খাগড়াছড়িতে পর্যটনে স্থবিরতায় বেকার বহু

করোনাভাইরাসের মধ্যে পাঁচ মাসের বেশি সময় ছুটির কারণে দেশের অন্যান্য স্থানের মতো খাগড়াছড়ির পর্যটন ব্যবসায়ীরা বিপুল ক্ষতির শিকার হয়েছেন। একই সঙ্গে এই খাতে সংশ্লিষ্ট শত শত শ্রমজীবী কর্মহীন হয়ে পড়েছেন।

খাগড়াছড়ি প্রতিনিধিআবু দাউদ, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 August 2020, 11:34 AM
Updated : 15 August 2020, 12:42 PM

চলতি বছরের মার্চের মাঝামাঝি থেকে দেশের পর্যটন কেন্দ্রসমূহ বন্ধ রয়েছে। হোটেল, মোটেল, রেস্তোরাঁ ও যানবাহন মিলিয়ে অন্তত ৫০ কোটি টাকার ক্ষতির হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য।

পাশাপাশি এ খাতের সঙ্গে পরোক্ষভাবে জড়িত অনেকেই কর্মহীন হয়ে পড়েছে; যাদের মধ্যে হোটেল-মোটেল শ্রমিকরা ছাড়াও রয়েছেন জিপ ও পিক-আপ শ্রমিকরাও।

পর্যটন সংশ্লিষ্ট জেলা রাঙামাটি, সিলেট ও মৌলভীবাজারেরও একই অবস্থা। এই করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে ওইসব জেলায় কোটি কোটি টাকা লোকসান গুনতে হয়েছে ব্যবসায়ীদের। একই সঙ্গে কর্মহীন হয়েছেন এই খাতে সংশ্লিষ্ট কর্মজীবীরা।   

পর্যটন ব্যবসায়ীরা জানান, খাগড়াছড়ি জেলা সদরের ত্রিশটিসহ পুরো জেলায় অর্ধশতাধিক হোটেল-মোটেল ও রিজোর্ট রয়েছে।

খাগড়াছড়ি শহরের হোটেল গাইরিং

এছাড়া খাগড়াছড়ির পাশেই রয়েছে রাঙ্গামাটি জেলার সাজেক পর্যটন কেন্দ্র, যেখানে যেতে হলে খাগড়াছড়ির উপর দিয়ে যাওয়াই সুবিধাজনক। এখানে রয়েছে শতাধিক রিজোর্ট। তাই এই পর্যটন কেন্দ্রের অর্থনৈতিক প্রবাহও খাগড়াছড়ির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।

করোনাভাইরাস সংক্রমণ বৃদ্ধির কারণে গত ১৮ মার্চ স্থানীয় প্রশাসনের নির্দেশে খাগড়াছড়ি এবং সাজেকের সব পর্যটন স্থাপনা বন্ধ করে দেওয়া হয়। এরপর ২১ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে সাজেকের হোটেল, রিসোর্ট, কটেজ ও রেস্তোরাঁসমূহ বন্ধ হয়ে যায়।  

প্রতিবছর বিভিন্ন উৎসব ও ছুটি ছাড়াও নানা উপলক্ষ্যে জমজমাট থাকে খাগড়াছড়ির পর্যটন কেন্দ্রগুলো। সাজেকের পর্যটন কেন্দ্রগুলো হাজারো পর্যটকের পদচারণায় মুখর থাকে বছরের বেশিরভাগ সময়। কিন্তু এ বছর ভিন্ন চিত্র। বর্তমানে খাগড়াছড়ি ও সাজেকের সবকটি পর্যটন কেন্দ্র, হোটেল-মোটেল একেবারে ফাঁকা।

খাগড়াছড়ির পর্যটন স্থানগুলোর মধ্যে রয়েছে আলুটিলা, রিছাং ঝর্ণা, জেলা পরিষদ পার্ক, মায়াবিনী লেক, তৈদুঝর্ণা, পানছড়ির অরণ্য কুঠির, দেবতা পুকুর এবং মানিকছড়ি রাজবাড়ি উল্লেখযোগ্য।

এখন এসব স্থানে কোনো পর্যটক নেই। এগুলোতে প্রবেশ মুখে তালা ঝুলছে।

খাগড়াছড়ি শহরের হোটেল গ্রিন স্টার

পাহাড়ে ‘চাঁদের গাড়ি’ খ্যাত খোলা জিপ, পিকআপ গাড়িগুলোও চলছে না। রেস্তোরাঁগুলোতে আগের মত জমজমাট ব্যবসা নেই। এ কারণে হোটেল, মোটেল, রেস্তোরাঁ এবং যানবাহনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা আর্থিক সংকটে পড়েছেন। রাঙ্গামাটির সাজেক ও খাগড়াছড়ির হোটেল, মোটেল, রিজোর্ট, কটেজ, রেস্তোরাঁ ও যানবাহনের সাথে জড়িত হাজারো শ্রমিক কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। মালিকরা ক্ষতির মূখে পড়েছেন।

সাজেকে হোটেল, রিজোর্ট ও রেস্তোরাঁ মিলে শতাধিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর বাইরেও পারিবারিক আবহে বেশ কয়েকটি ঘরবাড়ি রয়েছে যেখানে পর্যটকরা ভাড়ায় থাকেন।  

খাগড়াছড়ি হোটেল মালিক সমিতির সভাপতি কল্যাণ মিত্র বড়ুয়া বলেন, হোটেল মালিকরা খুবই দুশ্চিন্তার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ থাকায় তারা ব্যবসায়িকভাবে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। কেবল খাগড়াছড়ির হোটেল, মোটেল, রেস্তোরাঁ এবং যানবাহন মিলিয়ে ৫০ কোটি টাকার ক্ষতির মধ্যে পড়েছেন।

খুব সহসাই পর্যটন স্পটগুলো খুলে দেওয়া না হলে ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে পারবেন না বলে আশংকা তার।

কল্যাণ মিত্র জানান, খাগড়াছড়ি সদরে ৩০টি হোটেলে অন্তত ১৮০ জন হোটেল বয় ও কর্মচারী কর্মহীন হয়ে পড়েছে, যাদের অধিকাংশকেই বেতন-ভাতা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।

খাগড়াছড়ি শহরের হোটেল অরণ্য বিলাস

খাগড়াছড়ি শহরের হোটেল অরণ্য বিলাসের ব্যবস্থাপক আব্দুর রশীদ সাগর বলেন, মালিকরা হোটেল বন্ধ করে রেখেছেন। বেশিরভাগ কর্মচারীদের বেতন-ভাতা দিচ্ছে না। কেউ কেউ পেলেও খুব সামান্য।

শহরের গ্রিনস্টার হোটেলের বয় নবীন ত্রিপুরা বলেন, “হোটেল মালিক সামান্য পরিমাণ টাকা দিলেও তাতে সংসার চলছে না।”

যে ক্ষতি হয়ে গেছে তা কাটিয়ে উঠতে আরও কয়েক বছর লাগতে পারে বলে মনে করেন সাজেক হোটেল মালিক সমিতির সভাপতি সুবর্ণ ত্রিপুরা।

তিনি ক্ষতির পরিসংখ্যান বর্ণনা করে বলেন, পুরোদমে চালু থাকলে দৈনিক প্রায় কোটি টাকার লেনদেন হতো সাজেকেই। দীর্ঘ সময় ধরে বন্ধ থাকার কারণে সাজেকের বহু হোটেল রিজোর্টের স্টাফরা চলে গেছেন। অনেক হোটেলের মালামাল নষ্ট হয়েছে কিংবা হারিয়ে গেছে।  

সুবর্ণ ত্রিপুরা জানান, সাজেকে ১০০টি রিজোর্ট ও কটেজে প্রায় ৪০০ এর মতো শ্রমিক আছেন। তাদের অধিকাংশই এখন কর্মহীন জীবন কাটাচ্ছেন।

খাগড়াছড়ি জিপ মালিক সমিতির সম্পাদক আব্দুল আজিম বলেন, করোনাভাইরাস সংকটে পর্যটন কেন্দ্রগুলো বন্ধ থাকায় সীমাহীন ক্ষতির শিকার হয়েছেন চাঁদের গাড়ি (জিপ) ও পিকআপের মালিক ও শ্রমিকরা।

স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে আছে চাঁদের গাড়ি খ্যাত জিপগুলো

“খাগড়াছড়ি জিপ মালিক সমিতি ও পার্বত্য জিপ মালিক সমিতির ৫০০ এর মতো গাড়িতে অন্তত এক হাজার শ্রমিক রয়েছেন, যারা এখন কর্মহীন। কেউ কেউ এটা সেটা করলেও অধিকাংশই কাটাচ্ছেন মানবেতর জীবন।

এই সময়ে যানবাহন খাতে জেলায় অন্তত ২০ কোটি টাকার বেশি লোকসান গুনতে হয়েছে বলে তিনি মনে করেন।

পর্যটন ব্যবসায়ী অনন্ত বিকাশ ত্রিপুরা খাগড়াছড়ি ও সাজেকের পর্যটন স্থাপনাগুলো খুলে দেওয়ার জন্য প্রশাসনের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন।

সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে পর্যটন ব্যবসা চালু রাখা সম্ভব বলেও তিনি মনে করেন।

খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসক প্রতাপ চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, “পর্যটন কেন্দ্রগুলো কখন খুলে দেওয়া হবে তা ঠিক হয়নি এখনও। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কমিটিগুলোর সঙ্গে বৈঠক করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।”