পাহাড়ে পাড়াবন: বনরক্ষার আদর্শ উদ্যোগ

পার্বত্য তিন জেলায় বন সংরক্ষণের একটি আদর্শ উদ্যোগ পাড়াবন।

উসিথোয়াই মারমা বান্দরবান প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 Nov 2020, 03:57 AM
Updated : 25 Nov 2020, 04:45 AM

পাহাড়ে বন টিকিয়ে রাখতে পাহাড়ে বিভিন্ন জনগোষ্ঠী এই উদ্যোগ নেওয়া শুরু করে। কোনো বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে এই বনের সম্পদ ব্যবহার করা হয় না।

নির্দিস্ট কোনো মৌজার কোনো পাড়ার ব্যক্তি অথবা সামাজিক প্রয়োজনে বন থেকে বাঁশ ও কাঠ ব্যবহার করার জন্য প্রথাগতভাবে এই পাড়াবন করা হয়। সামাজিক ও যৌথ মালিকানার এই ব্যবস্থার নাম পাড়াবন বা মৌজা বন।

চিম্বুক পাহাড়ে বাগানপাড়া রেনিক্ষ্যং পাড়াবন

শুধু গাছ বা বাঁশ সংগ্রহ করা নয়, বনায়নও করতে হয় কখনও কখনও। গাছ বা বাঁশ কাটার পর কোনো স্থান ফাঁকা হয়ে গেলে সেখানে নতুন চারা রোপনও করা হয় বলে পাড়বন সংশ্লিষ্টরা জানান। 

বান্দরবান, রাঙামাটি ও খাগড়াছড়িতে বহু পাড়াবন রয়েছে।

পাড়াবন রক্ষণাবেক্ষণ ও বনজ সম্পদ ব্যবহার ও ব্যবস্থাপনার জন্য প্রতিটি পাড়াবনের কমিটি থাকে। 

কয়েকটি পাড়াবন কমিটির সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কেউ ইচ্ছামত এই বন থেকে কিছু সংগ্রহ করতে পারে না। কোনো ব্যক্তি অথবা সামাজিকভাবে প্রয়োজন হলে যাচাই-বাছাই করে দেখার পরে বাঁশ অথবা কাঠ সংগ্রহের চূড়ান্ত অনুমতি দেয় এই কমিটি। তবে বনের বড়ো কোনো গাছ ও পানি ধরে রাখে এমন কিছু গাছ কাটার নিয়ম নেই।

বান্দরবানে ২৩১টি পাড়াবনের হিসাব রয়েছে বলে বন ও ভূমি অধিকার সংরক্ষণ আন্দোলন বান্দরবান জেলা কমিটির সভাপতি জুয়ামলিয়ান আমলাই জানিয়েছেন।

চিম্বুক পাহাড়ে রেনিক্ষ্যং পাড়াবনে বাঁশঝাড়

জুয়ামলিয়ান আমলাই বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বান্দরবান জেলার সাত উপজেলায় ছোটো-বড়ো অসংখ্য পাড়াবন রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি রুমা উপজেলায় আছে ১১৪টি। এছাড়া রোয়াংছড়িতে ৩২টি, থানচিতে ২৫টি, আলীকদেমে ৩৬টি, লামায় ১১টি, নাইক্ষ্যংছড়িতে সাতটি এবং সদর উপজেলায় ছয়টি পাড়াবন রয়েছে।

“পাড়াবনের মাধ্যমে একদিকে স্থানীয়রা উপকৃত হচ্ছে, অন্যদিকে বিপন্ন বিভিন্ন প্রজাতির গাছ রক্ষা পাচ্ছে। এছাড়া পাড়াবনে কিছু বিরল গাছ পানির উৎস ধরে রাখে এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে পাড়াবাসীরা রক্ষা পায়।”

আয়তনে একেকটি পাড়াবনে ৪০ থেকে প্রায় ৪০০ একর পর্যন্ত রয়েছে জানিয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডকমকে জুয়ামলিয়ান বলেন, বন ও ভূমি অধিকার সংরক্ষণ আন্দোলন কমিটির উদ্যোগে বিভিন্ন সময়ে করা জরিপে ২৩১টি পাড়াবনের সংখ্যা পাওয়া গেলেও বেশি দুর্গম এলাকার কিছু পাড়াবনের আয়তন পরিমাপ করা যায়নি।

বহু পাড়াবনের মধ্যে একটি হলো চিম্বুক পাহাড়ের ‘রেনিক্ষ্যং ম্রো পাড়াবন’।

চিম্বুক পাহাড়ে রেনিক্ষ্যং পাড়াবনে বুনো বেতের লতা

রেনিক্ষ্যং পাড়াবন কমটিরি সভাপতি পায়া ম্রো জানান, এই পাড়াবনটি ১৯৯৫ সালে সংরক্ষণের উদ্যোগে নেওয়া হয়েছিল। এর আয়তন ৪০ একর। নানা প্রজাতির বাঁশ ও গাছ ছাড়াও রয়েছে লতাগুল্ম উদ্ভিদ। পাড়াবন হিসেবে সংরক্ষণ করার উদ্যোগ নেওয়ার সময় অনেকেই একমত ছিলেন না। বনের প্রয়োজনীয়তা বিষয়ে পাড়াবাসী নিয়ে বার বার বৈঠক করার পরই পাড়াবন সংরক্ষণে সবাই একমত হয়েছে।

সম্প্রতি বান্দরবানের চিম্বুক পাহাড়ে ১২ মাইল এলাকায় একটি পাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, বাগানপাড়ায় একটি সামাজিক অনুষ্ঠান চলছে। দুই থেকে তিনশ জনের খাবারের আয়োজন। রান্নার জন্য দরকার জ্বালানি কাঠ। এসব কাঠ সংগ্রহ করা হয়েছিল রেনিক্ষ্যং পাড়াবন থেকে।

এই অনুষ্ঠানের আয়োজক ইয়াংরু ম্রো বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বন-জঙ্গলে আগের মত বাঁশ ও কাঠ পাওয়া যায় না। বড়ো কোনো অনুষ্ঠান করতে গেলে জ্বালানি কাঠের জন্য একমাত্র পাড়াবনই ভরসা।

“অথচ এক সময় যখন যা প্রয়োজন হাতের নাগালেই ছিল। কিছু একটা করতে গেলে বাঁশ ও কাঠের প্রয়োজন। আশপাশে প্রাকৃতিক বন ধ্বংস হওয়ায় আমরা সংকটে পড়েছি। পাড়াবন না থাকলে আমাদের আরও অসুবিধা হত।”

চিম্বুক পাহাড়ে রেনিক্ষ্যং পাড়াবন থেকে বাঁশ সংগ্রহ করছেন দুই ম্রো যুবক

বাগানপাড়ার বাসিন্দা কনয়াং ম্রো ও থংপং ম্রো বলেন, ঘর তৈরি করতে বাঁশ ও কাঠের প্রয়োজন হয়। অস্বচ্ছল লোকজন খরচ করে ঘর তৈরি করার সামর্থ্য থাকে না। তাদের জন্য পাড়াবন থেকে বাঁশ, ছোটো গাছ-গাছালি ও কাঠ দেওয়ার ব্যবস্থা আছে। এতে পাড়ার অসহায় লোকজনদের উপকার হয়।

কনয়াং ম্রো বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গত বছর পাড়াবন থেকে বাঁশ কেটে ঘর নির্মাণ করেছি। কিনতে গেলে আকার ভেদে একটি বাঁশের দাম ৩০ থেকে ৬০ টাকা পড়ে। পাড়াবন থেকে পাওয়ায় খরচ করতে হয়নি।”

তবে ঘর তৈরি ছাড়া এক পরিবারে শুধু ২০০টি বাঁশ কাটার অনুমতি রয়েছে বলে জানান কনয়াং ম্রো ও থংপং ম্রো।

চিম্বুক পাহাড়ে রেনিক্ষ্যং পাড়াবন থেকে কাঠ সংগ্রহ করছেন দুই ম্রো নারী

এই পাড়ার দুই ম্রো নারী লেংতুই ম্রো ও পাওরুং ম্রো জানান, বছরের এপ্রিল ও মে দুই মাস পানি সংকট দেখা দেয় এ পাড়ায়। চাহিদা অনুযায়ী পানি পাওয়া যায় না। পানির উৎস শুকিয়ে যায়। দূরে গিয়ে সংগ্রহ করতে হয় পানি। এতে অনেক সময় চলে যায়। এমন সংকটের দিনেও পাড়াবনের ঝিরিতে পানি পাওয়া যায়।

লেংতুই ম্রো ও পাওরুং ম্রো বলেন, পানি ধরে রাখে এমন কিছু গাছ রয়েছে পাড়াবনে যেখানে কোনো সময় পানি শুকায় না। পর্যাপ্ত না হলেও সাময়িক সুবিধা পাওয়া যায়।

পাড়ার বয়স্ক ব্যক্তি রেংরাং ম্রো বলেন, আগে বড়ো বড়ো গাছ ও ঘন বন থাকাতে প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকেও রক্ষা পাওয়া যেত। না বুঝে অনেকেই কেটে বিক্রি করে ফেলেছে। এখন পাড়াবন হিসেবে রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর গাছগুলো আরও বড়ো হতে সময় লাগবে।

চিম্বুক পাহাড়ে রেনিক্ষ্যং পাড়াবনের ভেতর লতাগুল্ম ও একটি ছড়া

তবে রেংরাং ম্রো আক্ষেপ করে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, পাড়াবন সৃষ্টি করতে চাইলেও এখন আর সম্ভব নয়। অনেক জায়গা ব্যক্তি মালিকানা ও বনবিভাগে চলে যাচ্ছে। বিশাল এলাকাজুড়ে পাড়াবন তৈরি করতে যতটুকু জায়গা প্রয়োজন সে পরিমাণ জায়গা পাওয়া যায় না।

রেনিক্ষ্যং পাড়াবন কমটিরি সভাপতি পায়া ম্রো বলেন, রক্ষণাবেক্ষণ ও বনের সম্পদ ব্যবহার নিয়ে ‘ম্রো রেনিক্ষ্যং বাগানপাড়া কমিটি’ নামে ১১ সদস্যের একটি কমিটি রয়েছে। সামাজিক ও ব্যক্তির প্রয়োজনে বাঁশ, কাঠ ও গাছ কাটার জন্য এই কমিটি অনুমতি দিয়ে থাকে। তবে বড় গাছ কাটার অনুমতি দেওয়া হয় না।

চিম্বুক পাহাড়ে রেনিক্ষ্যং পাড়াবনের ভেতর লতাগুল্ম ও একটি ছড়া

প্রথাগত নিয়মে পাহাড়ে ভূমি ব্যবস্থাপনা ও জুমচাষিদের থেকে রাজস্ব আদায়ে দায়িত্বে রয়েছেন মৌজা প্রধান হেডম্যানরা।

রেনিক্ষ্যং মৌজার হেডম্যান রাংলাই ম্রো এই পাড়াবন প্রসঙ্গে বলেন, তার এলাকায় এটি একমাত্র পাড়াবন, যে কারণে বন হিসেবে টিকে আছে। এতে স্থানীয় লোকজন উপকৃত হচ্ছে।

সুংসংপাড়াবনে রয়েছে বিপন্ন গাছ

চিম্বুক পাহাড়ে রেনিক্ষ্যং পাড়াবনের ভেতর লতাগুল্ম ও একটি ছড়া

রুমা উপজেলার রেমাক্রিপ্রাংসা মৌজার হেডম্যান সাবলুং বম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডকমককে জানান, তার মৌজার সুংসংপাড়ার পাড়াবন বান্দরবানে সবচেয়ে পুরনো ও বড় পাড়াবন। ১৯৫১ সালে স্থানীয় বম জনগোষ্ঠীর তৈরি করা এ পাড়াবনের আয়তন রয়েছে ৩৯৫ একর।

“এই পাড়াবনে কড়ই, গর্জন, ধারমারা, সিভিট, গোদা, ছাতিম, গুটগুইট্যা, চাপালিশ, চাঁপা, ডুমুর, বন শিমুল, চালতা, হরিতকি, তুন, বন আতাসহ নানা প্রজাতির বুনো গাছ রয়েছে।”

প্রাকৃতিক বন না থাকায় অনেক গাছ বিপন্ন হয়েছে। বিলুপ্ত গাছগাছালি পুরনো পাড়াবন ছাড়া আশপাশে আর কোথাও দেখা মেলে না বলে জানান তিনি।

রুমা উপজেলা রেমাক্রিপ্রাংসা মৌজায় সুংসংপাড়াবনের বিভিন্ন প্রজাতির গাছ

বান্দরবান বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ফরিদ মিঞা বলেন, মানুষ ও প্রকৃতির জন্য বনের বিকল্প নেই। বন থাকলে পশুপাখি ও বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য আরও সমৃদ্ধ হবে।

শুধু প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষা নয়, পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়িরা ঐতিহ্যগতভাবে এই ধরনের উদ্যোগ নিয়ে থাকে। কিন্তু পাড়াবন বা মৌজাবন সৃষ্টিতে পাড়াবাসীদের আরও সচেতনতা তৈরি করার প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করেন বন বভিাগের এই কর্মকর্তা।