এ ঘটনায় এক দফা বনবিভাগের অফিস ভাঙচুরও ঘটেছে। ভীতির মধ্যে সময় কাটাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন বনবিভাগের কর্মীরা। আবার তারাই বলছেন, বেদখল জমি উদ্ধার অব্যাহত রাখবেন তারা।
বন বিভাগের দোখলা রেঞ্জের রেঞ্জ কর্মকর্তা আব্দুল আহাদ জানান, জেলার মধুপুর বনাঞ্চলের দোখলা রেঞ্জ অফিসের আওতাধীন বনভূমিতে জমির পরিমাণ ১৯ হাজার ৮৪৩ দশমিক ৯ একর।
তবে এর ১২ হাজার ৪১১ দশমিক ৬১ একর জমি তিন হাজার ৩৯১ জন প্রভাবশালী লোক জবরদখল করে রেখেছে। এরমধ্যে রাবার বাগান করতে ৫ হাজার ১৬৮ দশমিক ৬৮ একর জমি হস্তান্তর করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
বেদখল এসব জমি উদ্ধারের কর্মসূচি রয়েছে বনবিভাগের। এরই অংশ হিসেবে ওই কলাবাগান উচ্ছেদ করেছিলেন তারা।
সেই কলা বাগান উচ্ছেদের বিবরণ দিতে গিয়ে এ রেঞ্জ কর্মকর্তা বলেন, “১৪ সেপ্টেম্বর সকাল ৯টায় আমরা ওই জমি উদ্ধার করতে যাই। জমি উদ্ধারের অংশ হিসেবে কলাগাছ কেটে ফেলা হয়। এ সময় বাসন্তী গারো সম্প্রদায়ের লোকজন নিয়ে আমাদের ওপরে চড়াও হন।
“বাধা পেয়ে আমরা বাংলোয় চলে আসি। সেখানে এসে আমাদের অবরোধ করে রাখে তারা। এ সময় তারা আমার অফিস ও সরকারি বাসভবনে ভাঙচুর চালায়।
“আমরা এখন আতঙ্কে আছি।”
অন্যদিকে গারো নারী বাসন্তী রেমা বলছেন, বন বিভাগ ‘অন্যায়ভাবে’ তার ৪০ শতাংশ জমির পাঁচ শতাধিক কলা গাছ কেটে ফেলেছে।
১৪ সেপ্টেম্বর বাসন্তী রেমা সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, তারা কয়েক যুগ ধরে বংশ পরম্পরায় এ ভূমি ভোগ করে আসছেন। তার মা হেরনী রেমার ও তার নানি খিপ্রি রেমা এ জমি চাষাবাদ করতেন। কোনো কাগজপত্র না থাকলেও এ জমি তাদের বলেই জেনে এসেছেন।
কয়েক মাস আগে কলার চারা লাগানো কথা বলে তিনি বলেছিলেন, এখান থেকে ‘প্রায় আড়াই লাখ টাকার’ কলা বিক্রি করা যেতো। কিন্তু বন বিভাগ ‘কোনো নোটিশ ছাড়াই’ সেই গাছ কেটে ফেলায় বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়ছেন তিনি।
কেটে ফেলা কলাবাগানের ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে প্রতিবাদ ওঠে সবখানে। বাসন্তীকে ক্ষতিপূরণ এবং বন কর্মকর্তাদের বিচার চান প্রতিবাদকারীরা।
বাসন্তীর ইজারায় শহিদের কলাবাগান
সরেজমিনে দেখা গেছে, দোখলা বন বিভাগের রেঞ্জ অফিস এবং ডাক বাংলোর চারপাশে কলা, আনারস, পেঁপে, হলুদের মাঠ।
গত রোবাবার সকাল ৯টার দিকে বাসন্তীর পেগামারা গ্রামের বাড়িতে গেলে তাকে পাওয়া যায়নি। পরে বেলা ১১টার দিকে টাঙ্গাইল যাওয়ার পথে জলছত্রতে দেখা মেলে তার।
সে সময় তার কাছে শহিদ নামের স্থানীয় যুবকের কাছে সরকারি জমি ইজারা দিয়েছেন কিনা জানতে চাইলে কোনো কথা না বলে চুপ থাকেন বাসন্তী। তবে এক পর্যায়ে ক্যামেরার সামনে তিনি বলেন, আগেই বলেছেন এ কলাগাছ তিনিই লাগিয়েছেন।
এদিকে, মধুপুর এসআর অফিসের স্ট্যাম্প ভেন্ডার মো. ফরিদ আহম্মেদের স্বাক্ষরিত বিক্রি করা ওই ৫০ টাকার স্ট্যাম্পে চুক্তিপত্রে বলা হয়েছে, গত ২৯ এপ্রিল ২৫ হাজার টাকার বিনিময়ে ৪০ শতাংশ জমি মো. শহিদ আলীর কাছে ইজারা দেন বাসন্তী। ইজারার মেয়াদ ২০২০ সালের ১৫ মে থেকে ২০২৩ সালের ১৫ মে পর্যন্ত উল্লেখ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে শোলাকুড়ি ফকিরাকুলির গ্রামের শহিদ আলী বলেন, “আমি বাসন্তীর কাছ থেকে তিন বছরের জন্য জমিটি ইজারা নিয়েছি। এরপর এখানে কলাগাছ লাগিয়েছি।
“বন বিভাগের অভিযানে কলা গাছ কাটার সময় আমি সেখানে ছিলাম না। খবর পেয়ে এসে দেখি, আমার পাঁচশ গাছই কেটে ফেলা হয়েছে।”
রঞ্জিত বলেন, ২০১৩ সালে রবি খান নামের একজনের কাছে ৫০ হাজার টাকার বিনিময়ে সাত বছরের জন্য লিজ দিয়েছিল শুনেছি। তখন রবি খান এ জমিতে ঔষধি গাছ চাষ করেছিলেন।
তবে এরপর ওই জমি বাসন্তী কী করেছে, তার খবর জানেন না বলেন তিনি।
মধুপুর বনের জমি কার?
রাষ্ট্রীয় সম্পদ এ বন এলাকায় গারোদের বাস অনেক দিনের। দীর্ঘদিন ধরেই বন ও বনের আশপাশের উপর নির্ভরশীল এই ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর লোকজনের জীবিকা।
এরপর ১৯৬২ সালে গভীর শালবন হিসেবে পরিচিত ২০ হাজার ৮৩৭ একর বনভূমি নিয়ে মধুপুর জাতীয় উদ্যান ঘোষণা করে তৎকালীন সরকার বলেন তিনি।
অন্যদিকে এ অঞ্চলে গারোদের বসবাসেরও অতীত ইতিহাস পাওয়া যায়।
কবে থেকে গারোরা এখানে বাস করছে নিশ্চিত বলতে না পারলেও মধুপুর জয়েনশাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদের সভাপতি ইউজেন নকরেক বলেন, “মধুপুরের ভুটিয় এলাকায় ১৯১৫ সালে প্রতিষ্ঠিত প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে আন্দাজ করা যায় তার আগে থেকেই এখানে আদিবাসীদের বসবাস।”
গারোরা বলছেন, যুগ যুগ ধরে বনের জমিতে তারা বসবাস করে আসছেন। বংশ পরম্পরায় তারা এ জমিতে চাষাবাদ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। তবে গারো জনগোষ্ঠীর লোকেরা উত্তরাধিকার সূত্রে রেজিস্ট্রি দলিল ছাড়াই এ জমি দখল করে আসছেন।
কলাগাছ কাটাকে কেন্দ্র করে মধুপুরের গারোদের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে। স্থানীয় রেঞ্জ অফিসে হামলা, মোটরসাইকেল ভাঙচুর, মানববন্ধন ও সমাবেশ করেছে বাসিন্দারা।
“সরকারি জমি ভোগদখল করে যারা কলাবাগান করেছেন, তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি। পাশাপাশি বনের জমি রক্ষায় আমাদের নিয়মিত অভিযান চলবে।”
একটি মহল তাদের স্বার্থ হাসিল করতে গারোদের উত্তেজিত করে আন্দোলন করিয়ে ফায়দা লোটার চেষ্টা করছে বলে দাবি করছে স্থানীয় বন কর্তৃপক্ষ।
এতে ওই এলাকায় যে কোনো সময় বড় ধরনের সংঘাতের শঙ্কা করছেন স্থানীদের অনেকেই।
এ পরিস্থিতিতে মধুপুর কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক জয়নাল আবেদীন মনে করেন, খুব স্বল্প সময়ের মধ্যে গারো জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সরকারের দায়িত্বশীলরা বসে সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান খুঁজে বের করা দরকার।