রিফাত শরীফ হত্যা: স্ত্রী মিন্নিসহ দশ আসামির ভাগ্য নির্ধারণ বুধবার

বরগুনার আলোচিত রিফাত শরীফ হত্যা মামলায় তার স্ত্রী আয়শা সিদ্দিকা মিন্নিসহ প্রাপ্তবয়স্ক ১০ আসামির সাজা হবে কি না- সেই সিদ্ধান্ত জানা যাবে বুধবার।

বরগুনা প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 Sept 2020, 07:50 AM
Updated : 29 Sept 2020, 08:00 PM

বরগুনার জেলা ও দায়রা জজ মো. আছাদুজ্জামান এ মামলার রায় ঘোষণা করবেন। দুই পক্ষের যুক্তিতর্ক শুনানি শেষে গত ১৬ সেপ্টেম্বর তিনি রায়ের জন্য ৩০ সেপ্টেম্বর দিন ঠিক করে দেন।

১৫ মাস আগে পুরো বাংলাদেশকে স্তম্ভিত করে দেওয়া ওই হত্যাকাণ্ডের পর পুলিশ যে ২৪ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দিয়েছিল, তাদের মধ্যে ১০ জনের বিচার চলে জজ আদালতে।

বাকি ১৪ জন অপ্রাপ্তবয়স্ক হওয়ায় বরগুনার শিশু আদালতে আলাদাভাবে তাদের বিচার চলছে। 

এ মামলার ১ নম্বর আসামি রাকিবুল হাসান ওরফে রিফাত ফরাজী (২৩) বরগুনা জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেনের ভায়রার ছেলে। আর নিহত রিফাতের স্ত্রী মিন্নি (১৯) অভিযোগপত্রের ৭ নম্বর আসামি, যার নাম এ মামলার এজাহারে ছিল এক নম্বর সাক্ষী হিসেবে।

প্রাপ্তবয়স্ক বাকি আট আসামি হলেন- আল কাইয়ুম ওরফে রাব্বি আকন (২১), মোহাইমিনুল ইসলাম সিফাত (১৯), রেজোয়ান আলী খান হৃদয় ওরফে টিকটক হৃদয় (২২), হাসান (১৯), মুসা (২২), রাফিউল ইসলাম রাব্বি (২০), সাগর (১৯) ও কামরুল হাসান সায়মুন (২১)।

এদের মধ্যে মুসা পলাতক, মিন্নি আছেন জামিনে। বাকিরা গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন।

 

রাষ্ট্রপক্ষে ৭৬ জনের সাক্ষ্যগ্রহণের পর এই রায় হচ্ছে।

অল্প সময়ে বিচারিক কার্যক্রম শেষ করায় সন্তোষ প্রকাশের পাশাপাশি রায়ে আসামিদের দৃষ্টান্তমূলক সাজা হবে বলে আশা করছেন নিহত রিফাতের বাবা দুলাল শরীফ।

সাক্ষী থেকে আসামি হয়ে যাওয়া আয়শা সিদ্দিকা মিন্নির বাবা মোজাম্মেল হোসেন কিশোরও ন্যায্যবিচার প্রত্যাশা করছেন। তিনি এখনও বলছেন, তার মেয়েকে এই মামলায় ষড়যন্ত্রমূলকভাবে ফাঁসানো হয়েছে। 

রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী পাবলিক প্রসিকিউটর ভুবন চন্দ্র হাওলাদার বলেছেন, তারা প্রাপ্তবয়স্ক ১০ আসামির বিরুদ্ধে সাক্ষ্য, নানা তথ্য ও উপাত্ত দিয়ে আদালতকে সন্তুষ্ট করতে পেরেছেন। তাই তারা আশা করছেন, আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তিই হবে।

মিন্নির পক্ষের আইনজীবী মাহবুবুল বারী আসলাম বলেছেন, তারা যে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেছেন, তাতে মিন্নি বেকসুর খালাস পাবেন বলে তারা আশাবাদী।

নিহত রিফাত শরীফ

যুক্তিতর্ক

এ মামলার যুক্তিতর্ক শুনানিতে মিন্নিকে নির্দোষ দাবী করে আটটি যুক্তি দেন তার আইনজীবী মাহবুবুল বারী আসলাম ও ফারুক আহম্মেদ।

তারা দাবি করেন, হামলার পর গুরুতর আহত রিফাত শরীফ একা একা হাসপাতালে গিয়েছিলেন বলে তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হলেও বাস্তবে মিন্নি নিজেই রিফাতকে হাসপাতালে নিয়ে যান।

শুনানিতে মিন্নির আইনজীবী বলেন, রিফাতের ওপর হামলার সময় রাম দা হাতে হামলাকারী নয়ন বন্ডকে জাপটে ধরে রিফাতকে বাঁচানোর জন্য মিন্নি আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন। এ মামলার ১৩ জন সাক্ষী প্রত্যেকেই সে কথা বলেছেন।

তদন্ত প্রতিবেদনে হত্যাকাণ্ডের আগের দিন মিন্নির উপস্থিতিতে বরগুনা সরকারি কলেজ মাঠে হত্যা পরিকল্পনার বৈঠকের কথা বলা হয়েছে। ওই এলাকা সিসি ক্যামেরার আওতায় থাকার পরও সেই বৈঠকের কোনো ভিডিও পুলিশ দেয়নি, সে বিষয়টি বিচারকের কাছে তুলে ধরেন মিন্নির আইনজীবী।

তারা বলেন, পুলিশ মিন্নির ওপর ‘নির্যাতন চালিয়ে’ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি আদায় করেছিল।

মামলার তদন্ত প্রতিবেদনে নয়ন বন্ডের বাসা থেকে মিন্নির ব্যবহৃত কিছু জিনিসপত্র উদ্ধারের কথা বলা হলেও সেগুলোর কোনো ফরেনসিক প্রতিবেদন নেই বলে যুক্তি দেন আইনজীবীরা।

তারা বলেন, মামলা হওয়ার পর মিন্নির বাবার বাসা থেকে রিফাতের রক্তমাখা মিন্নির জামাকাপড় উদ্ধার করা হলেও তদন্ত প্রতিবেদনে তা উল্লেখ করা হয়নি।

যুক্তি-তর্কের শেষ দিন এসব যুক্তি খণ্ডন করে পাল্টা যুক্তি দেন বাদী পক্ষের আইনজীবী এম মুজিবুল হক কিসলু।

তিনি বলেন, রিফাতকে হত্যা করা হয়েছে ‘মিন্নির পরিকল্পনায়’, সে জন্য তার ‘সর্বোচ্চ শাস্তি’ হওয়া উচিৎ।

এদিন বাদীপক্ষ মিন্নির জামিন বাতিলের জন্য আবেদন করলেও শুনাশি শেষে বিচারক আইনজীবীর জিম্মায় জামিন বহাল রাখেন।

রিফাতের উপর হামলার চিত্র

কী ঘটেছিল?

গত বছর ২৬ জুন ভরদুপুরে বরগুনা জেলা শহরের কলেজ রোডে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করা হয় রিফাতকে। ওই ঘটনার একটি রোমহর্ষক ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়লে দেশজুড়ে শুরু হয় আলোচনা।

সেই ভিডিওতে দেখা যায়, দুই যুবক রামদা হাতে রিফাতকে একের পর এক আঘাত করে চলেছে। আর তার স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি স্বামীকে বাঁচানোর জন্য হামলাকারীদের ঠেকানোর চেষ্টা করছেন।

বরগুনার সরকারি কলেজের ডিগ্রি প্রথম বর্ষের ছাত্রী মিন্নি হামলাকারী সবাইকে চিনতে না পারার কথা জানালেও নয়ন বন্ড, রিফাত ফরাজী ও রিশান ফরাজীর নাম বলেন।

ওই ঘটনায় রিফাতের বাবা দুলাল শরীফ বাদী হয়ে ১২ জনকে আসামি করে বরগুনা থানায় হত্যা মামলা করেন। মামলায় রিফাতের স্ত্রী আয়শা সিদ্দিকা মিন্নিকে মামলায় ১ নম্বর সাক্ষী করা হয়।

রিফাত হত্যার ঘটনা বরগুনা শহরে ‘কিশোর গ্যাংয়ের’ দৌরাত্মের বিষয়টি প্রকাশ্যে আনে। এইসব কিশোর তরুণের পেছনে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার খবর গণমাধ্যমে এলে হত্যার কারণ নিয়ে নানামুখী আলোচনা চলতে থাকে।  

এর মধ্যেই ২ জুলাই মামলার প্রধান সন্দেহভাজন সাব্বির আহম্মেদ ওরফে নয়ন বন্ড পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন।

গ্রেপ্তরের পর আয়শা সিদ্দিকা মিন্নি

এদিকে মিন্নির শ্বশুরই পরে হত্যাকাণ্ডে পুত্রবধূর জড়িত থাকার অভিযোগ তুললে আলোচনা নতুন মোড় নেয়। ১৬ জুলাই মিন্নিকে বরগুনার পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে ডেকে নিয়ে দিনভর জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। পরে সেদিন রাতে তাকে রিফাত হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়।

পরদিন আদালতে হাজির করা হলে বিচারক তাকে পাঁচদিনের রিমান্ডে পাঠান। কিন্তু মিন্নির পক্ষে কোনো আইনজীবী সেদিন আদালতে দাঁড়াননি, যা নতুন বিতর্কের জন্ম দেয়।

পাঁচ দিনের রিমান্ডের তৃতীয় দিনেই মিন্নিকে আদালতে হাজির করা হয়। পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, ওই তরুণী হাকিমের কাছে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

তার আগের দিনই পুলিশ সুপার মো. মারুফ হোসেন এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেন, “মিন্নি হত্যাকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা এবং হত্যা পরিকল্পনাকারীদের সঙ্গে বৈঠক করেন। মিন্নিকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে হত্যা পরিকল্পনার সঙ্গে মিন্নির যুক্ত থাকার প্রমাণ পেয়েছে পুলিশ।”

তবে মিন্নির বাবা মোজাম্মেল হোসেন কিশোর অভিযোগ করেন, ‘নির্যাতন করে ও ভয়ভীতি দেখিয়ে’ মিন্নিকে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে বাধ্য করেছে পুলিশ। এর পেছনে স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনীতিবিদদের হাত আছে বলেও তিনি সে সময় দাবি করেন।

পরে ২৯ অগাস্ট হাই কোর্ট মিন্নির জামিন মঞ্জুর করে। তবে শর্ত দেওয়া হয়, জামিনে থাকা অবস্থায় ১৯ বছর বয়সী ওই তরুণী তার বাবা মোজাম্মেল হোসেন কিশোরের জিম্মায় থাকবেন। আর এই সময়ে মিন্নি গণমাধ্যমের সামনে কোনো কথা বলতে পারবেন না।

অভিযোগ গঠনের দিন আদালতে আসামিরা

হত্যাকাণ্ডের দুই মাসের মাথায় মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পরিদর্শক মো. হুমায়ুন কবির বরগুনার আদালতে মিন্নিসহ ২৪ জনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দাখিল করেন।

এজাহারের ১ নম্বর আসামি সাব্বির আহম্মেদ ওরফে নয়ন বন্ড পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ায় তার নাম অভিযোগপত্রে আসামির তালিকায় রাখা হয়নি।

দুই খণ্ডে বিভক্ত ওই অভিযোগপত্রের এক অংশে মোট ১০ জনকে আসামি করা হয়। অন্য অংশে রাখা হয় অপ্রাপ্তবয়স্ক ১৪ জনের নাম। 

বরগুনার জেলা ও দায়রা জজ মো. আছাদুজ্জামান চলতি বছরের প্রথম দিন রিফাতের স্ত্রী মিন্নিসহ প্রাপ্তবয়স্ক ১০ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন। সে অনুযায়ী ৮ জানুয়ারি শুরু হয় সাক্ষ্যগ্রহণ।

আর বরগুনার শিশু আদালতের বিচারক মো. হাফিজুর রহমান ৮ জানুয়ারি অপ্রাপ্তবয়স্ক ১৪ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন। সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয় ১৩ জানুয়ারি।