আমাদের প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর:
নিজের খাবারই জোটে না, গোরুক কি খাওয়ামো
গাইবান্ধা প্রতিনিধি,
“তিনটা গোরু নিয়া বান্দের (বাঁধ) উপর কোনমতে চালা তুলি আছি। কিন্তু গোরুর পল (খড়) শ্যাষ হয়্যা গেছে। নিজের খাবারেই জোটেনা বাহে, এ্যাখোন গোরুক কি খাওয়ামো!”
দ্বিতীয় দফায় পানিবন্দি হয়ে গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার ব্রহ্মপুত্র নদের বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের বালাসী এলাকায় আশ্রয় নেওয়া ফুলছড়ির ভাষারপাড়া গ্রামের আব্দুল মালেক মিয়া (৬০) এভাবেই তার ভাষায় জানালেন তার দুর্ভোগের কথা।
তিনি আরও বলেন, বক্রা ইদোত (কোরবানি ঈদ) হাটোত গোরু বেচমো বলি এ্যদ্দিন পালনু। কিন্তু হাট তো এ্যাখোন ঠিকমত নাগে না। ব্যাপারিরাও এ্যাবার বাড়ির ওপর আসি করোনা বলি গোরুর দাম কম কয়। ব্যাপারিরা কয় এব্যার হাট বন্ধ। গরু কেনার মতো লোক নাই। বান আর করোনা বলি এ্যাবার হামার কপাল পুড়ে ফেলায়।
সরেজমিন ফুলছড়ি উপজেলার ব্রহ্মপুত্র বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের বালাসী থেকে সৈয়দপুর এলাকা পর্যন্ত ঘুরে গরু ছাগল নিয়ে মানুষের দুর্ভোগের এ চিত্র চোখে পড়ে। সংকীর্ণ বাঁধে টিনের চালা তুলে নিজেদের কোনমতে মাথা গোঁজার ঠাই করে নিয়েছেন প্রায় ৩শ পরিবার। তাদের অধিকাংশদেরকে গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগী নিয়ে একই চালের তলায় থাকতে হচ্ছে।
আব্দুল মালেক মিয়ার মতো এ বাঁধে আশ্রয় নেওয়া অমিছা বেগম, খয়বার মিয়া, হাসেম আলী, জাবেদুর রহমান একইভাবে জানালেন, গরু ছাগলের খাদ্য সংকটের কথা। কারুর কাছে সামান্য খড় মজুদ আছে। আবার কেউ বাজার থেকে ভুষি, গোখাদ্য কিনে খাওয়াচ্ছেন। তবে বেশিদিন খাদ্য কেনার সামর্থ্য তাদের নেই।
বুধবার প্রাণিসম্পদ অফিস থেকে সংক্রামক রোগ প্রতিরোধে টিকা দেয়া হচ্ছে বলে তারা জানান।
গাইবান্ধা জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. আব্দুস ছামাদ বলেন, জেলায় কোরবানি উপলক্ষে পশুর চাহিদা ৬১ হাজার। কিন্তু এবার খামারি ও পরিবারগুলো বাজারজাতকরণের জন্য ৭৭ হাজার ৫শ গরু ছাগল প্রস্তুত করেছেন।
“এরমধ্যে খামারিরা পালন করেছে ৫৩ হাজার ১শ এবং পরিবারগুলো পালন করেছে ২৪ হাজার ৪শ গরু ছাগল।”
করোনাভাইরাসের কারণে অনেকস্থানেই হাট বসছে না। এ পরিস্থিতিতে প্রাণিসম্পদ বিভাগ থেকে গাইবান্ধার সাত উপজেলায় অনলাইনে পশু বিক্রির ব্যবস্থা করেছে।
তিনি বলেন, বন্যা কবলিত গাইবান্ধা সদর, সাঘাটা, ফুলছড়ি ও সুন্দরগঞ্জ এলাকায় পশু খাদ্য সরবরাহের জন্য দুই লক্ষ টাকা বরাদ্দ পাওয়া গেছে। অতি দ্রুত এই পশু খাদ্য সরবারহ করা হবে। এছাড়া এসব এলাকায় ১১টি মেডিকেল টিম কাজ করছে।
তবে গাইবান্ধায় ব্রহ্মপুত্র ও ঘাঘট নদীর পানি গত ২৪ ঘণ্টায় ৯ সেন্টিমিটার করে কমেছে।
গাইবান্ধা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোখলেছুর রহমান জানান, শুক্রবার বিকাল ৩টায় ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বিপদসীমার ১০৯ সেন্টিমিটার ও ঘাঘট নদীর পানি বিপদসীমার ৮৪ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়।
“তবে করতোয়া নদীর পানি শুক্রবার বিকাল ৩টায় বিপদসীমার ১৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। ফলে গোবিন্দগঞ্জ ও পলাশবাড়ী উপজেলার করতোয়া নদী তীরবর্তী এলাকায় ঘরবাড়িতে পানি উঠতে শুরু করেছে।”
গাইবান্ধা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মাসুদুর রহমান জানান, জেলার বন্যায় চারটি উপজেলায় এ পর্যন্ত ৩ হাজার ৮৬ হেক্টর জমির পাট, আমন বীজতলা, আউশ ধান ও শাকসবজিসহ অন্যান্য ফসল পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে।
কুড়িগ্রামে কম বরাদ্দে বিপাকে জনপ্রতিনিধিরা
বানভাসীর সংখ্যার তুলনায় বরাদ্দ কম হওয়ায় বিপাকে পড়েছেন জনপ্রতিনিধিরা। প্রথম দফায় সরকারের পাশাপাশি কিছু বেসরকারি সংস্থা এগিয়ে এলেও দ্বিতীয় দফা বন্যায় তেমনভাবে কেউ এগিয়ে আসেনি। ফলে সাড়ে ৩ লাখ বানভাসী মানুষ রয়েছে চরম দুর্ভোগের মধ্যে।
চর রাজিবপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান কামরুল আলম বাদল বলেন, সরকার যে ত্রাণ দিচ্ছে তা পর্যাপ্ত নয়। আমরা অনেকের কাছে এখনো যেতে পারিনি। বরাদ্দ আরো বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।
কুড়িগ্রামে ডিসি রেজাউল করিম জানান, বন্যায় প্লাবিত এলাকায় প্রয়োজন অনুযায়ী শুকনো খাবার, শিশু ও গো-খাদ্য সরবরাহ করা হচ্ছে। এছাড়া আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে বিশুদ্ধ পানি সরবারহের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছ।
সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, দ্বিতীয়দফা বন্যায় ঘরবাড়ি তলিয়ে যাওয়ায় চরম দুর্ভোগে পড়েছে দ্বীপচরেরসহ জেলার মানুষজন। পরিবার-পরিজন, গরু-ছাগল নিয়ে রাস্তায় বা বাঁধে আশ্রয় নিয়ে মানবেতর জীবন কাটছে তাদের।
তেলিপাড়া গ্রামের বাসিন্দা মহুবর আলী বলেন, এক বুক পানি ভেঙে আমরা গত কয়েকদিন যাবত বাজার ঘাটসহ অন্যান্য কাজ করছি। এত পানি রাস্তার ওপর কোনো মতে কাপড় ও সান্ডেল হাতে নিয়ে এক কিলোমিটার রাস্তা আসলাম।
রাস্তায় বা বাঁধে যারা আশ্রয় নিয়েছে তারা কিছু ত্রাণ সহায়তা পেলেও দুর্গম চরের লোকজন এখনো ত্রাণ পায়নি বলে অভিযোগ উঠেছে।
পর্যাপ্ত শৌচাগারের অভাবে ভীষণ সমস্যায় ভুগছেন নারী ও কিশোরীরা।
বগুড়ার চরবাসী দুর্ভোগ, ‘গরু ছাগলেরও একই অবস্থা’
বগুড়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমান জানান, প্রথম দফার চাইতে দ্বিতীয় দফায় বন্যার প্রকোপ দ্বিগুণ। আগের বার সর্বোচ্চ পানি বৃদ্ধ ছিল বিপদসীমার ৬৭ সেন্টিমিটার উপরে প্রবাহ। আর বুধবার বিকেল ৪টায় পানি বিপদসীমার ১১৭ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়, যা বৃহস্পতিবার বিকাল ৬টায় বৃদ্ধি পেয়ে ১২৭ সেন্টিমিটার হয় এবং শুক্রবার তা বিপদসীমার ১২৮ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
“পানি প্রতিদিন বেড়েই চলছে। বাড়ছেই। বিগত বন্যা এক সপ্তাহ স্থায়ী হয়েছিল আর এবারের বন্যার আরো বেশি স্থায়ী।“
কুড়িপাড়ার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের উচু মাঠে কথা হয় জাহাঙগির আলি কাশেম ও মগোর আলির সাথে।
তারা জানালেন, ঘরে পানি উঠেছে তাই গরু ছাগল হাস মুরগি নিয়ে ঠাঁই নিয়েছেন স্কুল মাঠে। সেখানেই পশুর সাথে পলিথিনের ছাউনি করে বাস করছেন তারা।
টেংড়া কুড়া চরের সামাদ জানান, খাবার নেই পেটে, গরু ছাগলেরও একই অবস্থা।
“তাই চিনতাই আছি কি করব।”
পাকের দহ চরের জব্বার জানান, বাজার করতে নৌকা নিয়ে অনেক দূর সারিয়াকান্দিতে যেতে হয়। নৌকা ভাড়া কোথায়, কষ্টে আছি খুবই।
তিনি আরও বলেন, চৌকি থেকে নামলেই পানি। ঘরটাও ভালো না-বৃষ্ট হলেই পানি পড়ে। এর উপর আবার সাপের উপদ্রুপ। রাত জেগে থাকি, ঘুম আসে না।
ধুনটের বৈশাখী চরের মুন্নাফ আলী বলেন, চর ভাংতে শুরু করার বৈশাখী থেকে পশ্চিম পাড়ে হাওড়াখালীতে চলে এসেছি।
ওই চরের শরিফুল, জসিম ও রাংগা জানান, ভাঙনে চর অর্ধেক হয়ে গেছে।
বৈশাখী চরের সাহেব আলী ও ভুলু বলেন, ঘরে পানি ওঠায় পশ্চিম পাড়ে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে চলে এসেছি। দিন কাটছে কোনোভাবে।
শেরপুরে আঞ্চলিক মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ
শেরপুর-জামালপুর আঞ্চলিক মহাসড়কের পোড়া দোকান ও শিমুলতলী ডাইভারসন সড়কের ওপর দিয়ে প্রবল বেগে পানি প্রবাহিত হওয়ায় শুক্রবার সকাল থেকে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে।
নদী তীরবর্তী কলুরচর-বেপারীপাড়া গ্রামের অধিকাংশ ঘর-বাড়িতে পানি উঠায় ওই গ্রামের ৩৮০টি পরিবার স্থানীয় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ওই এলাকার পাশে জামালপুর শহর রক্ষা বাধে আশ্রয় নিয়েছে।
এদিকে, কামারেরচর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমান হাবিব জানান,ওই ইউনিয়নের ৪টি গ্রামের নিম্নাঞ্চল বানের পানির নিচে তলিয়ে গেছে।
“কুলুরচর-বেপারীপাড়ার অনেক ঘর-বাড়িতে পানিতে তলিয়ে গেছে। তাই অনেক মানুষ জামালপুর শহর রক্ষা বাঁধ, রাস্তার পাশে ও স্কুল ঘরসহ বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নিয়েছে। এছাড়া নদী তীরের ডাকপাড়া, ভাগলগড়, ডাকপাড়া, চুনিয়ারচর গ্রামের অনেক ঘর-বাড়ি বর্তমানে পানির নিচে। চরপক্ষীমারী ইউনিয়নের অনেক মানুষ পানিবন্দি হয়ে অসহায় অবস্থায় আছে।”
ওই ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মো. জাফর মিয়া বলেন, আমার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের মধ্যে প্রায় ৫০০ ঘর-বাড়ি পানির নিচে ডুইবা গেছে। অহন বর্তমান ৩৮০ পরিবার বেড়ি বাঁধে ও আশ্রয় কেন্দ্র স্কুলসহ বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নিয়েছে।
“১৫ দিন ধরে মানুষ কষ্ট করতাছে। খোলা আকাশের নিচে পলিথিন দিয়ে ঘর বানিয়ে অসহায় অবস্থায় আছে। টিউবওয়েল ও লেট্রিন ডুবে গেছে। কোনো ওষুধপত্র এবং কোনো ত্রাণ আমরা পাই নাই।”