তৃতীয় দফা বন্যায় বিপর্যস্ত নওগাঁ আর গাইবান্ধার লাখো মানুষ

তৃতীয় দফা বন্যায় নওগাঁর তিন উপজেলা আর গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলায় লাখো মানুষ পানিবন্দি হয়ে দুর্বিষহ জীবনযাপন করছেন।

তাজুল ইসলাম রেজাসাদেকুল ইসলাম, নওগাঁ প্রতিনিধি ও , গাইবান্ধা প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 Sept 2020, 01:47 PM
Updated : 30 Sept 2020, 03:49 PM

দ্বিতীয় দফা বন্যার পর কৃষক আবারও যেসব আমন চারা রোপণ করেছিলেন, তা এখন পানির নিচে। বন্যায় ভেঙে পড়া মাটির ঘর নতুন করে বানিয়েছেন অনেকে। সেই ঘরও আবার পড়েছে ঝুঁকিতে।

সরকারি কর্মকর্তা, জনপ্রতিনিধি ও এলাকাবাসী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানিয়েছেন বন্যা পরিস্থিতির খবর।

নওগাঁ

জেলার আত্রাই, মান্দা আর রানীনগর উপজেলায় ৮৫ হাজারের বেশি মানুষ বন্যায় পানিবন্দি হয়ে দুর্বিষহ জীবনযাপন করছেন।

জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুজ্জামান খান জানান, আত্রাই নদীর পূর্ব বাঁধের ভাঙন দিয়ে পানি ঢুকে আত্রাই উপজেলার হাটকালুপাড়া, কালিকাপুর, আহসানগঞ্জ, শাহাগোলা, বিশা, পাঁচুপুর ও ভোঁপাড়া এই সাত ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে। আবার মান্দা উপজেলার কসব, বিষ্ণপুর ও নুরল্লাবাদ ইউনিয়ন আর রানীনগর উপজেলার গোনা ইউনিয়নে সব আমন ধান তলিয়ে গেছে। বুধবার সকাল থেকে জেলার সব কটি নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

তিনি বলেন, এসব ইউনিয়নের অধিকাংশ পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। প্রচুর মাটির বাড়িঘর ভেঙে গেছে। আত্রাইয়ের হাটকালুপাড়া ও কালিকাপুর ইউনিয়নের বাড়িঘরের কোথাও হাঁটুপানি আবার কোথাও কোমরপানির নিচে। পাকাবাড়ির বাসিন্দারা বাড়ির জিনিসপত্র বিভিন্নভাবে উঁচু করে তার ওপর রেখে কোনো রকমে বসবাস করছেন। এসব এলাকায় কোথাও কোনো উঁচু জায়গা নেই। অধিকাংশ পরিবারের রান্না করার ব্যবস্থা নেই। গৃহপালিত পশু, হাঁস-মুরগি নিয়ে দুর্বিষহ জীবনযাপন করছেন তারা।

কেউ কেউ দূরে কোথাও উঁচু স্থানে আশ্রয় নিলেও অধিকাংশ পরিবারের লোকজন পানির মধ্যে বাড়িতেই রয়েছেন বলে তিনি জানান।

হাটকালুপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শুকুর আলী বন্যার ভয়াবহতার রূপ বর্ণনা দিয়ে এই এলাকাকে বন্যা উপদ্রুত এলাকা ঘোষণার দাবি জানিয়েছেন। সেই সঙ্গে সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারি সংগঠনকে ত্রাণ তৎপরতায় এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।

তিনি বলেন, আত্রাই উপজেলার হাটকালুপাড়া ইউনিয়নে হাটকালুপাড়া, চকশিমলা,বড়শিমলা,পাহাড়পুর, হাটুরা, সন্যাসবাড়ি, কচুয়া, বড়াইকুড়ি ও মান্দার বন্যাকবলিত এলাকা কালিকাপুর, পার-নুরুল্যাবাদ, পার-শিমুলিয়া, ভুতপাড়া, নহলা কালুপাড়া, বিষ্ণুপুর, হুলিবাড়ী, চক-রামপুর, শহরবাড়ীসহ ১০ থেকে ১২টি গ্রামের ফসলের মাঠ তলিয়ে গেছে। অনেক মানুষের বাড়ি, রান্নাঘর ও উঠান পানিতে তলিয়ে গেছে। অনেক মানুষ রাস্তা ও বাঁধের উঁচু স্থানে আশ্রয় নিয়েছে। সেখানে বিশুদ্ধ খাবার পানি ও খাবারের সংকট দেখা দিয়েছে।

মান্দার বিষ্ণুপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলম বলেন, জুলাই মাসের বন্যায় ইউনিয়নের ২১টি গ্রামের সবই তলিয়ে গিয়েছিল। এবারও একই পরিস্থিতি।  এবারের বন্যায় আবারও এলাকার সব শ্রেণি–পেশার মানুষ চরম দুর্ভোগে পড়েছেন। প্রথম দফা বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর মাঠে আমন ধানের চারা লাগিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছিলেন এলাকার কৃষক। কিন্তু এবারের বন্যায় তাদের সেই স্বপ্নও ধূলিসাৎ হয়ে গেল। তিন দফা বন্যায় এই এলাকার কৃষকের মাজা ভেঙে গেল।

বাঁধের ওপরে পরিবার নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন চকরামপুর গ্রামের বাসিন্দা লবির উদ্দিন।

তিনি বলেন, “দুই মাস আগের বানেত মাটির বাড়িটা ভেঙে যায়। ওই সময় ছল-পল নিয়ে রাস্তায় আশ্রয় নিয়েছিলাম। পানি নেমে যাওয়ার পর মানুষের কাছ থেকে বাঁশ-কাঠ চেয়ে নিয়ে ঘর তুলেছি। এবারের বানেত সেই ঘরেও পানি ঢুকে গেছে। পানির তোড়ত নতুন ঘরটাও ভেঙে যাবে যাবে অবস্থা।”

গত ২৪ ঘণ্টায় যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে আজ ছোট যমুনা পয়েন্টে ১৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন প্রকৌশলী আরিফুজ্জামান খান।

তিনি বলেন, আত্রাই নদীর পানি বুধবার সকাল ৯টায় মহাদেবপুর পয়েন্টে বিপৎসীমার ২৬ সেন্টিমিটার, ধামইরহাট উপজেলার শিমুলতলি পয়েন্টে ১মিটার ১৮ সেনিটমিটার, মান্দা উপজেলার জোতবাজার পয়েন্টে ৭৮ সেনিটটমিটার এবং আত্রাই উপজেলায় আত্রাই রেলওয়ে ষ্টেশন পয়েন্টে ৬৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়।

মান্দা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আব্দুল হালিম বলেন, “বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ। এখন পর্যন্ত সঠিক হিসাব না করা গেলেও ওই তিন ইউনিয়নের প্রায় পাঁচ হাজার পরিবারের প্রায় ২৫ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। তাদের সরকারি সহযোগিতা দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। জেলা প্রশাসন থেকে ইতোমধ্যেই ত্রাণ সহযোগিতা দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।”

আত্রাই উপজেলার ইউএনও ছানাউল ইসলাম বলেন, তার উপজেলার আটটি ইউনিয়নের মধ্যে সাতটিই বন্যাকবলিত হয়েছে।

“হাটকালুপাড়া, কালিকাপুর ও আহসানগঞ্জ ইউনিয়নের পরিস্থিতি খুবই ভয়াবহ। এই উপজেলার প্রায় ১৫ হাজার পরিবারের প্রায় ৬০ হাজার মানুষ সম্পূর্ণভাবে পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। ইতোমধ্যে প্রশাসনের ব্যবস্থাপনায় হাটকালুপাড়া ও কালিকাপুর রইউনিয়নে প্রায় পাঁচ শতাধিক পরিবারের মধ্যে চাল-ডাল-তেল-চিড়া-মুড়ি বিস্কুটসহ বিভিন্ন শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে।”

রানীনগর উপজেলার ইউএনও আল মামুন বলেন, ছোট যমুনা নদীর ভাঙা অংশ দিয়ে আসা পানিতে কৃষ্ণপুর, মালঞ্চি, নান্দাইবাড়িসহ সাতটি গ্রাম প্লাবিত হওয়ায় প্রায় পাঁচশ পরিবারের লোকজন পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন।

জুলাইয়ের মাঝামাঝি ভারি বর্ষণ ও উজান থেকে আসা পানিতে আত্রাই ও ছোট যমুনা নদীর পানি ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। ওই সময় পানির তোড়ে মান্দা ও আত্রাই উপজেলায় বেশ কয়েকটি স্থানে বাঁধ ভেঙে শতাধিক গ্রামের প্রায় দেড় লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়। তখন শত শত বিঘা জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ভেসে যায় শত শত পুকরের মাছ। অগাস্টের প্রথম সপ্তাহ থেকে পানি কমতে থাকলে বন্যাকবলিত মানুষের মধ্যে স্বস্তি দেখা দেয়। আবার দ্বিতীয় সপ্তাহের শেষের দিকে পানি বৃদ্ধি পেয়ে নতুন করে বেশ কিছু এলাকা প্লাবিত হয়। সেপ্টেম্বরের শুরুতেই নদীর পানি কমে এলে লোকালয় থেকেও পানি নামতে থাকে। এলাকার কৃষকরা আবার নতুন করে জমিতে রোপা আমনে চাষাবাদ শুরু করেন। সে সময় ভাঙা বাঁধ মেরামত শুরু হয়। তবে সম্পূর্ণ বাঁধ মেরামতের  আগেই তৃতীয় দফায় নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে ওই ভাঙা অংশ দিয়ে পানি ঢোকে।

গাইবান্ধা

জেলার  গোবিন্দগঞ্জের সাপমারা ইউনিয়নের চকরহিমাপুর এলাকায় করতোয়া নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাধ ভেঙে গেছে। পানি ঢুকে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দি হয়েছে উপজেলার প্রায় ২৫ হাজার মানুষ।

সরেজমিনে দেখা গেছে, উপজেলায় বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ নিমজ্জিত হয়েছে। ডুবে গেছে গোবিন্দগঞ্জ-দিনাজপুর ভায়া ঘোড়াঘাট আঞ্চলিক মহাসড়কের প্রায় তিন কিলোমিটার এলাকা। ডুবে যাওয়া এই মহাসড়ক দিয়ে বুধবার ঝুঁকি নিয়ে যান চলাচল করতে দেখা গেছে। বন্যার পানি ঢুকেছে গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা পরিষদ চত্বর ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে।

পলাশবাড়ী উপজেলার ইউএনও মো. কামরুজ্জামান বলেন, “সোমবার রাতে বাঁধ ধসে এ উপজেলায় ২৫ হাজার মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়েছে। সাধারণত এসব এলাকায় বন্যা হয় না। ফলে তারা এমন পরিস্থিতিতে অভ্যস্ত না। তাই এমন পরিস্থিতিতে সবাই নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ছোটাছুটি করছে। উপজেলা প্রশাসন তাদের সাধ্যমত সাহায্য করছে।”

বুধবার করতোয়া নদীর পানি বিপৎসীমার ৯৭ সেন্টিমিটার ও ঘাঘট নদীর পানি পাঁচ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয় বলে জানিয়েছেন গাইাবান্ধা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নিবার্হী প্রকৌশলী মো মোখলেছুর রহমান।

এদিকে ব্রহ্মপুত্র ও যমুনার পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলেও তিস্তার পানি কমতে শুরু করেছে বলে তিনি জানিয়েছেন।