বন্যা: নেত্রকোণায় বিপর্যয়ে কৃষি

নেত্রকোণায় তিন দফা বন্যায় ১৩৮ হেক্টর আমন বীজতলা বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। ভেসে গেছে চাষের পুকুর, খামার; নদীভাঙন ছাড়াও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে গ্রামীণ সড়ক ও সেতু।

লাভলু পাল চৌধুরীবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 August 2020, 08:02 AM
Updated : 5 August 2020, 08:04 AM

জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ড আর ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তিন দফায় বন্যায় জেলার ১০ উপজেলার মধ্যে কলমাকান্দা, দুর্গাপুর, বারহাট্টা, হাওরাঞ্চলের মদন, মোহনগঞ্জ, খালিযাজুরী উপজেলাসহ সাতটি উপজেলার এক লাখ ১৭ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।

মঙ্গলবার জেলার হাওরাঞ্চলের ধনু নদী খালিয়াজুরী বাজার পয়েন্টে বিপৎসীমার ৬৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে বয়ে যায়। এতে মোহনগঞ্জ ও খালিয়াজুরীর কিছু এলাকা বন্যা কবলিত রয়েছে। সেখানের বন্যাকবলিত মানুষ আশ্রয় কেন্দ্রে  রয়েছেন। এছাড়া জেলা র প্রধান নদী সোমেশ্বরী, কংস, উব্ধাখালির পানি বিপৎসীমার নিচে দিয়ে বইছে। তবে নিচু এলাকায় জলাবদ্ধতা এখনও কাটেনি।

বিপর্যয়ে কৃষি খাত

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক হাবিবুর রহমান বলেন, এবার জেলার ১৩৮ হেক্টর আমন বীজতলা বন্যায় তলিয়ে নষ্ট হয়ে গেছে। তলিয়ে গেছে ১৩ হেক্টর আউশ ধানের ক্ষেত। সরকারের তরফে নতুন করে ১৫ হেক্টর আমন বীজতলা করতে কৃষকদের বীজ দেওয়া হচ্ছে। তাছাড়া সবজি উৎপাদন বাড়াতে ২ হাজার ২৪০ কৃষককে বসতবাড়ির উঁচু জমিতে আবাদের জন্যে বীজ ও সার দেওয়া হচ্ছে।

তবে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকেরা তাদের আমন আবাদ নিয়ে দুশ্চিন্তার কথা জানিয়েছেন। জেলার কলমাকান্দা উপজেলা কনুরা গ্রামের মনতোষ বিশ্বশর্মা বলেন, দুই দফায় তার বীজতলা তলিয়ে নষ্ট হয়েছে। এবার তৃতীয়বারের মতো বীজতলা করার চেষ্টা করছেন। বাজারে বীজ সংকটের কারণে তিনি এখনও আমন ধানের বীজ সংগ্রহ করতে পারেননি।

একই অবস্থার কথা জানিয়ে অন্য কৃষকেরা বলছেন, কৃষি বিভাগ থেকেও বীজ ধান না পাওয়ায় আগামী আমন আবাদ নিয়ে বিপাকে পড়েছেন তারা।

বন্যায় তলিয়েছে পুকুরের পর পুকুর

তিন দফার বন্যায় জেলার সাত উপজেলার পুকুর ও খামারের মাছ চাষিদের মাথায় হাত পড়েছে।

জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ফজলুল কবীর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, তিন হাজার মৎস্য চাষির চার হাজার ১৬৯টি পুকুর ও খামার তলিয়ে গেছে। এতে করে চাষিদের অন্তত ১২ কোটি ৭৯ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। এর মধ্যে নয় কোটি ৯২ লাখ টাকার মাছ, এক কোটি ২৭ লাখ টাকার রেণু-পোনার পুকুর বানের পানিতে ভেসে গেছে। এক কোটি ৬০ লাখ টাকার পুকুর ও খামারের অবকাঠামোগত ক্ষতি হয়েছে।

তিনি বলেন, ক্ষতি এড়াতে জাল দিয়ে পুকুর ও খামারের পাড় ঘিরে রাখা ও বড় মাছ দ্রুত বিক্রি করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। যেসব পুকুর ও খামার থেকে বন্যার পানি নেমে গেছে সেখানে চুন দিয়ে পানি পরিশোধন করতে হবে। তবে ক্ষতিগ্রস্ত চাষিদের জন্য আপাতত সরকারি কোনো সহায়তা দেওয়া হচ্ছে না। 

ক্ষতিগ্রস্ত গ্রামীণ সড়ক

জেলার বন্যাকবলিত এলাকাগুলোর কাঁচা-পাকা গ্রামীণ সড়কের ক্ষতি হযেছে বলে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের নেত্রকোণা জেলা কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মনিরুজ্জামান জানান।

তিনি বলেন, বন্যার পানির তোড় ও পানিতে তলিয়ে ২৭৬ দশমিক ৫৮ কিলোমিটার গ্রামীণ সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে প্রায় ৪২ কোটি ৪১ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। এছাড়া বক্স কালভার্ট, আরসিসি বক্স, প্যালাসাইডিং ও ইউড্রেনের ২২৬ মিটার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ক্ষতির পরিমাণ অন্তত এক কোটি ৪৪ লাখ টাকার।

নদীভাঙন

বন্যার সময় জেলার প্রধান নদীগুলো ফুলেফেঁপে ওঠায় সোমেশ্বরী, কংস ও ধনু নদীতে ভাঙন দেখা দেয়। এতে তীরবর্তী বাজার, বসতবাড়ি ভাঙনের কবলে পড়ে।

জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আক্তারুজ্জামান জানান, টানা বৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢলের  কারণে নদীর পানি বেড়ে সোমেশ্বরী তীরে দুর্গাপুরের ভবানীপুর এলাকায় ভবানীছড়া অংশে এবং উপজেলার গাওকান্দিয়া ইউনিয়নের কালিকাবর এলাকায় ভাঙন দেখা দেয়। এছাড়া বারহাট্টায় কংস নদে ভাঙন দেখা দেয় ফকিরের বাজার এলাকায় কর্ণপুরে। হাওরাঞ্চলে ধনু নদীর ভাঙনের কবলে পড়ে খালিয়াজুরী উপজেলার গাজীপুর ইউনিয়নের চরপাড়া গ্রাম ও চাকুয়া ইউনিয়নের পাতরা গ্রাম।

ভাঙন রোধে বন্যাকবলিত এলাকাগুলোতে অস্থায়ী  প্রতিরক্ষামূলক কাজ চলছে বলে জানান তিনি।

রোগবালাই

বন্যার্তদের মাঝে এখন নাগাদ পানিবাহিত রোগবালাই ছড়ায়নি বলে দাবি করেছেন জেলার সিভিল সার্জন তাজুল ইসলাম।

তিনি বলেন, সাধারণত ঠাণ্ডাজনিত সর্দি, জ্বর যেমন সংখ্যক হয় তেমনিই আছে। তাছাড়া বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সময় ডায়রিয়া ও নানা চর্মরোগের প্রকোপ দেখা দেয়। এ রকম পরিস্থিতি হলে তা রোধে প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। ৯৬টি মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে। ৩০ হাজার পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া অন্য প্রয়োজনীয় ওষুধ মজুদ রাখা হয়েছে।

বন্যার্তদের সরকারি সহায়তা

জেলায় তিন ধাপে হওয়া বন্যায় এ পর্যন্ত এক লাখ ১৭ হাজার মানুষ সমস্যার মধ্যে পড়েছিলেন জানিয়ে জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা শরফুল ইসলাম বলেন, “বর্তমানে হাওরাঞ্চলের মোহনগঞ্জ ও খালিয়াজুরীতে ৬০০ পরিবার বন্যা আশ্রয় কেন্দ্রে রয়েছেন। জেলার বন্যাকবলিত সাতটি উপজেলার মধ্যে মোহনগঞ্জ ও খালিয়াজুরী ছাড়া বাকি পাঁচটি উপজেলার পানি নেমে গেছে। তবে একেবারে নিচু এলাকায় জলাবদ্ধতা রয়ে গেছে।”

তিন দফা বন্যায় জেলায় ৩৫০ মেট্রিকটন চাল, সাড়ে ১৬ কেজি করে ২ হাজার ৯০০ শুকনো খাবারের প্যাকেট, সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা, শিশুখাদ্য বাবদ এক লাখ টাকা ও গো-খাদ্য বাবদ দুই লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া এখনও পর্যাপ্ত পরিমাণ চাল ও টাকা মজুদ আছে বলে জানান তিনি।