সুন্দরবনের প্রধান বন সংরক্ষক মো. আমীর হোসাইন চৌধুরী এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
প্রতিবছর রাসমেলা উপলক্ষে সব সম্প্রদায়ের হাজার হাজার মানুষ দুবলার চরে সমবেত হয়। ঐতিহ্যবাহী এই মেলা স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
তবে রাসপূজা ও পুণ্যস্নান উপলক্ষে শুধু হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষকে সেখানে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন আমীর হোসাইন চৌধুরী।
আমীর হোসাইন বলেন, সুন্দরবনের যে স্থানে রাসমেলা হয় সেটি সংরক্ষিত বনাঞ্চল। মেলা উপলক্ষে হাজার হাজার মানুষ সেখানে যাওয়ায় একদিকে যেমন বন্যপ্রাণীর ক্ষতি হয়, অন্যদিকে ওইস্থানে মানুষের ফেলে দেওয়া আবর্জনায় ক্ষতি হয় বনের। এতে জীববৈচিত্র্যও হুমকির মুখে পড়ে।
“বন, বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্য রক্ষার স্বার্থে এই বছর থেকে দুবলার চরের রাসমেলা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।”
তিনি বলেন, যেহেতু লোকজন সেখানে শুধু পূজা ও স্নান করতে যান, তাই ওই সময় শুধু হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরাই সেখানে যাওয়ার অনুমতি পাবেন।
দুবলার চর রাস উদযাপন কমিটির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক প্রদীপ বসু শন্তু বলেন, রাসমেলা উপলক্ষে সেখানে সব সম্প্রদায়ের মানুষ সমবেত হন। প্রতিবছর মেলায় যাওয়ার জন্য হাজার হাজার মানুষ উন্মুখ হয়ে থাকেন। কিন্তু সরকারের এই সিদ্ধান্তের ফলে রাস আর মেলা বা উৎসবে পরিণত হবে না।
শন্তু আরও বলেন, গত বছর রাসমেলা হওয়ার কথা ছিল ১০-১২ নভেম্বর। তবে ১০ নভেম্বর উপকূলীয় এলাকায় ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুল’ আঘাত হানার কারণে সুন্দরবনে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া বন্ধ করে দেয় বন বিভাগ। এই কারণে মেলা আর হয়নি। তবে মেলা উদযাপন কমিটির সদস্যরা সেখানে গিয়ে পূজা ও স্নান করেছেন।
শন্তু বলেন, এই পরিস্থিতিতে এবছর ২৮ নভেম্বর বাগেরহাটের মোংলা থেকে যাত্রা শুরু করবেন আয়োজকেরা। ২৯ নভেম্বর অনুষ্ঠিত হবে পূজা; আর ৩০ নভেম্বর প্রথম প্রহরে স্নান অনুষ্ঠিত হওয়ার পর ফিরতে শুরু করবেন তারা।
“রাসপূজা শুধু হিন্দু সম্প্রদায়ের। তাই এবার থেকে শুধু তাদেরই পূজার জন্য যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হবে।”
পরিবেশ ও বন উপমন্ত্রী বেগম হাবিবুন নাহার বলেন, প্রতিবছর নির্দিষ্ট সময়ে শুধু রাসপূজা ও পুণ্যস্নান হবে। এবছর থেকে পূজায় শুধু হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ জাতীয় পরিচয়পত্র দেখিয়ে সেখানে যাওয়ার অনুমতি পাবেন।
হাবিবুন নাহার বলেন, প্রতিবছর হাজার হাজার মানুষ রাসমেলার সময় সেখানে গিয়ে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য নষ্ট করে। তারা হরিণ শিকার, শব্দদূষণ করে, ময়লা-আবর্জনা ফেলে বনের পরিবেশ দূষণ করে। এই কারণে রাসমেলা হবে না। পূজার সময় অন্য ধর্মের মানুষকে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হবে না।
বন বিভাগ থেকে জানা যায়, সুন্দরবনের দক্ষিণে মোংলা সমুদ্রবন্দর থেকে ১২০ কিলোমিটার দূরে সমুদ্রের কোলঘেঁষে দুবলার চর। আলোরকোল, ককিলমনি, হলদিখালি, কবরখালি, মাঝেরকিল্লা, অফিসকিল্লা, নারকেলবাড়িয়া, ছোট আমবাড়িয়া, মেহেরআলির চর এবং শেলারচর এসব মৎস্য আহরণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ চরগুলো নিয়েই দুবলারচর। এই চরের আয়তন ৮১ বর্গমাইল।
ঠিক কবে থেকে জেলেরা এখানে মৎস্য আহরণ করতে আসে, কবে থেকে এখানে রাসমেলা শুরু হয়, কারা এই চরের নাম দুবলারচর রেখেছিল, তা নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন বিশ্বাস ও মতামত রয়েছে।
প্রতিবছর কার্তিক মাসের শেষ বা অগ্রহায়ণের প্রথমদিকে শুক্লপক্ষের পূর্ণিমায় সুন্দরবনের দুবলার চরের আলোরকোলে তিন দিনব্যাপী রাসমেলা অনুষ্ঠিত হয়।
দুবলার চরের রাসমেলা সম্পর্কে খুলনা অঞ্চলের বিশিষ্ট লেখক সঞ্জীব হাউলী বলেন, এটি মূলত হিন্দুদের একটি পুণ্যোৎসব। হিন্দু পৌরাণিক মতে, রাস হচ্ছে রাধা-কৃষ্ণের মিলন। তবে এখানে আসা সনাতন ধর্মীরা তাদের দেবতা নীল কমল ও গঙ্গা দেবীর উদ্দেশে পূজা দেন।
অনেকের মতে, ২০০ বছর আগে গোপালগঞ্জের কাশিয়ানীর ওড়াকান্দি গ্রামে জন্ম হয় মতুয়া সাধক হরি ঠাকুরের। তিনি স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে দুবলার চরে পূজা-পার্বণাদি শুরু করেন এবং তার অনুসারীদের তার পথ অনুসরণ করার নির্দেশ দেন।
সেই থেকে প্রতিবছর বাংলা কার্তিক মাসের রাস পূর্ণিমা তিথিতে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে সনাতন সম্প্রদায়ের মানুষ দুবলার চরে আসে।
পাপমোচন ও পার্থিব জীবনের কামনা-বাসনা পূরণের লক্ষ্যে পুণ্যস্নানের মধ্য দিয়ে এই উৎসব পালন করে আসছে তারা।
কারও কারও মতে, বারো ভূঁইয়ার অন্যতম প্রতাপাদিত্য এই পূজা ও মেলার প্রবর্তন করেন।
অনেকে দুবলার চরের এই মেলাকে মৎস্য আহরণ মৌসুমের শুরু উৎসবও মনে করেন। এটি মৎস্য আহরণের মৌসুম।
এই সময় এখানে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে হাজার হাজার মৎস্য আহরণকারী নিকট আত্মীয়দের থেকে চার পাঁচ মাস দূরে অবস্থান করেন এবং সম্পূর্ণ যোগযোগ বিচ্ছিন্ন থাকেন।
তাদের মতে, প্রাচীন যুগে নানা কারণে সমুদ্রযাত্রা ও মৎস্য আহরণ করার সময় মানুষ তীরে পূজার্চনা করে সমুদ্রে নামত।