কেউ বখাটের লাগাম টানল না: আক্ষেপ বিউটির মায়ের

“ওসি, দারোগা, মেম্বার সবারে বললাম, কেউ তার লাগাম টানল না। শেষে আমার মেয়েটার জীবন দিতে হল।”

সাতক্ষীরা প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 11 Sept 2020, 11:10 AM
Updated : 12 Sept 2020, 10:01 AM

আক্ষেপ করে বলছিলেন সাতক্ষীরার তালা উপজেলার কলাগাছি গ্রামের কিশোরী বিউটি মণ্ডলের মা অনীষা মণ্ডল।

তার অভিযোগ, স্থানীয় এক তরুণ বিউটির ‘আপত্তিকর’ ছবি ছড়িয়ে দিয়েছিল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। এ বিষয়ে অভিযোগ করার পরও পুলিশ কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ায় আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে এই কিশোরী।

কলাগাছি গ্রামের নিতাই মণ্ডলের মেয়ে বিউটি এবার উপজেলার শহীদ জিয়া কলেজের একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। বুধবার গলায় ওড়না পেঁচিয়ে তিনি আত্মহত্যা করেন বলে পরিবার জানায়।

এ ঘটনায় ওই কলেজের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থী মৃত্যুঞ্জয় রায়ের (১৯) বিরুদ্ধে তালা থানায় আত্মহত্যায় প্ররোচনার মামলা করেছে বিউটির পরিবার। মৃতুঞ্জয় ওই গ্রামের মুদি দোকানি জগদীশ রায়ের ছেলে।

মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে, ফেইসবুকে বিউটির ‘আপত্তিকর ছবি’ ছড়িয়ে তার ‘জীবন অতিষ্ঠ’ করে তোলেন মৃতুঞ্জয়।

আগেও এ বিষয়ে থানায় অভিযোগ করা হয়েছিল জানিয়ে বিউটির মা বলেন, “বারবার বলিছি জগদিশির ছেলি আমার মেয়িডারে বিশাল যন্তনা দিতিছে। নেটে ... ছবি ছেড়িছে। কুপ্রস্তাব দিতিছে। কেউ তার লাগামডা টেনলো না।

“আমার ভাল লিখাপড়া করা মেয়িডা গুলায় দড়ি দে মুরলো। পোরোশাসন তারে একোনো ধইরলো না। ওরে ভগবান, এই দেশে গরিবের জন্যি কেউ নিই রে, কেউ নি।”

অনীষা মণ্ডল বলেন, লিখিত অভিযোগ করার পরও পুলিশ ব্যবস্থা না নেওয়ায় তারা বারবার থানায় গেছেন। কিন্তু ওসি কোনো কথা ‘শুনতে চাননি’। বরং থানা থেকে তাদের বেরিয়ে যেতে বলা হয়েছে।

“যতবার ঢুকিছি, ততবার থানার বাইরি যেতি বলিছে। মানুষ হতি চাইলো মেয়িডা আমার...।”

বিউটির একজন আত্মীয় বলেন, “ওসি-দারোগারা খুব রাগ দেখাত, যে কারণে থানায় ঢুকতে আমাদের খুব ভয় লাগত।”

এ বিষয়ে কথা বলতে চাইলে তালা থানার ওসি মেহেদী রাসেল প্রথমে বলেন, তিনি ‘অন্য মামলা নিয়ে ব্যস্ত’ আছেন।

মৃত্যুঞ্জয় রায়

পরে আবার ফোন করলে তিনি বলেন, “একটা অভিযোগ দিয়েছিল বিউটির বাবা। বিউটি মারা গেছে। এ ঘটনায় তার কাকা দীপঙ্কর মণ্ডল আত্মহত্যায় প্ররোচনার মামলা করেছেন মৃত্যুঞ্জয়ের বিরুদ্ধে। আমি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। আসামিকে ধরার জন্য চেষ্টা করছে পুলিশ। খেশরা পুলিশ ফাঁড়িও তৎপর আছে।”

অভিযোগ পাওয়ার পরও কেন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি জিজ্ঞেস করলে ‘এখন ব্যস্ত আছি’ বলে লাইন কেটে দেন ওসি।

বিউটির মা অভিযোগ করেছিলেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধির কাছেও; কিন্তু তাতেও কোনো কাজ হয়নি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে খেশরা ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য অনন্ত সরকার বাবু বলেন, “বখাটেপনায় অতিষ্ঠ হয়ে বিউটি ঘরের আড়ায় ওড়না দিয়ে ঝুলে আত্মহননে প্রাণ দিয়েছে। বখাটে মৃত্যুঞ্জয়ের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ দিয়েছে বিউটির বাবা। সে কারণে পুলিশের নির্দেশনা ছাড়া আমরা কিছু করতে পারিনি। তবু দুই দিন আগে জানার পর এলাকার মানুষ নিয়ে বসতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তার মধ্যেই দুঃখজনক ঘটনাটি ঘটে গেল।”

এ বিষয়ে খোঁজ নিতে গেলে ওই এলাকার অনেকেই মৃত্যুঞ্জয়ের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ করেছেন।

তালা উপজেলার শালিখা ডিগ্রি কলেজের ইতিহাস বিভাগের প্রভাষক রবিউল আওয়াল বলেন, “বিউটির মৃত্যু হৃদয়বিদারক একটি ঘটনা। বখাটে মৃত্যুঞ্জয় এখনও গ্রেপ্তার না হওয়া আমাদের জন্য কোনো ভাল খবর না। অবিলম্বে বিউটির মত্যুর জন্য দায়ী ব্যক্তির সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।”

কলাগাছি গ্রামে খোঁজ নিতে গেলে এক নারী অভিযোগ করেন, “মৃত্যুঞ্জয় কেবল স্থানীয় স্কুলগামী মেয়েদের উত্ত্যক্ত করেই ক্ষান্ত ছিল না। অনেক গৃহবধূর ছবি সুপার ইম্পোজ করে নগ্ন ছবি বানিয়ে ব্ল্যাকমেইল করত। বিষয়টি তার বাবা জানলেও কখনও ব্যবস্থা নেননি।”

মৃত্যুঞ্জয়ের বাবা জগদীশ রায়ের সঙ্গে কথা বলতে তার বাড়িতে গেলে কাউকে পাওয়া যায়নি। ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তা বন্ধ পাওয়া যায়। প্রতিবেশীরা জানান, বিউটির আত্মহত্যার পর থেকে পুরো পরিবার ‘গা ঢাকা’ দিয়েছে।

মৃত্যুঞ্জয় যে কলেজের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থী, সেই শহীদ জিয়া কলেজের অধ্যক্ষ রফিকুল ইসলাম বলেন, “মৃত্যুঞ্জয়ের বিরুদ্ধে কখনও কোনো খারাপ অভিযোগ পাইনি। বিউটির মৃত্যুর খবর শুনেছি। বিউটি এবার আমাদের কলেজে ভর্তির সুযোগ পেয়েছিল। এর বেশি কিছু জানি না।”

উপজেলা প্রশাসন এখন এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন তালার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. ইকবাল হোসেন।

তিনি বলেন, “বিউটির মৃত্যু অত্যন্ত বেদনাদায়ক। আমরা কেউ এর দায় এড়াতে পারি না। এ ব্যাপারে স্থানীয় সংসদ সদস্য ও জেলা প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলেছি। ওই বখাটেকে আইনের আওতায় আসতেই হবে। আমরা প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেব। বিউটির মত ঘটনা যাতে আর কোনোক্রমেই না ঘটে তার জন্য সব বিভাগকেই আমি তৎপর করতে চাই।”