জলাবদ্ধতায় আমনের চারা যোগাবে ভাসমান বীজতলা

বর্ষা এলেই জলাবদ্ধতা আর বন্যার কবলে পড়ে আমন বীজতলা নিমজ্জিতের দুশ্চিন্তায় থাকে কৃষক। পানিতে ডুবে বীজতলা নষ্ট হলে চারার অভাবে আমন আবাদে ঘাটতি পড়ে।

নীলফামারী প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 Sept 2020, 09:47 AM
Updated : 19 Sept 2020, 09:47 AM

এ সঙ্কট দূর করতে নতুন পন্থা নিয়ে এসেছে কৃষি বিভাগ। ডোবা, নালা আর পুকুরের জলের ওপর ভাসমান বীজতলার ধারণার পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছেন তারা।

নীলফামারী জেলা কৃষি বিভাগের পরীক্ষামূলক ভাসমান বীজতলার সফলতা দেখে আশার আলোয় বুক বাঁধছেন কৃষকরা।

কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, বীজতলা তৈরির পরীক্ষামূলক এ পদ্ধতি কৃষকদের মাঝে ছড়িয়ে পড়লে বন্যার দুর্যোগেও চারার অভাবে আমন আবাদের বিরূপ প্রভাব পড়বে না।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর নীলফামারীর অতিরিক্ত উপ-পরিচালক মাজেদুল ইসলাম বলেন,“আবহাওয়া যেভাবে পরিবর্তন হচ্ছে সে অনুযায়ী কৃষকদেরকে প্রশিক্ষিত করার জন্য প্রদর্শনী আকারে এবারে জেলায় ১০০টি ভাসমান বীজতলা তৈরি করা হয়েছে।

“পাশপাশি তিন একর জমিতে কমিউনিটি বীজতলায় আমন চারা তৈরি করা হয়েছে।”

এবারের বন্যায় আমন আবাদের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে আপদকালীন এসব বীজতলার চারা কৃষি প্রণোদণা কর্মসূচির আওতায় বিনামূল্যে কৃষকদের মাঝে বিতরণ চলছে বলেও জানান তিনি।

এ সহজ পদ্ধতির এই বীজতলা করায় কৃষকরা প্রশিক্ষিত হয়ে উঠলে আপদকালীন সময়ে তারাই উদ্যোগ নিয়ে করতে পারবেন বলে আশাবাদী তিনি।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের হিসাবে, এবার এ জেলার এক লাখ ১৩ হাজার হেক্টর জমিতে আমন আবাদের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে ছয় হাজার ৩৪৫ হেক্টর জমিতে বীজতলা তৈরি করা হয়। জেলা সদরে এক হাজার ৫৮০ হেক্টর, সৈয়দপুরে ৪৬০ হেক্টর, ডোমারে এক হাজার ৭৫ হেক্টর, ডিমলায় এক হাজার ৬২ হেক্টর, জলঢাকায় এক হাজার ৩০৮ হেক্টর এবং কিশোরগঞ্জ উপজেলায় ৮৬০ হেক্টর জমিতে এসব বীজতলা রয়েছে।

এবারের কয়েক দফা তিস্তার বন্যায় ডিমলা ও জলঢাকা উপজেলায় ৬০৭ হেক্টর ফসলি জমি পানিতে নিমজ্জিত হয়। এরমধ্যে ডিমলা উপজেলায় ৪৫০ হেক্টর আমনক্ষেত ও ১৫ হেক্টর বীজতলা, জলঢাকা উপজেলায় ৮৫ হেক্টর আমনক্ষেত ও ১৫ হেক্টর বীজতলা বন্যার পানিতে ডুবে যায়।

কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, এসব বন্যার স্থায়িত্ব কম হওয়ায় বীজতলাগুলোর তেমন ক্ষতি না হলেও ওই দুই উপজেলায় ১৬ দশমিক ৫ হেক্টর আমনক্ষেত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।ওই ক্ষতি পোষাতে তিন একর কমিউনিটি বীজতলা এবং ১০০টি ভাসমান বীজতলা তৈরি করা হয়েছে।

ভাসমান বীজতলাগুলোর ১০ মিটার দীর্ঘ এবং সোয়া মিটার চওড়া। বীজতলার প্রতিটি বেড তৈরিতে কৃষিবিভাগের খরচ হয়েছে এক হাজার ৩৬৫ টাকা বলেন উপ-পরিচালক মাজেদুল।

পরীক্ষামূলকভাবে এসব ভাসমান বীজতলা তৈরি করা হলেও এলাকার কৃষকদের মধ্যে বেশ সাড়া ফেলেছে জানিয়ে তিনি বলেন, এসব বীজতলার চারা কৃষকদের মাঝে বিলি করা হচ্ছে।

কৃষকরা বলছেন, এ পদ্ধত্তিতে পড়ে থাকা ডোবা, পুকুর ও জলাশয়ের পানিতে ভাসমান বীজতলা তৈরি করা গেলে জমির সর্বোচ্চ ব্যবহার হবে। বীজতলার জমি সাশ্রয়ের মধ্য দিয়ে ওই জমিতে অন্য ফসলে বাড়তি আয় করাও সম্ভব হবে বলে ভাবছেন তারা।

নীলফামারী সদরের পলাশবাড়ি ইউনিয়নের তরণীবাড়ি অচিনতলা গ্রামের কৃষক আব্দুল মান্নান (৫৫) বলেন,“আমার বাড়ির পাশের পতিত এক ডোবায় দুইটি বেডে ভাসমান আমন বীজতলা তৈরি করেছে কৃষি বিভাগ। সেটি তৈরিতে অংশগ্রহণের সুযোগ হয়েছে আমার।”

একটি কলার ভেলার উপর পলিথিন বিছিয়ে পুকুরের পলিমাটি তুলে এসব বীজনতলার বেডগুলো বানিয়েছেন তারা।

“পলিমাটির সঙ্গে প্রতিটি বেড়ে আড়াই কেজি পরিমাণ জৈব সার মেশানো হয়েছে। এরপর তাতে এক কেজি ধানের বীজ ছিটানো হয়।”

এই কাজ একজন ক্ষেতমজুরের এক দিনেই করা সম্ভব বলেন তিনি।

“জমিতে বীজতলা তৈরিতে চাষ এবং অন্যান্য প্রক্রিয়া শেষ করতে বেশ সময় লাগে। ভাসমান বীজতলায় সে সময় লাগে না।”

ওই গ্রামের কৃষক সফিকুল ইসলাম (৪৫) জানান, জমিতে বীজতলা করে অনেক সময় অতিবৃষ্টি এবং বন্যার পানিতে ডুবে নষ্ট হয়। ভাসমান বীজতলা পানিতে ডুবে নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা একেবারেই নেই।

“অনেক সময় গরু-ছাগলে জমির বীজতলা নষ্ট করার সম্ভাবনা থাকলেও এখানে সে সম্ভাবনা কম। এতে একদিকে যেমন পতিত পুকুর, ডোবার ব্যবহার হচ্ছে, অপরদিকে বীজতলার ওই জমিতে এ সময়টায় অন্য ফসল ফলানো যাবে।”

প্রচুর পুকুর, ডোবা এবং জলাশয় অব্যবহৃত থাকে জানিয়ে ওই গ্রামের কৃষক আল আমীন (২৩) বলেন,“এসবের কোনো ধরণের ক্ষতি না করেই ভাসমান বীজতলা তৈরির ধারণা এবারই প্রথম পেলাম।”

ব্যাপকভাব এই পদ্ধতিতে বীজতলা করা গেলে তাদের উপকারই হবে মনে করছেন তিনিও।

সদর উপজেলা কৃষি বিভাগের পলাশবাড়ি ইউনিয়নের তরুণীবাড়ী ব্লকের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা পার্থ প্রতীম রায় জানান, অতিবৃষ্টি এবং বন্যার কারণে এবার পরীক্ষামূলকভাবে আপদকালীন হিসেবে এসব ভাসমান বীজতলা তৈরি করা হয়েছে।

এসব বীজতলা কৃষকদের মাঝে বেশ সাড়া ফেলেছে জানিয়ে বীজতলা তৈরির উপকরণের প্রসেঙ্গ তিনি বলেন, “ভাসমান বীজতলা তৈরিতে যেসব উপকরণ প্রয়োজন তা গ্রামের কৃষকদের কাছে খুবই সহজলভ্য।

“গ্রামের প্রত্যেক কৃষকের বাড়িতে কলাগাছ আছে। পরিত্যক্ত কলাগাছ ব্যবহার করে ভেলা তৈরিসহ বীজতলার বেড তৈরির উপকরণ সংগ্রহ একজন কৃষকের পক্ষে খুবই সহজ।”

শুধু আমন চারা তৈরিই নয় ওই চারা তোলার পর ওই বেডে শাকসবজি আবাদ করা সম্ভবনাও বাতলান তিনি।

পুকুরে ভাসমান বীজতলা কি মাছের ক্ষতি করবে?

কৃষি কর্মকর্তা পার্থ প্রতীম রায় বলছেন, এটির ব্যাপকতা বাড়লে মাছের ক্ষতি না করে পতিত জলাশয়, পুকুর-ডোবার ব্যবহার নিশ্চিত হবে।

জেলার মৎস্য দপ্তরের হিসাবে নীলফামারীতে ২৯ হাজার ৭২৭টি পুকুর ও জলাশয় আছে। এসবের মধ্যে সরকারি ১৫৩টি এবং বেসরকারি ২৯ হাজার ৫৭৪টি। এসব পুকুর-জলাশয়ের মোট আয়তন তিন হাজার ৯৪৭ দশমিক ৯৫ হেক্টর। এর মধ্যে সরকারি পুকুরের আয়তন ১২২ হেক্টর এবং বেসরকারি পুকুরের আয়তন তিন হাজার ৮২৫ দশমিক ৯৫ হেক্টর।

জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. আশরাফুজ্জামান বলেন,“একটি পুকুরের ১০ ভাগের এক ভাগ অংশ ব্যবহার করে ভাসমান বীজতলা তৈরি করা হলে মাছ চাষের কোনো ক্ষতি হবে না।

“বরং সেটি মাছের শেলটার হিসেবে কাজ করবে।”

তবে গোটা পুকুর জুড়ে ভাসমান বীজতলা করা হলে সূর্যের আলো পুকুরের পানিতে প্রবেশে  বাধা পাবে। তখন ‘মাছের ক্ষতি করবে।’

পলিথিন সামলাবে কে?

এদিকে, বীজতলার বেডে ব্যবহৃত পলিথিন পরে কৃষি জমিতে মিশে জমির ক্ষতি করার শঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।

পলিথিন পরিবেশ বান্ধব নয় স্বীকার করে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ কার্যালয়ের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মহসীন রেজা রূপম বলেন, “পলিথিন ছাড়া এই ভাসমান বীজতলার বেড প্রস্তুত করা সম্ভব নয়। কচুরিপানা, মাটিসহ অন্যান্য উপকরণকে ধরে রাখার জন্য ওই পলিথিন প্রয়োজন।”

শুধুমাত্র আবদকালীন সময়ের ভাসমান বীজতলার জন্য এ পলিথিন ব্যবহার করবে কৃষক। ব্যবহারের পর সেসব যথাযথভাবে ধ্বংস করা হবে বলেও জানান তিনি।

“ভাসমান বীজতলা বাধ্যতামূলক নয়। কৃষকরা যাতে বীজের অভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেজন্য আপৎকালীন সময়ে ভাসমান বীজতলা তৈরিতে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। যাতে কৃষকরা বন্যাসহ যেকোনো দুর্যোগে বীজতলা তৈরি করে তাদের প্রয়োজন মেটাতে পারে” যোগ করেন তিনি।