প্রধানমন্ত্রীর সহায়তার তালিকায় ধনীদের নাম

গাইবান্ধায় পাকা ঘর, মিল-চাতাল ও বিঘা বিঘা সম্পত্তির মালিক হয়েও দরিদ্রদের জন্য প্রধানমন্ত্রীর সহায়তার তালিকায় অনেকের নাম উঠেছে।

তাজুল ইসলাম রেজা গাইবান্ধা প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 July 2020, 02:25 PM
Updated : 9 July 2020, 02:25 PM

আবার অনেক হতদরিদ্র রয়েছেন যাদের নাম সাত শতাধিক লোকের এই তালিকায় স্থান পায়নি।  

প্রধানমন্ত্রীর উপহারের আড়াই হাজার টাকার করে দেওয়ার জন্য গাইবান্ধার সাদুল্লাপুর উপজেলার রসুলপুর ইউনিয়নে ৭১১ জনের তালিকা করা হয়েছে।

স্বচ্ছল পরিবারের অনেকের মতো এই তালিকায় উঠেছে রসুলপুর ইউনিয়ন পরিষদ ভবনের পার্শ্ববর্তী ছান্দিয়াপুর গ্রামে জাহাংগীর আলমের একমাত্র ছেলে আবদুল্যা আল মামুনের (২৬) নাম।  

ছান্দিয়াপুর বাজারে জাহাংগীর আলমের রয়েছে ধান ভাঙ্গানো মিল ও চাতাল। রয়েছে প্রায় ৪০ বিঘা কৃষি জমি। এই তালিকার ৩৪৭ নম্বরে আবদুল্যার নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

তালিকার ৩৪৬ ও ৩৫০ নম্বরে রয়েছে একই গ্রামের ২০ বিঘা কৃষি জমি ও হাফ বিল্ডিং বাড়ী ওয়ালা গৃহস্থ দুই সহদর আতোয়ার রহমান ও আলতাফ হোসেনেরও নাম। এই রকম অনেক সচ্ছল ব্যক্তি এই তালিকাভুক্ত হয়েছে।

এছাড়াও এই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যের বিরুদ্ধে তাদের স্বজন ও ঘনিষ্টদের নাম তালিকায় তোলা হয়েছে।  

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের অনুসন্ধানে এই চিত্র উঠে এসেছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, রসুলপুর ইউপি চেয়ারম্যান রবিউল করিম দুলা তার ১০ জন আত্মীয়-স্বজনকে নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে এই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছেন। তার মধ্যে ১৬৬ নম্বরে তার ফুফাত ভাইয়ের স্ত্রী আনোয়ারা বেগম, ২৫৯ ও ২৬০ নম্বরে আপন দুই ভাইয়ের স্ত্রী লিপি বেগম ও ফিরোজা বেগম, ২৬২ নম্বরে ছোট বোন বুলবুলি বেগম, ২৬৩ ও ২৬৫ নম্বরে দুই চাচা চাঁন মিয়া ও সিরাজ উদ্দিন, ২৬৯ ও ৬৩৫ নম্বরে দুই চাচাত ভাই রায়হান সরকার ও কামরুজ্জামান, ৬৩৭ নম্বরে ফুফাত ভাই আমিনুল ইসলাম এবং ৬২৮ নম্বরে ফুফাত ভাইয়ের ছেলের স্ত্রী শারমিন আক্তার রয়েছেন।

তালিকায় নাম ওঠা আতোয়ার রহমানের বাড়ি

এছাড়া ৬২৫ নম্বরে রয়েছে ইউপি চেয়ারম্যানের ব্যক্তিগত সহকারী হারুনের নাম এবং ২২৪, ২২৫ ও ০৩ নম্বরে যথাক্রমে তার মা হামিদা, দুই ভাই ফারুক ও আসাদুল ইসলাম ঈদুলের নাম রয়েছে। 

তালিকার ১৭ নম্বরে ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য আব্দুল লতিফের চাচা আজগর আলী মন্ডল, ৭ নম্বরে আজগর আলী মন্ডলের স্ত্রী জেসমিন আক্তার ও ৫ নম্বরে আজগর আলী মন্ডলের মেয়ে আফিফা আক্তারের নাম তোলা হয়েছে। ৩১ নম্বরে রয়েছে ইউপি সদস্য আব্দুল লতিফের আরেক চাচাত ভাই দীন মোহাম্মদের নাম।

তালিকার ১৮৪ নম্বরে রয়েছে ৬ নম্বর ওর্য়াড সদস্য আতোয়ার মিয়ার স্ত্রী মোরশেদা বেগমের নাম। ৪, ৫ ও ৬ নম্বর ওয়ার্ডের সংরক্ষিত সদস্য লাইলী বেগমের ছেলে-মেয়েসহ একাধিক অত্মীয় স্বজনের নাম এই তালিকায় রয়েছে। 

তালিকা মিলিয়ে দেখা যায় নানা কৌশলে ইউপি চেয়ারম্যান ও সদস্যরা প্রধানমন্ত্রীর এই মানবিক সহায়তার অর্থ লোপাটের চেষ্টা করেছেন।  

৬৭০ নম্বরে রসুলপুর ইউনিয়ন ছাত্রলীগ সভাপতি সুলতানকে দিনমজুর হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। শুধু তাই নয় তালিকায় ২৯৬ ও ৫৯১ নম্বরে দুইবার রয়েছে তার শ্বশুর আতোয়ারের নাম।  ৬৭২ নম্বরে তার বড়ো ভাইয়ের স্ত্রী সাবিনা বেগম ও ৫৯০ নম্বরে চাচা জাহেদুল হক রয়েছেন। এভাবে এই তালিকায় তার ১০ জন আত্মীয় স্বজনের নাম দিনমজুর ও নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে অর্ন্তভূক্ত করা হয়েছে।

এমনকি ইউনিয়নের বাইরে গিয়েও দুজনের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে এই ইউনিয়নের তালিকায়। ৪৭ ও ৪৯ নম্বরে রয়েছে পার্শ্ববর্তী জামালপুর ইউনিয়নের হামিন্দপুর গ্রামের দুই ব্যক্তির নাম।

অপরদিকে, এই ইউনিয়নের অনেক হতদরিদ্র আছেন যাদের নাম এই তালিকায় স্থান পায়নি। 

ছান্দিয়াপুর বসনিয়া পাড়া গ্রামের সিদ্দিক হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বাড়ি ভিটে ছাড়া আমার কোনো কৃষি জমি নেই। দিনমুজুরি করে সংসার চালাই। করোনাকালে এলাকায় কোনো কাজ না থাকায়, রিলিফ বা সাহায্যের জন্য চেয়ারম্যানের কাছে অনেক বার গিয়েছি; কিন্তু তিনি বারবার ফেরত পাঠিয়েছেন।”

এইক গ্রামের একরামুল হোসেন বলেন, তিনি বগুড়া শহরে রিকশা চালিয়ে সংসার চালান; কিন্তু করোনাভাইরাস মহামারীতে দীর্ঘদিন থেকে গ্রামেই আছেন।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “শুনেছি সরকার আমাদের মতো লোকদের সাহায্য করছে। চেয়ারম্যান-মেম্বারদের কাছে সেই সাহায্যের জন্য কতবার গেলাম; কিন্তু আমাদের কিছুই দেন নাই।”

তালিকায় নয়-ছয় আর স্বজনপ্রীতির এমন ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করে রসুলপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি আব্দুল গফুর মিয়া বলেন, “ত্রাণ বিতরণ আর দুই হাজার ৫০০ টাকার তালিকা যে অনিয়ম হয়েছে তাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্দেশ্য ব্যহৃত হচ্ছে।”

তিনি এসব অনিয়মের সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান।

ইউপি চেয়ারম্যানের ব্যক্তিগত সহকারী হারুন বলেন, “গরীব হওয়ায় এই তালিকায় তাদের নাম ইউপি চেয়ারম্যান ও সরকারদলীয় কোটায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।” 

ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য আব্দুল লতিফ বলেন, তার আত্মীয় স্বজনদের নাম এই তালিকায় কীভাবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে তা তিনি জানেন না।  

৬ নম্বর ওর্য়াড সদস্য আতোয়ার মিয়া বলেন, “সবাই এই সহায়তা পাবার যোগ্য; তাই এই তালিকায় ভুক্ত হয়েছে।”

রসুলপুর ইউনিয়ন ছাত্রলীগ সভাপতি সুলতান বলেন, “আমি ও আমার আত্মীয়-স্বজনরা দরিদ্র। এছাড়া এই আত্মীয়-স্বজনরাই আমাকে দলীয় কর্মকাণ্ডে সহায়তা করেন। তাই তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।”

ছান্দিয়াপুর গ্রামের আতোয়ার রহমান বলেন, “আমার নাম কীভাবে এই তালিকাভুক্ত হয়েছে আমি জানি না।”

একই গ্রামের আবদুল্যা আল মামুনকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।

তাবে তার বাবা জাহাংগীর আলম বলেন, তার ছেলে চেয়ারম্যানের সঙ্গে উঠাবসা করেন। এই কারণে এই তালিকায় তার ছেলের নাম তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।

রসুলপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান রবিউল করিম দুলা বলেন, “সহায়তা পাবার যোগ্যরাই তালিকাভুক্ত হয়েছে।”

সাদুল্লাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. নবীনেওয়াজ বলেন, অভিযোগ পেলে অনিয়মের বিষয়টি দ্রুত খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

গাইবান্ধা-৩ (সাদুল্লাপুর-পলাশবাড়ী) আসনের সংসদ সদস্য উম্মে কুলসুম স্মৃতি বলেন, “এ অনিয়মের সাথে জড়িতদের কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। তদন্ত করে এর সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

গাইবান্ধার ৭২ হাজার হতদরিদ্র ও কর্মহীন পরিবারের জন্য এই সহায়তা দেওয়া হবে।