বুধবার সকাল থেকে জজ আদালত চত্বরে মোতায়েন করা হয়েছে বিপুল সংখ্যক পুলিশ। আদালত পাড়ায় যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে।
বিচারপ্রার্থী ও আইনজীবীদের তল্লাশি করে আদালত চত্বরে প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে। জেলা ও দায়রা জজ মো. আছাদুজ্জামান সকাল সোয়া ৭টার দিকেই কড়া নিরাপত্তার মধ্যে আদালতে এসেছেন।
সকাল ৯টার আগে আগে রিফাতের স্ত্রী এ মামলার অন্যতম আসামি আয়শা সিদ্দিকা মিন্নি তার বাবা মোজাম্মেল হক কিশোরের মোটরসাইকেলে করে আদালতে উপস্থিত হন। মামলার আসামিদের মধ্যে কেবল তিনিই জামিনে আছেন।
মামলার বাদী রিফাতের বাবা আবদুল হালিম দুলাল শরীফসহ তার পরিবারের কয়েকজন সদস্যও রায়ের জন্য উপস্থিত হয়েছেন আদালতে।
মামলার ১ নম্বর আসামি রাকিবুল হাসান ওরফে রিফাত ফরাজীসহ কারাগারে থাকা আসামিদেরও আদালতে নিয়ে আসা হয়েছে। মামলার ১০ আসামির মধ্যে একজন পলাতক।
১৫ মাস আগে পুরো বাংলাদেশকে স্তম্ভিত করে দেওয়া ওই হত্যাকাণ্ডের পর পুলিশ যে ২৪ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দিয়েছিল, তাদের মধ্যে ১০ জনের বিচার চলে জজ আদালতে। বাকি ১৪ জন অপ্রাপ্তবয়স্ক হওয়ায় বরগুনার শিশু আদালতে আলাদাভাবে তাদের বিচার চলছে।
১৬ সেপ্টেম্বর যুক্ততর্ক শুনানি শেষে জেলা ও দায়রা জজ মো. আছাদুজ্জামান প্রাপ্তবয়স্ক দশ আসামির রায়ের জন্য ৩০ সেপ্টেম্বর দিন ঠিক করে দিয়েছিলেন।
মামলার আসামিরা হলেন- রাকিবুল হাসান ওরফে রিফাত ফরাজী (২৩) আল কাইয়ুম ওরফে রাব্বি আকন (২১), মোহাইমিনুল ইসলাম সিফাত (১৯), রেজোয়ান আলী খান হৃদয় ওরফে টিকটক হৃদয় (২২), হাসান (১৯), মুসা (২২), আয়শা সিদ্দিকা মিন্নি, রাফিউল ইসলাম রাব্বি (২০), সাগর (১৯) ও কামরুল হাসান সায়মুন (২১)।
এদের মধ্যে মুসা পলাতক, মিন্নি আছেন জামিনে। বাকিরা গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন।
মামলার বাদী রিফাতের বাবা আবদুল হালিম দুলাল শরীফ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মিন্নিসহ সব আসামির শাস্তি চাই আমরা। দেশের বিচার ব্যবস্থার ওপর আমাদের আস্থা আছে। আদালত রিফাতের খুনের সঙ্গে জড়িতদের এমন শাস্তি দিক যাতে আমরা স্বস্তি পাই।
“অপরাধ করে কেউ পার পাবে না। কেউ আইনের ঊর্ধ্বে না—এটাই প্রমাণ হোক। রাষ্ট্র বিচার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিয়ে দেশবাসীকে জানিয়ে দিক, অপরাধ করে কেউ বাঁচতে পারে না।”
সব আসামির ফাঁসি চেয়ে রিফাতের মা ডেইজি আক্তার বলেন, “আমি সব আসামির ফাঁসি চাই। এমন জঘন্য হত্যাকাণ্ড যেন আর না হয়। আমার মতো আর কোনো মায়ের বুক যেন খালি না হয়।”
অন্যদিকে রিফাতের স্ত্রী মিন্নিকে নির্দোষ দাবি করছে তার বাবা-মা। মিন্নির নাম এ মামলার এজাহারে ছিল এক নম্বর সাক্ষী হিসেবে। পুলিশের তদন্তের পর তাকে আসামি করা হয়।
মিন্নির বাবা মোজাম্মেল হোসেন কিশোর বলেন, “আমরা আসলেই হয়রানির শিকার। জীবন বাজি রেখে মিন্নি তার স্বামীকে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। অথচ মিন্নি প্রধান সাক্ষী থেকে এখন আসামির কাঠগড়ায়। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক। মিন্নি বেকসুর খালাস পাবে বলে আমরা আশা করি।”
একই প্রত্যাশা মিন্নির আইনজীবী মাহবুবুল বারী আসলামেরও। তিনি বলেন, “যে যুক্তি আমরা আদালতে উপস্থাপন করেছি, তা খণ্ডন করতে রাষ্ট্রপক্ষ ব্যর্থ হয়েছে। মিন্নি যে নির্দোষ এটা আদালতকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন আমাদের আইনজীবীরা। আইনের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, মিন্নি এ মামলা থেকে বেকসুর খালাস পাবেন।”
কী ঘটেছিল
গত বছর ২৬ জুন ভরদুপুরে বরগুনা জেলা শহরের কলেজ রোডে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করা হয় রিফাতকে। ওই ঘটনার একটি রোমহর্ষক ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়লে দেশজুড়ে শুরু হয় আলোচনা।
সেই ভিডিওতে দেখা যায়, দুই যুবক রামদা হাতে রিফাতকে একের পর এক আঘাত করে চলেছে। আর তার স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি স্বামীকে বাঁচানোর জন্য হামলাকারীদের ঠেকানোর চেষ্টা করছেন।
বরগুনার সরকারি কলেজের ডিগ্রি প্রথম বর্ষের ছাত্রী মিন্নি হামলাকারী সবাইকে চিনতে না পারার কথা জানালেও নয়ন বন্ড, রিফাত ফরাজী ও রিশান ফরাজীর নাম বলেন।
ওই ঘটনায় রিফাতের বাবা দুলাল শরীফ বাদী হয়ে ১২ জনকে আসামি করে বরগুনা থানায় হত্যা মামলা করেন। মামলায় রিফাতের স্ত্রী আয়শা সিদ্দিকা মিন্নিকে মামলায় ১ নম্বর সাক্ষী করা হয়।
রিফাত হত্যার ঘটনা বরগুনা শহরে ‘কিশোর গ্যাংয়ের’ দৌরাত্মের বিষয়টি প্রকাশ্যে আনে। এইসব কিশোর তরুণের পেছনে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার খবর গণমাধ্যমে এলে হত্যার কারণ নিয়ে নানামুখী আলোচনা চলতে থাকে।
এর মধ্যেই ২ জুলাই মামলার প্রধান সন্দেহভাজন সাব্বির আহম্মেদ ওরফে নয়ন বন্ড পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন।
এদিকে মিন্নির শ্বশুরই পরে হত্যাকাণ্ডে পুত্রবধূর জড়িত থাকার অভিযোগ তুললে আলোচনা নতুন মোড় নেয়। ১৬ জুলাই মিন্নিকে বরগুনার পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে ডেকে নিয়ে দিনভর জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। পরে সেদিন রাতে তাকে রিফাত হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়।
পরদিন আদালতে হাজির করা হলে বিচারক তাকে পাঁচদিনের রিমান্ডে পাঠান। পাঁচ দিনের রিমান্ডের তৃতীয় দিনেই মিন্নিকে আদালতে হাজির করা হয়। পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, ওই তরুণী হাকিমের কাছে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
হত্যাকাণ্ডের দুই মাসের মাথায় মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পরিদর্শক মো. হুমায়ুন কবির বরগুনার আদালতে মিন্নিসহ ২৪ জনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দাখিল করেন।
এজাহারের ১ নম্বর আসামি সাব্বির আহম্মেদ ওরফে নয়ন বন্ড পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ায় তার নাম অভিযোগপত্রে আসামির তালিকায় রাখা হয়নি।
দুই খণ্ডে বিভক্ত ওই অভিযোগপত্রের এক অংশে মোট ১০ জনকে আসামি করা হয়। অন্য অংশে রাখা হয় অপ্রাপ্তবয়স্ক ১৪ জনের নাম।
বরগুনার জেলা ও দায়রা জজ মো. আছাদুজ্জামান চলতি বছরের প্রথম দিন রিফাতের স্ত্রী মিন্নিসহ প্রাপ্তবয়স্ক ১০ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন।
সে অনুযায়ী ৮ জানুয়ারি শুরু হয় সাক্ষ্যগ্রহণ। ৭৬ জনের সাক্ষ্যগ্রহণের পর যুক্তিতর্ক শুনানি শেষে মামলাটি রায়ের পর্যায়ে আসে।
আর বরগুনার শিশু আদালতের বিচারক মো. হাফিজুর রহমান ৮ জানুয়ারি অপ্রাপ্তবয়স্ক ১৪ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন। সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয় ১৩ জানুয়ারি।