নদীভাঙনে সর্বস্ব হারানো মানুষ আশ্রয় নিচ্ছে বাঁধে। সেখানে বসতি গড়তে গিয়ে মাটি কেটে বাঁধের ক্ষতি করছে তারা। আবার মানুষের সঙ্গে আসছে ইঁদুর, ধ্বংস করছে অতি জরুরি বাঁধটি।
বগুড়ার সারিয়াকান্দী উপজেলা শহর এবং সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার জালালপুর ইউনিয়নসহ বিভিন্ন গ্রাম এখন বিলীন হওয়ার ঝুঁকিতে। ভাঙন ঠেকাতে দুই জেলায় চলছে বিভিন্ন প্রকল্প, তাতে কাজও কিছুটা হয়েছে। তবু মানুষের আতঙ্ক কাটছে না।
বগুড়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমান বলেন, ১৯৬৩ থেকে ৬৮ সালের মধ্যে রংপুরের কাউনিয়া রেল সেতু থেকে গাইবান্ধা, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ হয়ে পাবনার ভেড়াকোলা পর্যন্ত যমুনার পশ্চিম তীরে ২১৭ কিলোমিটার দীর্ঘ তীররক্ষা বাঁধটি নির্মাণ করা হয়।
“প্রতি বছর বন্যা নিয়ন্ত্রণে এ বাঁধ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কিন্তু বসতি স্থাপনের কারণে এর বিভিন্ন জায়গা বারবার ভেঙে যায়। বসতি স্থাপনের সময় লোকজন বাঁধের ওপরে ও দুই ধারে ঢাল কেটে ঘর তোলে। এতে বাঁধ দুর্বল হয়ে যায়।
“তাছাড়া খড়ের পালা, কলাগাছ লাগানো এবং ঘরে ধান-চাল থাকায় বাঁধজুড়ে ইঁদুর বাসা বাঁধে। ইঁদুর গর্ত করে। বন্যার সময় ওই গর্ত দিয়ে পানি চুইয়ে বাঁধ দুর্বল হয়ে যায়। ভেঙে যায়। ভাঙার পর সরকার আবার তা মেরামত করে।”
এই কর্মযজ্ঞ যখন ঠিকঠাক সামলানো যায় না তখন বাঁধের দুর্বল অংশ বা অংশবিশেষ ভেঙে লোকালয়ে পানি ঢোকে। বাঁধ থাকার পরও দেখা দেয় বন্যা।
প্রকৌশলী মাহবুব বলেন, বর্ষা মৌসুমে বাঁধে সমস্যা হলে কাজ করার জন্য বেশি সহায়তা পাওয়া যায় না। বেশির ভাগ সময় জরুরি কাজ ঠিকাদার দিয়ে বাকিতে করে নিতে হয়।
“এবার বগুড়া অংশের ৪৫ কিলোমিটার বাঁধের ছিদ্র বন্ধ করাসহ বর্ষা মৌসুমে প্রায় ১০ কোটি টাকার কাজ হয়েছে। তাদের এখনও বিল দেওয়া সম্ভব হয়নি।”
ওই ৪৫ কিলোমিটার বাঁধ প্রশস্ত ও উঁচু করার জন্য এক হাজার কোটি টাকার একটি প্রকল্প পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে বলে জানান মাহবুব।
তিনি বলেন, পুরো ২১৭ কিলোমিটার বাঁধই মজবুত করে সংস্কার করার চেষ্টা চলছে। সে কাজে প্রতি মিটারে খরচ হবে সাত-আট লাখ টাকা।
বগুড়ার সোনাতলা উপজেলার পাকুল্ল্যা থেকে সারিয়াকান্দি উপজেলা ও ধুনট উপজেলার পুকুরিয়া পর্যন্ত ৪৫ কিলোমিটার বাঁধ ঘুরে দেখা গেছে সারি সারি বসতবাড়ি। বাড়ি বানানোর পাশাপাশি অনেকে বাঁধেই লাগিয়েছেন কলাগাছ।
এদিকে যমুনা ভাঙতে ভাঙতে পশ্চিমে সরে যাচ্ছে। বাঁধটি যখন নির্মাণ করা হয়, তখনও নদী ছিল দূরে। বাঁধ ভেঙে নদী পশ্চিমে সরে যাওয়ার পর সেই এলাকায় নতুন করে অস্থায়ী বাঁধ দেওয়া হয়েছে।
দীর্ঘ এই সময়ে বগুড়া জেলায় যমুনা কতটুকু পশ্চিমে সরেছে তার একটি ধারণা পাওয়া যায় স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের কথায়।
সোনাতলা উপজেলার তেকানী চুকাইনগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শামসুল হক বলেন, বাঁধটি যখন বানানো হয়, তখন চুকাই নগর, খাবুনিয়া, জন্তারপাড়ার পূর্ব দিক দিয়ে প্রবাহিত হত যমুনা। সেই নদী ভেঙে এখন নয় কিলোমিটার পশ্চিমে সরে এসেছে। ফলে সেখানে নতুন করে আবার অস্থায়ী বাঁধ দেওয়া হয়েছে।
যমুনার পশ্চিম তীর একইভাবে ভেঙেছে সিরাজগঞ্জ জেলায়।
সদর উপজেলার ছোনগাছা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শহিদুল আলম বলেন, তার ইউনিয়নে ওই বাঁধ তিনবার ভেঙেছে, সরে এসেছে পশ্চিমে। চলতি বছরের বন্যায় ভেঙেছে পাঁচঠাকুরী ও সিমলা গ্রামের একাংশ।
আর সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার জালালপুর ইউনিয়ন পাঁচবার ভাঙার পর এখন পুরোপুরি বিলীন হবার শঙ্কা জেগেছে বলে জানালেন জালালপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সুলতান মাহমুদ।
তিনি বলেন, “ইউনিয়ন পরিষদ দপ্তরের আধা কিলোমিটারের মধ্যে এসে পড়েছে যমুনা। আবার ভাঙলে এ ইউনিয়ন আর থাকবে না।”
তবে ভাঙন ঠেকাতে সিরাজগঞ্জে বিভিন্ন প্রকল্প নিয়েছে সরকার। সেই প্রকল্পের অনেকগুলো শেষ হয়েছে। আরও কিছু চলমান।
সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম বলেন, ২১৭ কিলোমিটার দীর্ঘ তীররক্ষা বাঁধের মধ্যে ৮০ কিলোমিটার পড়েছে সিরাজগঞ্জ অংশে। এ বাঁধেও বগুড়ার মত অবস্থা হয়েছিল।
তবে শাহজাদপুর উপজেলায় এখনও ভাঙন অব্যাহত রয়েছে জানিয়ে প্রকৌশলী শফিকুল বলেন, সেখানেও বাঁধ নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।
এছাড়া জেলার কাজিপুর উপজেলার সিংড়াবাড়ি, পাটাগ্রাম ও বাঐখোলা এলাকা সংরক্ষণ প্রকল্প এবং শাহজাদপুর উপজেলার ব্রাহ্মণগ্রাম-হাটপাঁচিল ও সংলগ্ন এলাকা সংরক্ষণ এবং বেতিল স্পার-১ ও এনায়েতপুর স্পার-২ শক্তিশালী করতে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে বলে জানান তিনি।
সেসব প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে জানিয়ে নির্বাহী প্রকৌশলী বলেন, “স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের ফলে বিশাল বিশাল জমি জেগে উঠেছে। তার মধ্যে কাজিপুরে নির্মাণ করা হচ্ছে শহীদ এম মনসুর আলী ইকোপার্ক। আর সিরাজগঞ্জ সদরে গড়ে তোলা হচ্ছে অর্থনৈতিক অঞ্চল।”
সেই তুলনায় বগুড়ায় যমুনার তীর রক্ষায় বড় কোনো প্রকল্প নেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ করেন সারিয়াকান্দী উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক মতিউর রহমান।
তিনি বলেন, ১৯৯৮ সালে উপজেলার কালিতলা, দিঘলকান্দী ও মথুরাপুরে ৫৭৭ কোটি টাকা ব্যয়ে হার্ড পয়েন্ট ও গ্রোয়েন বাঁধ নির্মাণ করা হয়। একই বছর উপজেলার চন্দন বাইশাসহ ধুনটে ছয়টি স্পার বাঁধ নির্মাণ করা হয়। প্রতিটি স্পারে ব্যয় হয় ১২ কোটি টাকা।
“বেড়িবাঁধ নির্মাণ ও বর্ষা মৌসুমে কিছু ছোট আকারের কাজ হয়েছে। এছাড়া যমুনার ভাঙনরোধে আর কোনো বড় প্রকল্প আসেনি।”