বর্ষণ-ঢলে বন্যাকবলিত উত্তরের তিন জেলার নিম্নাঞ্চল

টানা বর্ষণ ও উজানের ঢলে উত্তরের জেলা কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা ও নীলফামারীর নিম্নাঞ্চলে বন্যা দেখা দিয়েছে।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 June 2020, 03:41 PM
Updated : 26 June 2020, 05:07 PM

এই তিন জেলার বন্যাকবলিত এলাকার হাজার হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।

শুক্রবার তিস্তা, ধরলা ও ব্রহ্মপুত্রের পানি বিপদসীমার উপর প্রবাহিত হয়।

আগামী ২৪ ঘণ্টায় বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হবে বলে জানিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র।

শুক্রবার কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আরিফুজ্জামান ভুঁইয়া জানান, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, জামালপুর, সিরাগঞ্জ, বগুড়া, টাঙ্গাইল, রাজবাড়ী ও মুন্সিগঞ্জে স্বল্পমেয়াদী বন্যা দেখা দিতে পারে।

ব্রহ্মপুত্র ও যমুনার পানি আগামী ১০ দিন বাড়তে পারে বলেও বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানিয়েছে।

কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি জানান, প্রবল বর্ষণ ও উজানের ঢলে শুক্রবার ধরলা ও ব্রহ্মপুত্রের পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। এই দুই নদীর অববাহিকার দুই শতাধিক চর প্লাবিত হয়ে অন্তত ৫০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়েছে।

কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুল ইসলাম জানান, শুক্রবার বিকালে ধরলা বিপদসীমার ১৩ ও ব্রহ্মপুত্র বিপদসীমার ৯ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে।

“পানি বাড়ছে তিস্তা ও দুধকুমারেও। ফলে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে। দুপুর ১২টায় এ দুটি নদীর পানি বিপদসীমা অতিক্রম করে বৃদ্ধি অব্যাহত আছে।”

তিনি আরও বলেন, পানি যে হারে বাড়ছে তাতে জেলার বন্যা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি ঘটতে পারে। কুড়িগ্রামের শহর রক্ষা বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ সাম্প্রতিক সময়ে সংস্কার করায় এবার ধরলার পানি শহরে প্রবেশ করতে পারবে না। আর পানি বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে নদী ভাঙনের মাত্রা কিছুটা কমেছে।

“এছাড়া কিছু কিছু ভাঙন কবলিত এলাকায় আমরা জরুরিভিত্তিতে কাজ অব্যাহত রেখেছি। কুড়িগ্রামের ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, দুধকুমারসহ ১৬টি নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় প্রায় দুই শতাধিক চর ও দ্বীপচরের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এসব এলাকার বহু ফসল ও গ্রামীণ সড়ক নিমজ্জিত হয়েছে।”

শুক্রবার সরেজমিন দেখা যায়, বন্যাকবলিত এলাকায় পাট, সবজি ও বীজতলা নিমজ্জিত হয়েছে। বহু গ্রামীণ সড়ক ভেঙে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছে। যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে নৌকা ও কলাগাছের ভেলা ব্যবহার করছে চরবাসী। শুকনো জায়গার অভাবে অনেকেই রান্না করতে পারছে না। প্রবল বৃষ্টির মধ্যে রাস্তার উপর চালা করে অনেকে আশ্রয় নিয়েছে।

ব্রহ্মপুত্রের চর মশালের চরের বাসিন্দা মুসা মিয়া, হায়দার আলী ও ভগবতির চরের জাহাঙ্গীর আলম, মানিক, ফয়জার রহমান জানান, চরের অধিকাংশ ঘর-বাড়িতে পানি উঠেছে। অনেকেই উঁচু ভিটায় থাকলেও নিচু ভিটার বাসিন্দারা নৌকা ও চৌকির উপর আশ্রয় নিয়েছে। কেউ কেউ নিকটবর্তী আশ্রয়কেন্দ্র ও স্কুলে আশ্রয় নিয়েছে।

গ্রামের রাস্তাগুলো ভেঙে গর্ত হওয়ায় চলাচল করা যাচ্ছে না বলে জানান নওয়াবশ গ্রামের শহিদুল ইসলাম।  

জেলা কৃষি বিভাগের উপ-পরিচালক মোস্তাফিজার রহমান জানান, ইতিমধ্যে চরাঞ্চলের নিচু এলাকাগুলো প্লাবিত হয়ে বাড়িঘরে পানি ঢুকতে শুরু করেছে। পাট, ভুট্টা, সবজি ক্ষেত ও বীজতলা, এবং তিল, আউশ ধান ও কাউনের ক্ষেত তলিয়ে গেছে।

কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক মো. রেজাউল করিম জানিয়েছেন, বন্যা মোকাবেলার জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সভা করে ভাঙনের শিকার পরিবারগুলোকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়ার জন্য উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

গাইবান্ধা প্রতিনিধি জানান, বিভিন্ন নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পেলেও এখনও বিপদসীমার সামান্য নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তিস্তা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, করতোয়া ও ঘাঘট নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় সুন্দরগঞ্জ, সদর, সাঘাটা ও ফুলছড়ি উপজেলার চরাঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকার পাট, কাউন, চিনাসহ বিভিন্ন ফসল ক্ষেত ডুবে গেছে।

এছাড়া চর এলাকায় নিম্নাঞ্চলের রাস্তাঘাট ঘরবাড়িতেও পানি উঠতে শুরু করেছে।

গাইবান্ধা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মোখলেছুর রহমান বলেন, পানি এখনও বিপদসীমার নিচে রয়েছে। তবে বৃষ্টিপাত হলে এবং পানিবৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে ২৪ ঘণ্টায় জেলার বিভিন্ন নদনদী বিপদসীমা অতিক্রম করতে পারে।

গাইবান্ধা পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, শুক্রবার বিকাল ৩টা পর্যন্ত তিস্তামুখঘাট পয়েন্টে ২৮ সেন্টিমিটার পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ১ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে।

ফুলছড়ি উপজেলার উড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মহাতাব উদ্দিন বলেন, পানি বৃদ্ধি কারণে নিম্নাঞ্চলের বেশ কিছু এলাকার ফসলি জমি তলিয়ে গেছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে অনেক মানুষ। পানি বৃদ্ধির সাথে সাথে গত কয়েকদিনের ভাঙনে উড়িয়া ইউনিয়নের উত্তর উড়িয়া ও কাবিলপুর এলাকার ৪৬টি পরিবার নদী ভাঙনে ক্ষতির শিকার হয়েছে।

নীলফামারী প্রতিনিধি জানান, শুক্রবার সকাল থেকে তিস্তা ব্যারাজের নীলফামারীর ডালিয়া পয়েন্টে বিপদসীমার ২০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড ডালিয়া ডিভিশনের বন্যা পূর্বাভাস সর্তকীকরণ কেন্দ্র জানায়, শুক্রবার সকাল ৬টায় নদীর পানি বিপদসীমার ২০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। সকাল ৯টার দিকে দুই সেন্টিমিটার কমে বেলা পৌনে ৩টা পর্যন্ত বিপদসীমার ১৮ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। তবে বিকাল ৩টায় আবার ২ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপদসীমার ২০ সেন্টিমিটার উপর যায়।  

পানি উন্নয়ন বোর্ড ডালিয়া ডিভিশনের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রবিউল ইসলাম বলেন, ভারতে ভারি বৃষ্টিপাত হওয়ায় গত ২০ জুন তিস্তার পানি বৃদ্ধি পেয়ে তিস্তা ব্যারাজের ডালিয়া পয়েন্টে বিপদসীমার ২০ সেন্টিমিটার  উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এরপর পানি কমে এক সপ্তাহ বিপদসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়। তবে গত ২৪ জুন থেকে ভারি বৃষ্টিপাত হওয়ায় পানি আবার বাড়তে থাকে।

গত ৪৮ ঘণ্টায় ২৪০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে বলে তিনি জানান।

“বর্তমান নদীর পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় তিস্তা ব্যারাজারে সবকটি জলকপাট খোলা রাখা হয়েছে। সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে আমরা সর্তকাবস্থায় রয়েছি। এখন পর্যন্ত পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে।”

এদিকে, তিস্তার তীরবর্তী ডিমলা ও জলঢাকা উপজেলার নয়টি ইউনিয়নের ১৫টি চরগ্রাম আংশিক প্লাবিত হয়েছে। প্রয়োজনে এসব চরগ্রামের মানুষকে উচুঁ স্থানে সড়ে যেতে সর্তক করা হয়েছে বলে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা জানিয়েছেন।

নীলফামারী জেলা প্রশাসক মো. হাফিজুর রহমান চৌধুরী বলেন, পরিস্থিতি বিবেচনায় তিস্তা নদীর অববাহিকায় বসবাসরত মানুষজনের উপর নজরদারি বাড়াতে স্থানীয় ইউনিয়নের জনপ্রতিনিধিদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি সরকারিভাবে ১২টি নৌকা প্রস্তুত রাখা হয়েছে বন্যাকবলিত পরিবারের মানুষদের সহায়তার জন্য। এছাড়াও পর্যাপ্ত খাদ্য সামগ্রী মজুদ রাখা হয়েছে।

[প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন কুড়িগ্রামের আহসান হাবীব নীলু , গাইবান্ধার তাজুল ইসলাম রেজা, নীলফামারীর বিজয় চক্রবর্তী কাজল এবং জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মঈনুল হক চৌধুরী]