রংপুরের হাঁড়িভাঙা আমে ঘুরছে ভাগ্যের চাকা

রংপুরের হাঁড়িভাঙা আমের খ্যাতি এখন সারা দেশে। রাজশাহী অঞ্চলের আম আসার প্রায় একমাস পর বাজারে আসে হাঁড়িভাঙা।

আফতাবুজ্জামান হিরু রংপুর প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 June 2020, 12:55 PM
Updated : 20 June 2020, 12:55 PM

রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলায় এক সময় এই আমের ফলন হতো। এখন আর সেখানে সীমাবদ্ধ নেই। ছড়িয়েছে জেলার বিভিন্ন স্থানে।

এই আমের চাষ করে এলাকার অনেকের ভাগ্যের চাকা ঘুরে গেছে। এসেছে আর্থিক স্বচ্ছলতা। দিনমজুর থেকে অনেকেই হয়েছেন আমচাষি। প্রতিবছর আম বিক্রি করেই অনেক পরিবার সারা বছরের আয় করে নেন।

রাজশাহী অঞ্চলের বিভিন্ন জাতের আম বাজারে আসে সাধারণত মে মাসের মাঝামাঝি থেকে শেষের দিকে। হাড়িভাঙা আসে জুনের তৃতীয় সপ্তাহের দিকে।      

এবার ঘূর্ণিঝড় আম্পানে আম ঝরলেও যা রয়ে গেছে তাতে ভালো লাভের আশা করছে কৃষি বিভাগ।

রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক সরোয়ারুল আলম জানান, এ বছর রংপুরে এক হাজার আটশ হেক্টর জমিতে হাঁড়িভাঙা আমের চাষ হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় আম্পানের কিছু ক্ষতি হয়েছে। তারপরও ৪০ থেকে ৪৫ হাজার মেট্রিক টন আম উৎপাদন হয়। গত বছর এর চেয়ে কম উপাদন হয়েছিল।

রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার পদাগঞ্জ এলাকায় প্রথম হাঁড়িভাঙা আম উৎপাদন হয় বলে এই কৃষি কর্মকর্তা জানান।

বদরগঞ্জ উপজেলার গোপালপুর ইউনিয়নের গোপালপুর, পদাগঞ্জ কুতুবপুর ইউনিয়নের নাগেরহাট সর্দারপাড়া, রংপুর নগরের বড়বাড়ী, সদর উপজেলার সদ্যপুস্করণী ইউনিয়নের কাঁটাবাড়ি, মিঠাপুকুর উপজেলাসহ বিভিন্ন স্থানে হাঁড়িভাঙা আমের বাগান হয়েছে।

এখানকার মাটিতে হাঁড়িভাঙা আম ভালো হওয়ায় এবং এ আমে লাভ বেশি হওয়ায় প্রতিবছর নতুন নতুন আমের বাগান গড়ে তুলছে এলাকার সাধারণ মানুষ।

রংপুরের অন্যান্য এলাকা ছাড়াও শুধু বদরগঞ্জ ও মিঠাপুকুর উপজেলার ৭০টি গ্রামের মানুষ হাঁড়িভাঙা আম চাষ করেছে কৃষি বিভাগ জানিয়েছে।

বদরগঞ্জ উপজেলার পদাগঞ্জ এলাকায় প্রতিটি বাড়িতে হাঁড়িভাঙা আম গাছ রয়েছে। কোনো বাড়িতে ১০/১৫টি, আবার কারো বাড়িতে তার চেয়েও বেশি হাড়িভাঙ্গা আমের গাছ রয়েছে।

এই মাসের শেষের দিকে আম পাকবে বলে জানিয়েছেন আমচাষিরা।

পদাগঞ্জ এলাকার রমিজ উদ্দিন, আফরোজা বেগমসহ অনেকের সঙ্গে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কথা হয়েছে।

তারা জানান, আট-দশ বছর আগেও এসব এলাকার মানুষের ছিল চরম অভাব। তিন বেলা তো দূরের কথা, এক বেলাও খাবার জুটত না। এলাকাটির মাটি লাল হওয়ার কারণে এখানে বছরে একবার ধান উৎপাদন হতো। বাকি আট মাস জমি পতিত পড়ে থাকত। কিন্তু হাঁড়িভাঙা আম তাদের ভাগ্যের চাকা বদলে দিয়েছে। এখন ওই জমিতে আমের বাগান গড়ে তুলেছেন তারা। আম বিক্রি করে তাদের সংসারে সচ্ছলতা ফিরে এসেছে। যাদের জমি নেই সেইসব পরিবারগুলো বাস্তুভিটাতেই হাঁড়িভাঙা আম গাছ লাগিয়ে ভালোভাবেই জীবনযাপন করছেন।

পদাগঞ্জের আম ব্যবসায়ী রহিম উদ্দিন বলেন, “আমি আগে মানুষের বাসায় কৃষিকাজ করতাম; আর এখন আমি হাঁরিভাঙা আমের ব্যবসা করি, আম চাষিদের কাছ থেকে আম কিনে হাটে নিয়ে এসে বিক্রি করি।”

তিনি জানান, পদাগঞ্জ হাট এখন দেশে অতি পরিচিত। কারণ, এখানে আমের মৌসুমে হাঁড়িভাঙা আমসহ বিভিন্ন পাইকার বাজার বসে। দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ এসে এখান থেকে আম কিনে নিয়ে যায়।

এ্কই এলাকার হোসনে আরা বলেন, পাঁচ বছর আগে তার স্বামী মারা গেছেন। পাঁচ সন্তান নিয়ে আনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটত তার। স্বামীর রেখে যাওয়া চার বিঘা জমিতে আমের বাগান করে প্রতি বছর আম বিক্রি করেই তিন-চার লাখ টাকা আয় হয় তাদের। এখন তিনি সন্তানদের বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করাচ্ছেন। 

বড়বাড়ী এলাকার আমচাষি আজম মিয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমি বিদেশে ছিলাম দশ বছর আগে। দেশে আসার পর বেকার হয়ে যাই। কোনো কাজ-কর্ম ছিল না। তারপর এলাকার লোকজনের পরামর্শে দুই একর জমিতে হারিভাঙা আমের বাগান করি। তারপর থেকে প্রতিবছর আম বিক্রি করে আমার সংসার চলে। এবারও নতুন করে এক একর জমিতে আমের বাগান করেছি।”
জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, এ বছর সুষ্ঠুভাবে আম বাজারজাত করার বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ, রংপুরের বদরগঞ্জ ও মিঠাপুকুর উপজেলা প্রশাসন, উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের সঙ্গে পদাগঞ্জ এলাকায় জেলা প্রশাসক আসিব আহসান মতবিনিময় করেছেন।

সভায় ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে আম বাজারজাত করার বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়।
জেলা প্রশাসক আসিব আহসান বলেন, হাঁড়িভাঙা আমের গাড়িতে বিশেষ স্টিকারের ব্যবস্থা করা হয়েছে, যাতে দেশের বিভিন্ন স্থানে পরিবহনে ব্যবসায়ীদের কোনো হয়রানির শিকার হতে না হয়। এ বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গেও কথা বলা হয়েছে। এছাড়া বাজারজাতকরণ সুবিধার জন্য রংপুর সিটি করপোরেশনের কয়েকটি এলাকায় ভ্রাম্যমাণ কুরিয়ার সার্ভিসের বুকিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়।