দেশের চাহিদা মিটিয়ে পেঁয়াজ রপ্তানির উপায়ও দেখালেন কৃষিবিজ্ঞানী

এক ভারত রপ্তানি বন্ধ করে দেওয়ায় দেশে পেঁয়াজের বাজারে অস্থিরতার মধ্যে দেশের একমাত্র মসলা গবেষণা কেন্দ্রের মুখ্য বিজ্ঞানী বললেন, সঠিক পরিকল্পনা নিয়ে এগোলে অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে পেঁয়াজ রপ্তানিও সম্ভব।

জিয়া শাহীন বগুড়া প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 Sept 2020, 05:26 PM
Updated : 16 Sept 2020, 06:21 PM

দেশে রান্নায় অপরিহার্য উপকরণ হিসেবে ব্যবহার হয় পেঁয়াজ। গত সোমবার ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধের ঘোষণা দিলে বাংলাদেশে চড়তে থাকে এই নিত্যপণ্যের দাম।

গত বছরও এমনটা হয়েছিল। এবারও দুদিনই বাজারে দাম দ্বিগুণ বেড়ে যাওয়ায় সরকারি বিভিন্ন সংস্থা মাঠে নেমেছে, অন্য দেশ থেকে আমদানির তৎপরতাও শুরু হয়েছে।

পেঁয়াজ নিয়ে তুমুল আলোচনার মধ্যে বুধবার বগুড়া শহর থেকে প্রায় ১৮ কিলোমিটার উত্তরে শিবগঞ্জ উপজেলার রায়নগর ইউনিয়নে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের মসলা গবেষণা কেন্দ্রের কৃষিবিজ্ঞানী ড. হামিম রেজার সঙ্গে কথা হয় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের।

গ্রীষ্মকালীন উচ্চ ফলনশীল বারি-৫ জাতের পেঁয়াজের জাত উদ্ভাবক এ প্রতিষ্ঠানের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা দেশে পেঁয়াজের চাষ, চাহিদা, উৎপাদন বাড়ানোর নানা দিক নিয়ে কথা বলেন তিনি।

সরকারের তরফে বলা হয়ে থাকে বাংলাদেশে পেঁয়াজের বার্ষিক চাহিদা ৩০ লাখ টনের মতো। এর মধ্যে দেশে উৎপাদন হয় ১৮ লাখ টনের মতো। চাহিদার বাকিটা মেটাতে ৫০০-৬০০ কোটি টাকার পেঁয়াজ আমদানি করতে হয়, যা মূলত আসে ভারত থেকে।

গত বছর ভারতে রপ্তানি বন্ধ করে দিলে ৩০ টাকা কেজির পেঁয়াজ ৩০০ টাকা পর্যন্ত উঠেছিল। পরে চীন, পাকিস্তান, তুরস্ক, মিয়ানমার থেকে আমদানি করতে হয়েছিল।

বাংলাদেশে পেঁয়াজ উৎপাদনের হিসাবে গড়বড় দেখছেন ড. হামিম।

২০২০ সালের কৃষি তথ্যর কৃষি ডায়েরিতে দেশে দুই লাখ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ আবাদের তথ্য তুলে ধরে তিনি বলেন, “যদি তাই হয়, তাহলে গড়ে হেক্টর প্রতি ২০ মেট্রিক টন হিসাবে দেশে ৪০ লাখ মেট্রিক টন পেঁয়াজ উৎপাদন হয়। এছাড়া বাড়ির আঙিনার হিসাবও রয়েছে।”

উৎপাদিত পেঁয়াজের ৩৫ শতাংশ নষ্ট হওয়ার পরও কৃষি বিভাগের হিসাব ঠিক হলে চাহিদার চেয়ে বেশি পেঁয়াজ উৎপাদন হওয়ার কথা বলে মনে করেন তিনি।

কৃষি বিভাগের এক তথ্য বলছে, জলবায়ুর পরিবর্তন, বৈরী আবহাওয়া, মানসম্পন্ন বীজ না পাওয়া এবং বিভিন্ন রোগ ও পোকার আক্রমণ ইত্যাদির কারণে বাংলাদেশে পেঁয়াজের গড় ফলন (৯.৭৩ টন/হেক্টর) বিশ্বব্যাপী গড় ফলন (১৭.২৭ টন/হেক্টর) অপেক্ষা কম।

ড. হামিম রেজা বলছেন, বর্তমানে দেশে বার্ষিক ৩০ লাখ মেট্রিক টন পেঁয়াজের চাহিদা রয়েছে। সেখানে দেশে উৎপাদন হচ্ছে ২৩ লাখ মেট্রিক টন।

এই ঘাটতি দেশেই মেটানো সম্ভব বলে দাবি করছেন তিনি।

কীভাবে- উত্তরে তিনি বলেন, প্রচলিত শীতকালীন পেঁয়াজের পাশাপাশি উচ্চ ফলনশীল গ্রীষ্মকালীন বারি-৫ জাতের পেঁয়াজ চাষের মাধ্যমে।

অগাস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে বারি-৫ জাতের পেঁয়াজের বীজ বপন করা হয়। নভেম্বরে চারা লাগানো হয়। ওই সময় আগাম সবজি, আখসহ অন্যান্য ফসল লাগানো হয়।

সে সময় পরিকল্পনা অনুযায়ী এ জাতের পেঁয়াজ চাষ করলে ওই সব ফসলের উৎপাদনেও বিরূপ প্রভাব পড়বে না মনে করেন ড. হামিম।

“বরং ওই ফসলের চেয়ে বেশি লাভজনক হবে পেঁয়াজ চাষ।”

তিনি বলেন, স্থানীয় জাতের দেশি শীতকালীন পেঁয়াজ যেখানে প্রতি হেক্টরে ১০ থেকে ১২ মেট্রিক টন উৎপাদন হয়, সেখানে বারি-৫ হেক্টর প্রতি ১৮ থেকে ২২ টন উৎপাদন হয়।

ড. হামিম বলেন, জমিতে লাগানো সাথী ফসল আদা, হলুদ, আখ, মরিচের সঙ্গেও বারি-৫ পেঁয়াজ চাষ করা যায়।

তিনি জানান, গত দুই বছর ধরে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ উৎপাদনের চাহিদা বাড়ছে। সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসহ অনেকেই গ্রীষ্মকালীন বারি-৫ জাতের বীজ নিয়ে চাষ করছে। দেশের এটাই সবচেয়ে বেশি ফলনশীল পেঁয়াজ।

বারি-৫ পেঁয়াজ শীত ও গ্রীষ্ম উভয় ঋতুতে উৎপাদন করা যায়।

বারি-৫ পেঁয়াজের পাশাপাশি শীতকালীন বারি-৪ ও ৬ জাতের পেঁয়াজ চাষে গুরুত্ব দিয়ে ড. হামিম বলেন, “সরকার সঠিক পরিকল্পনা অনুযায়ী এসব পেঁয়াজ দেশব্যাপী ছড়িয়ে দিলে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে পেঁয়াজের ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব।

“এতে দেশের মানুষ কম দামে খাবে এবং টাকা দিয়ে বিদেশ থেকে আমদানিও করতে হবে না।”

গত শতাব্দীর শেষ দশকের মাঝামাঝি ঐতিহাসিক মহাস্থানগড়ের কাছে শিবগঞ্জের বিশাল এলাকা নিয়ে প্রতিষ্ঠা করা হয় মসলা গবেষণা কেন্দ্র। বিভিন্ন জেলায় এ কেন্দ্রের কয়েকটি আঞ্চলিক ও উপকেন্দ্র রয়েছে।

এ কেন্দ্রের গবেষণার আওতায় উদ্যানতত্ত্ব, কীটতত্ত্ব, উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব, মৃত্তিকা বিজ্ঞান, উদ্ভিদ প্রজনন, ফিজিওলজি, বায়োটেকনোলজি, কৃষি প্রকৌশল ও কৃষি অর্থনীতি রয়েছে।

বিভিন্ন ফসলের ফিজিওলজি, ব্রিডিং পদ্ধতি, জৈব প্রযুক্তি, উদ্ভিদ পুষ্টি, সেচ, আন্তঃপরিচর্যা, বীজ উৎপাদন, রোগ ও পোকামাকড় দমন, শস্য সংগ্রহের পর ব্যবস্থাপনা ও বাজার পদ্ধতিসহ নানা বিষয় নিয়ে গবেষণা করেন তারা।

বুধবার সরেজমিনে মসলা গবেষণা কেন্দ্রে দেখা যায়, অন্যান্য মসলার চারার পাশাপাশি বারি-৫ পেঁয়াজের বীজতলা রক্ষণাবেক্ষণ চলছে। বাড়ন্ত চারা পলিথিন শেড দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে। আলাদা একটি ছাউনিতে বীজ সংরক্ষণ করা হয়েছে।