গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম ও জমালপুরের শত শত পরিবার বাড়িঘর ছেড়ে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ, সড়ক, রেল লাইনসহ উঁচু স্থানে আশ্রয় নিয়েছে। বন্যা কবলিত এলাকায় খাবার পানি ও পয়ঃনিষ্কাশনের সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছে।
উজানের পানি নেমে এখন দেশের মধ্যাঞ্চলেও বন্যা দেখা দিয়েছে। পদ্মা নদীর পানি গোয়ালন্দ পয়েন্টে বিপৎসীমার প্রবাহিত হচ্ছে।
ফরিদপুরের তিনটি ইউনিয়নের অনেক রাস্তাঘাট, ফসলের জমি পানিতে তলিয়ে গেছে। কয়েকশ পরিবার পানিবন্দি হয়েছে।
আগামী এক দিনে উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমের ছয় জেলায় বন্যা পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকলেও মধ্যাঞ্চলের ছয় জেলায় পরিস্থিতির অবনতির আভাস দিয়েছে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র।
দেশের নদ-নদীগুলোতে পানি উন্নয়ন বোর্ডের ১০১টি পর্যবেক্ষণ পয়েন্টের মধ্যে শুক্রবার ৬৬টি পয়েন্টেই পানি বেড়েছে। এর মধ্যে ১৬টি পয়েন্টে বিপৎসীমার উপরে বয়ে যাচ্ছে নদী।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম প্রতিনিধিদের পাঠানো সংবাদে কয়েকটি জেলার বন্যা পরিস্থিতি উঠে এসেছে।
গাইবান্ধা
গাইবান্ধার চার উপজেলার ২৬টি ইউনিয়নের প্রায় দেড় লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়েছে। বাড়িঘরে পানি ওঠায় শত শত পরিবার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ, সড়ক, রেল লাইনসহ উঁচু স্থানে আশ্রয় নিয়েছে। বকন্যা কবলিত এলাকায় বিশুদ্ধ খাবার পানি বা পয়ঃনিষ্কাশনের সমস্যা প্রকট হয়েছে। তার উপর এসব এলাকায় বখাটেদের উৎপাত বেড়ে গেছে।
বন্যা কবলিত এলাকায় গত নয় দিনে ত্রাণও বিতরণ করা হয়নি বলে স্থানীয়রা অভিযোগ করলেও জেলা প্রশাসন অস্বীকার করেছে।
ওই বাঁধে আশ্রিতা মোছা. তহুরা বেগম বলেন, এই বাঁধে আশ্রিতদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে খাবারের বিশুদ্ধ পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন। মহিলারা সবচেয়ে বেশি কষ্ট ভোগ করছেন।
একইই বাঁধে আশ্রিতা গৃহবধূ নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “কিছু বখাটেদের উৎপাতে সন্ধ্যার পর মেয়েদের খুব সমস্যা পোহাতে হচ্ছে।”
সাঘাটার ভরতখালী ইউনিয়নের ভাঙ্গামোড় গ্রামের বন্যা কবলিত একাধিক পরিবারের সদস্য বলেন, এখনও তারা কোনো সরকারি সাহায্য পাননি।
কঞ্চিপাড়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান লিটন মিয়া বলেন, “আমার ইউনিয়নে ৮ হাজারের বেশি মানুষ পানিবন্দি হয়েছেন। ত্রাণ দেওয়ার জন্য উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তালিকা করতে বলায় তালিকা তৈরি করছি।”
সাঘাটা উপজেলার উড়িয়া ইউপি চেয়ারম্যান মহাতাব উদ্দিন সরকার বলেন, এখনও তিনি কোনো বরাদ্দ পাননি। তাই ত্রাণ বিতরণ করা হয়নি।
একই কথা বলেন এই উপজেলার ফুলছড়ি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুল গফুর মন্ডল ও সুন্দরগঞ্জের তারাপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলাম।
সদর উপজেলার কামারজানী ইউপি চেয়ারম্যান আবদুস সালাম জাকির বলেন, বৈঠকে সব ইউপি সদস্য উপস্থিত না হওয়ায় গত সোমবার বরাদ্দ পেলেও এখনও চাল বিতরণ শুরু করতে পারেননি।
ফুলছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবু রায়হান দোলন বলেন, “আমাদের আগেরই জিআরের চাল ছিল, সেগুলোই দিচ্ছি। করোনার সময় থেকে আসা বরাদ্দ ও বন্যার্তদের জন্য আসা ত্রাণের বরাদ্দ এক হয়ে গেছে। দুটো একসঙ্গেই দেওয়া হচ্ছে।”
জেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ রেজওয়ানুল হোসাইন বলেন, শুক্রবার থেকে তারা অস্থায়ী শৌচাগার স্থাপনের কাজ শুরু করেছেন। এছাড়া পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট জনপ্রতিনিধির কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে।
জামালপুর
জেলার সাতটি উপজেলার ৪৩টি ইউনিয়ন ও আটটি পৌরসভার বিরাট এলাকা প্লাবিত হয়েছে।
শুক্রবার যমুনার পানি বাহাদুরাবাদ ঘাট পয়েন্টে বিপৎসীমার ৭৪ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে।
জামালপুর জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা নায়েব আলী বলেন, বন্যায় জেলার ৭টি উপজেলার ৪৩টি ইউনিয়ন ও ৮টি পৌরসভার বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হওয়ায় জেলার ৮৫ হাজার পরিবার পানিবন্দি।
“সরকারি হিসাবে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত জেলায় বন্যার পানিতে ডুবে সাতজন ও সাপের কামড়ে একজনের মৃত্যু হয়েছে। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৫০টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ২৫টি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান।
বন্যা কবলিত এলাকায় শুকনো খাবার, বিশুদ্ধ পানি ও গো খাদ্যের সংকট দেখা দিয়েছে বলে ভুক্তভোগীরা জানান।
ইসলামপুরের পশ্চিম বামনার আবুল কাশেম বলেন, বানভাসী মানুষ আর গৃহপালিত পশু একসাথে বিভিন্ন বাঁধ ও উঁচু স্থানে আশ্রয় নিয়েছে। শুকনো খাবার, বিশুদ্ধ পানি ও গো খাদ্যের সংকট দেখা দিয়েছে।
সাপধরির আজিজুর রহমান বলেন, “বানভাসিদের জন্য সরকারি ত্রাণ তৎপরতা প্রয়োজনের তুলনায় একেবারেই অপ্রতুল।”
কুড়িগ্রাম
কুড়িগ্রামে ব্রহ্মপুত্রের পানি ধীরে ধীরে কমলেও ধরলা নদীর পানি আবার বাড়তে থাকায় সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে।
গত দুদিনের ভারি বর্ষণে সড়ক ও বাঁধের উপর আশ্রিত মানুষের দুর্ভোগ বেড়েছে। শুকনো খাবার, বিশুদ্ধ পানি ও গো-খাদ্যের সংকট আরও প্রকট হয়েছে। দেখা দিয়েছে চিকিৎসা সমস্যা। বন্যা কবলিত পরিবারের সদস্যরা পয়ঃনিষ্কাশন নিয়ে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন। নারী, শিশু-কিশোরী ও বৃদ্ধদের কষ্ট হচ্ছে সবচেয়ে বেশি।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুল ইসলাম নদ-নদীর পানি প্রবাহের এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, জেলার ৫৬টি ইউনিয়নের ৫৭৯টি গ্রাম বন্যার পানিতে নিমজ্জিত রয়েছে। প্রায় ১৭ হাজার পরিবারের ঘরবাড়ি বন্যার পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নদী ভাঙনের শিকার হয়েছে পাঁচ শতাধিক পরিবার।
জেলা ত্রাণ ও পূণর্বাসন কর্মকর্তা দিলীপ কুমার সাহা বলেন, পর্যাপ্ত ত্রাণ রয়েছে। চাহিদা মোতাবেক পর্যাক্রমে তা দেওয়া হচ্ছে। এ পর্যন্ত ৩০২ মেট্রিক টন চাল ও ৩৮ লাখ ৬৬ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে; যা বিতরণের কাজ চলমান রয়েছে।
কুড়িগ্রাম জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপ-পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান প্রধান বলেন, জেলায় ৯ হাজার ৭৮৯ হেক্টর জমির ফসল বন্যার পানিতে নিমজ্জিত রয়েছে। এর মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত বোরো ধানের বীজতলা ৫৩২ হেক্টর, আউশ ধান এক হাজার ৯৫৫ হেক্টর, শাক সবজি ৮৬০ হেক্টর, তিল ৩০২ হেক্টর, কাউন ২০ হেক্টর, চিনা ১৪০ হেক্টর, মরিচ ১৪০ হেক্টর এবং পাট ক্ষেত ৫ হাজার ৮৪০ হেক্টর। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের তালিকা তৈরির কাজ চলছে।
কুড়িগ্রাম জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী সায়হান আলী বলেন, এ পর্যন্ত বন্যার্তদের মাঝে ২৫ হাজার পানি বিশুদ্ধকরণ কিট সরবরাহ করা হয়েছে। নতুন করে বন্যাদুর্গদের সহায়তায় ১২টি টিউবওয়েল এবং ১২টি শৌচাগার স্থাপন করা হয়েছে। ৪৩৫টি নলকূপ মেরামত করে দেওয়া হয়েছে। এছাড়া বন্যার পানিতে ডুবে যাওয়ায় ছয় শতাধিক নলকূপের পাদদেশ উঁচু করে দেওয়া হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, বন্যার্তদের মাঝে প্রতিদিন বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। এ জন্য দুটি বিশুদ্ধ পানির প্ল্যান্টের ভ্রাম্যমাণ গাড়ি ঘুরে ঘুরে পানি সরবরাহ করছে। প্রতিটি বিশুদ্ধ পানির প্ল্যান্ট থেকে প্রতি ঘণ্টায় দুই হাজার লিটার পানি সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে।
ফরিদপুর
শুক্রবার জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের গেজ মাস্টার ইদ্রিস আলি জানান, গোয়লন্দ পয়েন্টে পদ্মা নদীর পানি বিপৎসীমার ৪৬ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে।
এছাড়া সদর উপজেলার তিনটি ইউনিয়ন নর্থ চ্যানেল, ডিক্রিরচর ও আলীয়াবাদের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে।
পুরাতন মোহনমিয়ার হাটের একটি সড়কের ২০ মিটার পানিতে ধ্বসে গেছে। গোলডাঙ্গী সড়ক, বারান বিশ্বাসের ডাঙ্গী এলাকার সড়ক, কাইমুদ্দীন মাতুব্বরের ডাঙ্গি এলাকার তিনটি সড়ক পানির নিচে তলিয়ে গেছে।
নর্থ চ্যানেল ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মোস্তাকুজ্জামান বলেন, “প্রতিদিনেই পানি বাড়ছে। তবে পানি বাড়ার গতি কম। যে জমি তলিয়ে গেছে তাতে আউশ ধান সম্পূর্ণভাবে বিনষ্ট হয়ে গেছে।”
ডিক্রির চর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মেহেদী হাসান বলেন, পানি বেড়ে তার ইউনিয়নে ৩৩০ একর জমির ভুট্টা, আউশ ধান ও বাদাম তলিয়ে গেছে।
আলীয়াবাদ ইউপি চেয়ারম্যান ওমর ফারুক বলেন, “ইউনিয়নের বেড়িবাঁধের বাইরে অবস্থানরত তিন শতাধিক পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। সাদীপুর ও গদাধরডাঙ্গী গ্রামের পানিবন্দি হওয়া ওই তিনশ পরিবার মানবেতর জীবনযাপন করছে।”
ফরিদপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সুলতান মাহমুদ বলেন, চরভদ্রাসনের সদর ইউনিয়নের বালিয়াডাঙ্গী ভাঙ্গার মাথায় বালিয়া ডাঙ্গি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে নদীর তীরের ভেঙে যাওয়া ৩০ মিটার অংশে বালির বস্তা ফেলে ভাঙন রোধ করা হয়েছে। এ কাজে বালিভরতি ৬০০ জিও ব্যাগ ব্যবহার করা হয়েছে।