বন্যায় দুর্ভোগের যেন শেষ নেই

দেশের প্রায় এক মাসের বন্যায় উত্তর ও মধ্যাঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। বহু মানুষ ঘরবাড়ি হারিয়েছে নদীর ভাঙনে; পুকুর ও মাছের ঘের ভেসে গেছে। পানিবন্দি হয়েছে লাখো মানুষ। বানভাসিদের পর্যাপ্ত ত্রাণ না পাওয়ারও অভিযোগ রয়েছে। সীমাহীন দুর্ভোগের মধ্যে দিন যাচ্ছে বানভাসি মানুষের।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 July 2020, 07:57 PM
Updated : 26 July 2020, 09:08 PM

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম প্রতিনিধিদের পাঠানো সংবাদে এই চিত্র উঠে এসেছে।

শরীয়তপুর থেকে কে এম রায়হান কবীর জানান, পদ্মার ভাঙনে জাজিরা উপজেলার চারশ পরিবার গৃহহীন হয়েছে। অব্যাহত পানি বৃদ্ধির ফলে শরীয়তপুর সদরসহ চারটি পৌরসভা ও জাজিরা, নড়িয়া, ভেদরগঞ্জ উপজেলার ৫০টি ইউনিয়নের প্রায় দেড় লক্ষ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।

জাজিরা উপজেলার বড়কান্দি ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য আতাহার মোল্ল্যা জানান, বড়কান্দি, পালের চর, কুন্ডেরচর ও বিলাশপুর ইউনিয়ন এবং মঙ্গলমাঝির ঘাট সংলগ্ন ওকিলউদ্দিন মুন্সিকান্দি, আলমখার কান্দি, চেয়ার আলী কান্দি, ছৈয়াল কান্দি ও পৈলান মোল্যা কান্দি গ্রামে গত কয়েকদিনে পদ্মার ভাঙনে অন্তত চারশ পরিবার গৃহহীন হয়েছে।

শরীয়তপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নিবাহী প্রকৌশলী হাসান হাবিবুর রহমান জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় পদ্মার পানি ৫ সেন্টিমিটার কমে সুরেশ্বর পয়েন্টে বিপদসীমার ৩৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে।

জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আবদুর রউফ জানিয়েছেন, বন্যার পানিতে ৫০ হেক্টর জমির ২৯৬টি মাছের পুকুর ও ঘের ভেসে গেছে। এতে মাছচাষিদের প্রায় ২ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।

জাজিরা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আশ্রাফ উজ্জামান ভুইয়া বলেন, পদ্মার প্রবল স্রোতের কারণে জাজিরার মঙ্গলমাঝির ঘাটের পূর্বপাশের চারটি ইউয়নের গ্রামগ্রলোতে পদ্মার ভাঙন দেখা দিয়েছে। ভাঙনে পদ্মার তীরবর্তী চারটি প্রায় চারশ পরিবার গৃহহীন হয়ে বাড়ি-ঘর সরিয়ে নিয়েছে অন্যত্র।

“ভাঙন কবলিত এলাকায় এ পর্যন্ত ২৬০ মেট্টিক টন চাল ও পাঁচশত প্যাকেট শুকনো খাবার বিতরণ করেছি। সরকারের পক্ষ থেকে ত্রাণ কার্যক্রম অব্যাহত আছে। ভাঙন রোধে পানি উন্নয়ন বোর্ড সহযোগিতায় জিও ব্যাগ ডাম্পিং শুরু করছে।”

গাইবান্ধা থেকে তাজুল ইসলাম রেজা জানান, জেলার নদীতীরবর্তী সাতটি উপজেলার ৩১টি ইউনিয়নের শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে; এতে দেড় লাক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়েছে। অনেক বন্যার্ত এখনও ত্রাণ বা সহায়তা পাননি বলে অভিযোগ করেছেন।

এদিকে, সাঘাটা, ফুলছড়ি, সুন্দরগঞ্জ, গোবিন্দগঞ্জ, পলাশবাড়ী, সাদুল্লাপুর ও গাইবান্ধা সদর উপজেলার ১৯টি পয়েন্টে ব্যাপক নদী ভাঙন অব্যাহত রয়েছে। এছাড়া গাইবান্ধা শহর রক্ষা বাঁধসহ বন্যা নিয়ন্ত্রন বাঁধের ৫২টি পয়েন্ট এখন চরম হুমকির মুখে রয়েছে। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে বাঁধ ভেঙে জেলায় বন্যায় চরম বিপর্যয় দেখা দিতে পারে বলে আশংকা করা হচ্ছে।

গাইবান্ধা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোখলেছুর রহমান জানান, জেলায় গত চব্বিশ ঘণ্টায় ঘাঘট, করতোয়া ও তিস্তা নদীর পানি সামান্য কমেছে। তবে ব্রহ্মপুত্র নদের পানি স্থির রয়েছে।

রোববার বন্যা কবলিত কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, বন্যার পানিতে ডুবে আছে ঘরবাড়ি ও রাস্তাঘাট। বাঁধে আশ্রয় নিয়ে গবাদি পশুসহ খোলা আকাশের নিচে দুর্ভোগকে সঙ্গী করে নিয়ে প্রায় এক মাস থেকে বসবাস করছে বন্যার্ত মানুষরা।

ফুলছড়ি উপজেলার উড়িয়া ইউনিয়নের কালাসোনা গ্রামের দিনমজুর কাশেম মিয়া (৪৫) বলেন, “বান আসি হামরা হাবুডুবু খাবার নাগচি। ২৬ দিন থাকি কসটো করি পানির মদ্দে আচি। তাও বানের মদ্দে কোনো ইলিপ পানো না।”

উড়িয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মাহতাব উদ্দিন বলেন, ইউনিয়নের ১৬ হাজার মানুষের মধ্যে ১০ হাজার মানুষ গত ১৫ দিন থেকে পানিবন্দি হয়ে আছে।

“তাদের মধ্যে মাত্র চার হাজার জনকে ১০ কেজি করে চাল দিয়েছি। ফলে এ পর্যন্ত যে ৪০ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ পেয়েছি তা শেষ হয়ে গেছে। এখন হাতে কোনো ত্রাণ নেই। তাই দিতে পারছি না।”

গাইবান্ধা জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা একেএম ইদ্রিশ আলী বলেন, বন্যাকবলিত চার উপজেলার জন্য ৩২০ মেট্রিক টন চাল, ১৫ লাখ টাকা, চার লাখ টাকার শিশুখাদ্য, দুই লাখ টাকার গোখাদ্য ও তিন হাজার ৬০০ প্যাকেট শুকনো খাবার বরাদ্দ করা হয়েছে। এগুলোর বিতরণ চলছে।

বগুড়া থেকে জিয়া শাহীন জানান, সারিয়াকান্দি উপজেলার আওলাকান্দি, ধুনট উপজেলার শহড়াবাড়ী ও বৈশাখী চরে গিয়ে দেখা যায়- দ্বিতীয় বন্যায় যারা কেবলই ঘড় গোছাতে শুরু করেছিল তারা আবার আসবাবপত্র সরাচ্ছে। রান্নার চুলা ও থাকবার বিছানা বার বার সরাতে হচ্ছে তাদের পানি থেকে রক্ষা করতে।

ধুনটের বানিয়াজান স্পারের ধারে তিন শতক জায়গা নিয়ে বাস করেন শিপন বরি দাশ, তার মা, ভাই এবং তাদের স্ত্রী সন্তান।

শিপন রবি দাসের স্ত্রী তারা মনি বলেন, “তিন বার বানের পানি আসল। কয়বার হাস্যাল ( চুলা), বিছনা ( বিছানা), থালি প্যাল্লা (থালা-বাসন) সরামু। খাবার চিন্তা করমু না এগল্লা টানা টানি করমু৷ জান আর কুলায় না।”

শহড়াবাড়ীর ফরিদ সরকার বলেন, “তিনবার নদী ভাঙনে এখন বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের পাশে আছি। তিনবার বানে ঘরের জিনিস সারাতে হলো।”

পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, প্রথম বন্যায় বগুড়া পয়েন্টে যমুনার পানি বিপদসীমার ৬৭ সেন্টিমিটার উপরে ছিল। দ্বিতীয় বন্যায় ১৮৮ সেন্টিমিটার মিটারের উপরে ওঠে। গত ২২ জুলাই থেকে আবার পানি বাড়তে থকে।

কুড়িগ্রাম থেকে আহসান হাবীব নীলু জানান, বন্যার বিপুল জলরাশির মধ্যেও এক চিলতে জমির উপর কোনো কোনো পরিবার কাটাচ্ছে দিনের পর দিন।

এমন একটি হলো খোরশেদ-রহিমা বেগমের পরিবার। কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার পাঁচগাছি ইউনিয়নের কদমতলা গ্রামের এই পরিবারের সদস্যরা থাকছে সীমাহীন দুর্দশার মধ্যে।

রহিমা বেগম বলেন, “বাহে অনেক কষ্ট করি পানি আনা নাগে। থাকার জাগা নাই। খুব কষ্ট করি আছি। কাঁইয়ো খোঁজ খবর নেয় না।”

রহিমা ও খোরশেদ যে ঘরে থাকেন তার চারদিকে শুধু পানি আর পানি। মাঝখঅনে এক টুকরো ভূমিতে তাদের ছোট ছাপরা ঘর। এক বুক পানি ভেঙে অনেক দূর থেকে তাদের খাবার পানি আনতে হয়। 

রহিমার স্বামী খোরশেদ বলেন, “বাপুরে রোদ আর ঝড়িত অনেক কষ্ট করি আছি। করোনা আর পানি থাকায় জামাই আর আমি কাম-কাজ না পায়া ঘরত বসি আছি। খাবার নাই। প্রায় না খায়া আছি।”

পাঁচগাছী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেন মাস্টার বলেন, “আমার ইউনিয়নের প্রায় ৫০ হাজার মানুষ পানিবন্দি। ত্রাণ পাইছি মাত্র সাড়ে তিনশ। শুকনো খাবার পাই না। ভিজিএফ পাইছি সাত হাজার মানুষের। বানভাসিদের জন্য যে ত্রাণ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে তা অপ্রতুল।”

এদিকে, রহিমা বেগমের দুর্ভোগের কথা শুনে তাদের কাছে ত্রাণ সরবরাহ করা হয়েছে বলে জানান ভারপ্রাপ্ত উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ময়নুল ইসলাম।

জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, “আমরা এখন পর্যন্ত চারশ মেট্রিন টন জিআর চাল ছাড়াও ১৯ লাখ টাকা বরাদ্দ পেয়েছি। যেখান থেকে চার লাখ টাকার গো-খাদ্য ও দুই লাখ টাকার শিশু খাদ্যসহ ১৩ লাখ টাকার খাদ্য সামগ্রী বিতরণ করেছি। এছাড়াও আট হাজার শুকনো খাবার বন্যার্তদের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে। আরও তিন লাখ টাকা চেয়েছি আমরা। খবর পেলেই বন্যার্তদের কাছে পৌঁছে যাচ্ছি।”