উৎসে কপাট এঁটে করোতোয়া-বাঙ্গালী নদী খননে পাঁচ হাজার কোটি টাকা

করতোয়া, বাঙ্গালী, ইছামতি, মানাস ও নাগর নদী মরতে বসেছে। এক সময় বড় বড় নৌকা, স্টিমার চলা এসব স্রোতস্বিনীতে এখন স্রোত নাই। স্থানীয়দের আক্ষেপ, দূষণে নদীগুলোয় আর ‘শেওলাও জন্মে না।’

জিয়া শাহীন বগুড়া প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 Nov 2020, 06:57 AM
Updated : 8 Nov 2020, 06:57 AM

নদীর প্রাণ ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে এরই মধ্যে পাঁচ হাজার কোটি টাকার মতো ব্যয়ে বেশ কয়েকটি খনন প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন নদীর উৎসের গেইট আটকে রেখে খনন করে কোনো লাভ হবে না।

বগুড়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমান জানান, করতোয়া, বাঙ্গালী, ইছামতি, নগর নদীর পানির উৎস তিস্তা নদী। সেই ‘তিস্তাতেই পানি প্রবাহ কমে যাওয়ায় এসব নদীও স্রোতহীন হয়ে পড়েছে।

তিনি বলেন, তারপরও পানি প্রবাহ এবং পানি সংরক্ষণের জন্য কাজ হাতে নেওয়া হয়েছে। নদীর গতিপথ সচল করার এবং শুষ্ক মৌসুমে পানি ধরে রাখার লক্ষ্য নিয়ে করতোয়া নদী খননের জন্য দুই হাজার ৬৬৫ কোটি টাকা এবং বাঙ্গালী নদীর তীর সংরক্ষণ এবং খননের জন্য আরো দুই হাজার ৩৫৬ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে।

এছাড়াও মানাসের গতিপথ সচল করার জন্য সারিয়াকান্দির কামালপুরে যেখানে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণ করে প্রবাহ বন্ধ করা হয়েছিল। সেখানে ৩০ কোটি টাকা ব্যয়ে স্লুইচ গেইট নির্মাণের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।

“গেইটটি হলে এক দিকে মানাস নদী নাব্যতা ফিরে পাবে, অপরদিকে সেই স্রোতধারা ইছামতি এবং বাঙ্গালী নদী দুইটিকে সচল করবে।”

তবে তাদের এসব পরিকল্পনা কাজে দেবে না বলছেন নদী নিয়ে কাজ করা বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা বেলার রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের সমন্বয়কারী তন্ময় কুমার সান্যাল।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, করতোয়ার নদীর গাইবান্ধার খুলসিতে বন্ধ করা গেইট খুলে না দিলে নদী খনন কাজে কোনোই লাভ হবে না।

“ওই গাইবান্ধা পয়েন্টে গেইট দিয়ে ১২৩ কিলোমিটার দীর্ঘ করতোয়া নদীকে মেরে ফেলে ওই অঞ্চলের পরিবেশ নষ্ট করা হচ্ছে।”

এক সময় করতোয়ার পানির উৎস তিস্তা নদী হলেও ১৭৮৭ সালের বন্যায় তা বন্ধ হয়ে যায়।

এরপর থেকে ভারতের পাহাড়ের জল যমুনাশ্বরী হয়ে এ নদীর উৎসমুখে পড়ে বলে জানান গাইবান্ধা জেলায় করতোয়া নদীতে নির্মিত গেইট খুলে দেওয়ার আর্জি জানিয়ে উচ্চ আদালতে রিট করা সংস্থা বেলার এ কর্মকর্তা।

নদীগুলো গতি চিত্র তুলে ধরেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী হুমায়ুন আহমেদ।

তিনি জানান, কাটা, যমুনাশ্বরী, দেওনাই ও চাড়াল নদীর মিলন স্থান রংপুর জেলার মিঠাপুকুর থেকে করতোয়া নদীর উৎপত্তি। এরপর গাইবান্ধার কাটাখালি হয়ে ১২৩ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে এ নদী বাঙ্গালী নদীর বগুড়া অংশে এসে মিশেছে।

“১৯৮৮ বন্যার পর গাইবান্ধার খুলশী এলাকায় গেইট নির্মাণের পর এ নদীর প্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়।”

এদিকে, বাঙ্গালী নদী গাইবান্ধার কাটাখালি ও আলাই নদী থেকে উৎপত্তি হয়ে ৯৯ কিলোমিটার দীর্ঘ নদীটি সিরাজগঞ্জের কাছে করতোয়া নদীতে মিলেছে। আর ৭৪ কিলোমিটার দীর্ঘ ইছামতি নদী বগুড়া সদরের লাহিড়ীপাড়া থেকে শুরু হয়ে সারিয়াকান্দি ভেলাবাড়ি ধুনট হয়ে সিরাজগঞ্জের নলকায় বাঙ্গালী নদীর সাথে মিলিত হয়েছে।

এছাড়া যমুনা থেকে উৎপন্ন মানাস নদী ১৭ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে সারিয়াকান্দিও কামালপুর ধুনটের গোসাইবাড়ি হয়ে আবারও করতোয়ায় মিশেছে।

নাগর নদী বগুড়ার শিবগঞ্জ গাংনাই এবং করতোয়া থেকে উৎপত্তি হয়ে দুপচাচিয়া মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়। ১১২ কিলোমিটার ঘুরে নদীটি নাটোরের সিংড়ায় গিয়ে আত্রাই নদীর সাথে মিলেছে।

এদিকে, ধুনট উপজেলার চিথুলিয়া গ্রামের জহুরুল ইসলাম জানান, ১৯৬৫ সালে সারিয়াকান্দী উপজেলার কামালপুরে মানাস নদীর উৎস পথ বন্ধ করে সেখানে যমুনার ভাঙন রোধে ব্রহ্মপুত্র বাঁধ নির্মাণ হয়।

“আগে মানাস নদীতে বড় বড় নৌকা চলত। নদী থেকে বিভিন্ন খালে পানি যেত। চিথুলিয়া বিল, চিকাশী বিল, গজারিয়া বিলে মাছে ভরপুর থাকত। খালেও প্রচুর মাছ পাওয়া যেত।

“বন্যার পানির সাথে পলি মাটি আসত। জমিতে কোনো রাসায়নিক সার দিতে হতো না। ফসলও হতো বেশি। এখন রাসায়নিক সার দিয়ে ফসল উৎপাদন করতে হয়।”

সারিয়াকান্দী উপজেলার বৃহৎ বিল গজারিয়ার পাড়ের জেলে পল্লীর হরেন হাওয়াদার জানান, বিলে এখন আর বন্যায় মাছ আসে না।

আগে এ বিলের মাছ ধরাই ছিল তাদের জীবিকার উৎস জানিয়ে তিনি বলেন, সরকার ইজারা দিয়েছে। মাছ চাষ হয়। তাই অনেকেই পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় যাচ্ছে।

করতোয়া নদীতে লঞ্চ চলতে দেখার স্মৃতির কথা পেড়ে বগুড়া শহরের কালিতলার আব্দুর রহমান বগরা বলেন, আগে করতোয়ায় গোসল করত। নদীর পানিও খেত। সেই খর স্রোতা করতোয়া এখন মরে গেছে। নদীতে স্রোত নেই,পানির বর্ণ নীল।

“নদীর পানি বিষাক্ত হওয়ায় এখন শেওলাও জন্মায় না।”

নদীর দু’পাশ থেকে দখল হওয়ার সরু নালায় পরিণত হয়েছে এক সময়ের বিশাল করতোয়া বলেন তিনি।

বাঙ্গালী নদীও এক সময় প্রমত্তা ছিল জানিয়ে সারিয়াকান্দীর  মীর্জা দুলাল বলেন, নদী থেকে বিভিন্ন খাল দিয়ে বিলগুলোতে মাছ যেত। সারা বছর নদী, খাল, বিলে মাছ পাওয়া যেত।

“নদী মরে যাওয়ায় খালও ভরাট হয়ে গেছে, অনেকে তা দখল করে চাষাবাদ করছে।”

ধুনট সদরের আলীমুদ্দিন জানান, ইছামতি আর নদী নেই। নদীর বুকে এখন হয় চাষাবাদ।

তার শঙ্কা নদীগুলো খনন করে পানি প্রবাহ না বাড়ালে পরিবেশ হুমকির মুখে পড়বে।

করতোয়াসহ এ এলাকার নদী উৎস মুখ খুলে সীমানা নির্ধারণ, দখল মুক্ত করে খনন করতে হবে, তবেই নাব্যতা ফিরে আসবে এবং পরিবেশের বিপর্যয় ঘটবে না বলে ভাবছেন সংশিষ্টরা।

তারা বলছেন, শুধু নদী খননই নয়, নদীর সাথে যুক্ত খাল, বিলও দখল মুক্ত করে খনন করতে হবে।

অন্যদিকে, গাইবান্ধা পয়েন্টে গেইট খুলে করতোয়া নদীকে বাঁচাতে পরিবেশ নিয়ে কাজ করার বেসরকারি সংস্থা বেলার উচ্চ আদালতে করা রিটের এখনও নিষ্পত্তি হয়নি।