে টিকে আছে। এতে স্থানীয় লোকজন উপকৃত হচ্ছে।
সুংসংপাড়াবনে রয়েছে বিপন্ন গাছ
“এই পাড়াবনে কড়ই, গর্জন, ধারমারা, সিভিট, গোদা, ছাতিম, গুটগুইট্যা, চাপালিশ, চাঁপা, ডুমুর, বন শিমুল, চালতা, হরিতকি, তুন, বন আতাসহ নানা প্রজাতির বুনো গাছ রয়েছে।”
প্রাকৃতিক বন না থাকায় অনেক গাছ বিপন্ন হয়েছে। বিলুপ্ত গাছগাছালি পুরনো পাড়াবন ছাড়া আশপাশে আর কোথাও দেখা মেলে না বলে জানান তিনি।
শুধু প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষা নয়, পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়িরা ঐতিহ্যগতভাবে এই ধরনের উদ্যোগ নিয়ে থাকে। কিন্তু পাড়াবন বা মৌজাবন সৃষ্টিতে পাড়াবাসীদের আরও সচেতনতা তৈরি করার প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করেন বন বভিাগের এই কর্মকর্তা।