রোহিঙ্গা শিবিরে দোয়া, যা বললেন ‘কাশেম রাজার ছেলে’

রোহিঙ্গা শিবিরে তাকে প্রধানমন্ত্রী বানাতে দোয়া মাহফিলের সঙ্গে নিজের সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করেছেন কক্সবাজার আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি শাহ আলম চৌধুরী।

কক্সবাজার প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 Sept 2020, 07:41 PM
Updated : 16 Sept 2020, 07:50 PM

তিনি বলেছেন, উখিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির আহ্বায়ক হওয়ায় তার প্রতিপক্ষ ‘ষড়যন্ত্রমূলকভাবে’ এই কাজ করেছে।

সম্প্রতি সোশাল মিডিয়ায় একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে। তাতে শাহ আলমকে মিয়ানমারের ‘কাশেম রাজার ছেলে’ উল্লেখ করে তাকে প্রধানমন্ত্রী পদে দেখতে চেয়ে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরের মসজিদে কয়েকজনকে মিলে দোয়া করতে দেখা যায়।

এ ঘটনায় স্থানীয় আওয়ামী লীগের কিছু নেতা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তবে তারা কেউ শাহ আলমকে রোহিঙ্গা বা মিয়ানমারের বংশোদ্ভূত বলে দাবি করেননি।

শাহ আলম বলছেন, তার বাবার জন্ম কক্সবাজারের উখিয়ায়। কক্সবাজারে তার পারিবারিক ভূ-সম্পত্তি ও বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয়পত্র রয়েছে।

তবে উখিয়ার সোনারপাড়ায় লোকজন জানিয়েছেন, শাহ আলমের পরিবার মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসেছিল। শাহ আলমের বাবা নেতা হিসেবে রোহিঙ্গাদের মধ্যে ‘রাজা’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিলেন।

কক্সবাজার পৌরসভার ১২ নম্বর ওয়ার্ডে সার্কিট হাউজ এলাকায় শাহ আলমের ১২ তলা বাড়ি রয়েছে। তিনি সেখানে থাকেন।

ভিডিও চিত্রে দেখা গেছে, “মসজিদের ভেতরে ১০-১২ জন লোক মোনাজাতে অংশ নিয়ে বলছেন, ‘পালংখালীর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বড় এক নেতা এ খতমে কোরআনের আয়োজন করেছেন বার্মার (মিয়ানমার) কাশেম রাজার ছেলে রাজা শাহ আলমের জন্য। তিনি (শাহ আলম) উখিয়া উপজেলার (আওয়ামী লীগের) সম্মেলনের নেতা হওয়ায় শোকরিয়া আদায়ের জন্য। তাকে আওয়ামী লীগের বড় নেতা বানানোর জন্য। ভবিষ্যতে তাকে (শাহ আলম) আরও বড় নেতা বানিয়ে যেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী পদে দেখতে পাই। ইসলামের দ্বীন প্রতিষ্ঠা এবং রোহিঙ্গাদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় রাজা শাহ আলম যাতে আরও বড় নেতায় পরিণত হন।”

সোমবার উখিয়ার পালংখালীর একটি রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরের মসজিদে এই দোয়া মাহফিল হয় বলে স্থানীয়দের কাছে খবর পাওয়া গেছে।

গত ৯ সেপ্টেম্বর উখিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটি ঘোষণা করে জেলা আওয়ামী লীগ। তাতে শাহ আলমকে আহ্বায়ক করা হয়।

শাহ আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ওই দোয়া মাহফিল আয়োজনের বিষয়ে কিছু তার জানা নেই।

“আমার বাবার জন্ম এখানে। আমি রোহিঙ্গা বংশোদ্ভূত না। এটি আমার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের অপপ্রচার। মূলত বিভ্রান্তি ছড়িয়ে ফায়দা হাসিলের জন্য প্রতিপক্ষের ষড়যন্ত্রের অংশ এটা।”

কাশেম রাজা

তিনি বলেন, “যদি মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নাগরিকই হয়ে থাকেন আমার বাবা তাহলে পাকিস্তান আমলে কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, ফেনী ও ঢাকায় কিভাবে ভূ-সম্পত্তির মালিক হয়েছেন। চট্টগ্রামে বাড়ি ও হোটেলের মালিক হয়েছেন? তাছাড়া বাংলাদেশ স্বাধীনের পর তিনি কিভাবে ব্যবসা করার লাইসেন্স ও ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলেছেন? কক্সবাজারে পর্যটন এলাকায় সরকার হোটেল করার অনুমোদন দিয়েছে কিভাবে?”

শাহ আলম বলেন, ১৯৯৩ সালে আওয়ামী লীগের জেলা কমিটির সদস্য হন তিনি। জেলা কমিটির কোষাধ্যক্ষ্যের দায়িত্বের পর এখন সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন।

দোয়া মাহফিল আয়োজনের বিষয়ে উখিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির চৌধুরীও অভ্যন্তরীণ কোন্দলের সন্দেহ প্রকাশ করেন।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গত উপজেলা পরিষদ নির্বাচন ঘিরে দলের মধ্যে দ্বন্দ্ব-কলহ চলছে। হামিদুল হক চৌধুরী নির্বাচনে অংশ নিলে আওয়ামী লীগ নেতা মাহমুদুল হক চৌধুরীকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব দেওয়া হয়। এ নিয়ে দলের মধ্যে বিভাজন চলছে।

“এর পরিপ্রেক্ষিতে জেলা কমিটি দলের সম্মেলন অনুষ্ঠানের জন্য উপজেলা সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটি ঘোষণা করে। এই কমিটিতে শাহ আলমকে আহ্বায়ক করা হয়েছে। এ নিয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে তার (শাহ আলম) প্রতিপক্ষের কেউ রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করে দোয়া মাহফিলের আয়োজন করেছে কিনা তা খতিয়ে দেখে সত্য উদঘাটন করা জরুরি।”

জাহাঙ্গীর চৌধুরীর বক্তব্য সমর্থন করেছেন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সিরাজুল মোস্তফা।

তিনি বলেন, “দোয়া মাহফিল আয়োজনের বিষয়টি রোহিঙ্গারা স্ব-উদ্যোগেই করেছেন নাকি শাহ আলমের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের কারও ইন্ধনে হয়েছে, তার খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। শাহ আলম যদি রোহিঙ্গা নাগরিক হয়ে থাকেন তাহলে দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে তিনি কিভাবে বৈধ ব্যবসা-বাণিজ্যের পাশাপাশি সহায়-সম্পদের মালিক হয়েছেন?”

শাহ আলম দীর্ঘ সময় ধরে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ে নেতৃত্ব দেওয়ার পাশাপাশি জেলা কমিটির সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন বলে তিনি স্মরণ করিয়ে দেন।

এছাড়া শাহ আলম যদি রোহিঙ্গা নাগরিক হয়ে থাকেন তার দায়দায়িত্ব শুধু বর্তমান কমিটির নয় বলে তিনি মন্তব্য করেন।

এদিকে এই ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়েছেন উখিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান হামিদুল হক চৌধুরী।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “শাহ আলমের জন্য রোহিঙ্গাদের দোয়া মাহফিলের আয়োজনের বিষয়টি দেশের স্থিতিশীলতা ও সার্বভৌমত্বের জন্য উদ্বেগজনক। এটি দেশের স্বার্থবিরোধী কোনো ষড়যন্ত্রের অংশ কিনা তা সংশ্লিষ্টদের খতিয়ে দেখা উচিত।”

কমিটি গঠন নিয়ে হামিদুল বলেন, “জেলা আওয়ামী লীগ সম্পূর্ণ অগঠনতান্ত্রিকভাবে সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটি গঠন করেছে। এ নিয়ে উপজেলা আওয়ামী লীগের কমিটির দায়িত্বশীল নেতা হিসেবে আমার কোনো মতামতও জেলা কমিটি গ্রহণ করেনি। ইতোমধ্যে বিষয়টি আমি কেন্দ্রীয় কমিটিকে অবহিত করেছি।

যা বলছেন স্থানীয়রা

উখিয়ার জালিয়াপালং ইউনিয়নের সোনারপাড়ার বাসিন্দা জাকের হোসাইন (৮৫) বলেন, “রোহিঙ্গাদের নেতা আবুল কাশেম ওরফে কাশেম রাজা পাকিস্তান আমলে ১৯৫৬ সালে মিয়ানমারের আরাকান রাজ্য থেকে পালিয়ে উখিয়ার সোনারপাড়ায় পরিবারসহ আশ্রয় নেন। তিনি এখানে অবস্থান করে মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠীর নেতৃত্ব দিতেন।

“সে সময় কাশেম রাজা মাঝেমধ্যে রোহিঙ্গা বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে মিয়ানমারে সশস্ত্র অভিযানে অংশ নিতেন। মিয়ানমার সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র নেতৃত্ব দেওয়ার কারণে তিনি রোহিঙ্গাদের মাঝে ‘কাশেম রাজা’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তাছাড়া উখিয়াসহ কক্সবাজারের স্থানীয়রাও তাকে ‘কাশেম রাজা’ নামে চেনেন।”

তিনি বলেন, “১৯৬৭ সালে উখিয়ার সোনারপাড়ায় স্থানীয়দের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে প্রতিপক্ষের গুলিতে কাশেম রাজা নিহত হন।”

কাশেমের পারিবারিক পরিচয় দিতে গিয়ে তিনি বলেন, “কাশেম রাজার দুই স্ত্রী ছিলেন। তাদের মধ্যে প্রথম স্ত্রী রোহিঙ্গা নাগরিক এবং দ্বিতীয় স্ত্রী কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার বাসিন্দা। কাশেম রাজার পাঁচ সন্তানের মধ্যে তিন ছেলে ও দুই মেয়ে রয়েছে। শাহ আলম দ্বিতীয় স্ত্রীর সন্তান।”

এলাকাবাসী আরও বলেন, কাশেম ব্রিটিশ শাসন অবসানের পর মিয়ানমারে রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীর অধিকার আদায়ে গড়ে ওঠা সশস্ত্র বিদ্রোহীদের প্রথম দিকের নেতা ছিলেন। তার নেতৃত্বে রোহিঙ্গারা স্বাধীন আরাকানের স্বপ্ন দেখত। সাহসী ভূমিকার কারণে কাশেম রাজা হিসেবে পরিচিতির পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের অনেকের মাঝে তিনি এখনও অনুপ্রেরণার অংশ।

শাহ আলম ২০০৭ সালে সেনানিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে পারেননি। ২০১০ সালে উচ্চ আদালতে রিট আবেদন করে তিনি ঢাকার ডেমরা থানার একটি এলাকার ঠিকানায় ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হন। পরের কক্সবাজারে স্থানান্তর করেন।