২০১৬ সালের ১ জুলাই রাতে হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গিরা ঢোকার পর সেখানে অভিযানে যান সে সময়ের মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী কমিশনার রবিউল। এ অভিযানে প্রাণ যায় তার।
তখন তার ছেলে সাজিদুল করিম সানির বয়স ছিল পাঁচ বছর। স্ত্রী উম্মে সালমা ছিলেন সন্তাসম্ভবা।
সেই সামির বয়স এখন আট বছর। এ ছেলে সম্পর্কে উম্মে সালমা বলেন, “জঙ্গি হামলায় রবিউল নিহত হওয়ার পর থেকেই সামি কারো আদরও সহ্য করতে পারত না। তার ভেতরে এমন একটা বিষয় কাজ করত।
“কেউ কোনো গিফট দিলে সেটাও নিতে চাইত না। বলত, ‘সবাই আমাকে শুধু কষ্ট দেয়।’ এখনও বাবার স্মৃতি ভুলতে পারেনি।”
সামি একটি কিন্ডার গার্ডেনে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ছে এখন।
রবিউলের বাড়ি মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার কাটিগ্রাম গ্রামে। ২০০৬ সালে মারা যান রবিউলের বাবা আবদুল মালেক। একটি বেসরকারি সংস্থায় চাকরি করতেন তিনি। তার অকাল মৃত্যুতে বিপাকে পড়ে এ পরিবার। রবিউল পুলিশ বাহিনীতে যোগ দেওয়ার পরই খানিকটা ঘুরে দাঁড়ায় পরিবারটি।
স্থানীয় এবং পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩০তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন রবিউল। তিনি বাংলায় স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করেন। এরপর বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে পুলিশ বিভাগে যোগ দেন।
ছোটবেলা থেকে রবিউল খেলাধুলা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। প্রতিবন্ধী শিশুদের তিনি ভালোবাসতেন। এজন্য সমাজের অবহেলিত শারীরিক ও মানসিক সক্ষমতাহীন শিশু ও কিশোরদের জন্য বাড়ির কাছের বাসাই গ্রামে নিজের খরচে ২০১১ সালে প্রতিষ্ঠা করেন বিকনিং লাইট অর্গানাইজেশন অব ম্যানকাইন্ড অ্যান্ড সোসাইটি নামের বিশেষায়িত বিদ্যালয়। এ বিদ্যালয়ে বর্তমানে ৪৭ জন প্রতিবন্ধী শিশু লেখাপড়া করছে। এছাড়াও তিনি গ্রামের শিশুদের লেখাপড়ার জন্য ‘নজরুল বিদ্যা সিঁড়ি’ নামে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন।
নিহত রবিউলের স্ত্রী উম্মে সালমা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে সাভার বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। ২০১৭ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে চাকরিতে যোগ দেন সালমা। তিনি ঢাকার ধামরাই উপজেলার দেপসাই এলাকায় বাবার বাড়িতে থাকেন এখন।
স্বামীকে নিয়ে গর্বিত উম্মে সালমা বলেন, “স্বামী হারানোর শোক সারা জীবনই আমাকে বইতে হবে। তবে শান্তনা এই যে, আমার স্বামী দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করেছেন। কয়জনের স্ত্রীর ভাগ্যে সেটা জোটে?”
রবিউলের বৃদ্ধ মা করিমুন নেছা কাটিগ্রামেই থাকেন। সন্তান হারানোর কষ্টটা চার বছরেও ভুলতে পারেননি বৃদ্ধ মা করিমুন নেছা।
তিনি বলেন, “ঢাকা থেকে বাড়িতে ঢোকার সময় মা মা বলে ডাক দিতো। বুকে জড়িয়ে ধরত। এখনও সেই ডাক কানে ভাসে।”
রবিউলের ছোট ভাই শামসুজ্জামান শামসও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর শেষ করে চাকরি করছেন।
শামসুজ্জামান জানান, প্রতিবন্ধী শিশু-কিশোরদের বিশেষায়িত স্কুলে একটি আবাসিক ভবন এবং হাসপাতাল নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন তার ভাই। অসচ্ছলদের জন্য বৃদ্ধনিবাস গড়তে চেয়েছিলেন।
রবিউল মারা যাবার সময় উম্মে সালমার সেই অনাগত সন্তানটির বয়স এখন চার বছর। যার কাছে বাবা মানে অনেকগুলো গল্প।