ঝড়-জলোচ্ছ্বাস ঠেকিয়ে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে সুন্দরবন

করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে মানুষের প্রবেশ সীমিত করার কারণে গাছ কাটা, চুরি ও পাচার কমে আসায় ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে ক্ষতির পরও ঘুরে দাঁড়াচ্ছে উপকূলের ঢাল সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য।  

মঈনুল হক চৌধুরীঅলীপ ঘটক ও বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 June 2020, 05:32 AM
Updated : 5 June 2020, 11:26 AM

বিশ্ব পরিবেশ দিবসের প্রাক্কালে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই বনের উপর দিয়ে বিভিন্ন সময় প্রাকৃতিক নানা ঝড়-জলোচ্ছ্বাস বয়ে গেছে। কিন্তু তা সামলে নিয়ে বার বার ঘুরে দাঁড়িয়ে কয়েক লাখ উপকূলবাসীকে সুরক্ষা দিয়ে চলেছে।

বন ও বন্যপ্রাণী ধ্বংস রক্ষায় অপরাধীদের প্রতিরোধ করার পাশাপাশি বনজীবীদের নিয়ন্ত্রণে রাখাও জরুরি বলে তারা মনে করেন।

করোনাভাইরাসের সময়ে সীমিত প্রবেশাধিকার, অপরাধও কম

বন বিভাগ বলছে, গত কয়েক মাস ধরে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যে পরিবর্তন লক্ষ করা গেছে। অভয়ারণ্য এলাকায়  ডলফিনের ও বন্যপ্রাণীদের অবাধ বিচরণ ক্ষেত্র। অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে বন্যপ্রাণীর দলের বনের সব জায়গায় অবাধ বিচরণ বেড়েছে। বন্যপ্রাণীর দল বন থেকে বেরিয়ে নদীর পাড়ে বিচরণ করছে।

বনে সাধারণ মানুষের প্রবেশ সীমিত হওয়া এবং বনের ভেতরের নদনদীগুলোতে ইঞ্জিনচালিত নৌযান চলাচল কম থাকায় সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যের পরিবর্তন হয়েছে।

সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মুহাম্মদ বেলায়েত হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার পর সুন্দরবনের উপর নির্ভরশীল পেশাজীবীদের প্রবেশাধিকার সীমিত করা হয়। মার্চ মাস থেকে পর্যটকদের প্রবেশাধিকার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ রয়েছে।

“করোনার আগে দুটি রেঞ্জ অফিস থেকে পাশ-পারমিট নিয়ে জেলে, বাওয়ালি ও মৌয়াল মিলে প্রতিদিন যেখানে কমপক্ষে পাঁচ হাজার প্রবেশ করত সেখানে এখন দুই হাজারের বেশি প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না। সুন্দরবনের সম্পদের যাতে ক্ষতি না হয় সেজন্য বনের ভেতরে ঢোকার আগে পেশাজীবীদের অঙ্গীকার করিয়ে ঢোকার অনুমতি দেওয়া হয়।”

এর ফলে আগের তুলনায় নদী-খালে বিষ দিয়ে মাছ শিকারের প্রবণতা অনেক কমে গেছে বলে উল্লেখ করেন এ কর্মকর্তা।

“বনে বৈধ ও অবৈধভাবে ঢুকে চোরা শিকারির দল হরিণ শিকার করে থাকে। আমরা এই চোরা শিকারিদের ধরতে সব সময় তৎপর রয়েছি। এবার ঈদে বন থেকে শিকার করা হরিণের মাংস দিয়ে কোথাও ঈদ করার খবরও পাওয়া যায়নি,” বলেন ডিএফও।

জীবন-জীবিকায় বন

দুই দশকের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে স্থানীয় সাংবাদিক ইসমাইল হোসেন লিটন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, সুন্দরবন সংলগ্ন বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলায় প্রায় ত্রিশ হাজার মানুষ বনের উপর নির্ভরশীল। সুন্দরবনের নদী-খালে মাছ শিকার, বনের মধু ও গোলপাতা আহরণ করে এসব মানুষের জীবিকায়ন হয়ে থাকে।

“সুন্দরবনের উপর নির্ভরশীল এই মানুষদের মধ্যে কিছু চোরা শিকারি আছে যারা তাদের পেশার আড়ালে সুন্দবনের সম্পদের ক্ষতিসাধন করে। তার মধ্যে নদী-খালে বিষ ঢেলে মাছ শিকার করা, হরিণ শিকার করা এবং গোলপাতা আহরণের আড়ালে বনের গাছ কেটে নৌকায় করে পাচার করার অভিযোগ রয়েছে। এই চক্রটি একদিকে বনের ভেতরের নদী-খালে বিষ ঢেলে মৎস্য সম্পদের ক্ষতি করছে; অন্যদিকে এই বিষের কারণে পানি ও মাটি দূষিত হচ্ছে।”

তিনি বলেন, গত এক যুগ প্রলয়ঙ্ককরী ঘূর্ণিঝড় সিডর, আইলা এবং সবশেষ আম্পানে দক্ষিণের উপকূলীয় জেলা বাগেরহাটকে সুন্দরবন মায়ের মতো আগলে রেখেছে। এখন বনকে নিয়ে নতুন করে ভাবার সময় এসেছে।

“বনের উপর আমাদের চাপ কমাতে হবে। তাই সুন্দরবনে মানুষের চলাচল নিষিদ্ধ এবং বনবিভাগের টহল জোরদার করতে হবে।”

তেল গ্যাস বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব ফররুখ হাসান জুয়েল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে ওঠা সুন্দরবনকে নিজের মত করে বাঁচতে দিতে হবে। সুন্দরবনকে আমরা মনুষ্যজাতি নানাভাবে বিরক্ত করেছি।

সুন্দরবনের ক্ষতি করে এমন সব কাজ এখনই বন্ধ করতে হবে।”

তা না হলে জীববৈচিত্র্যের  অপার সম্ভববনাময় সুন্দরবনের জন্য সবাইকে এক সময় কাঁদতে হবে বলে মনে করেন তিনি।

সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকায় নির্মাণাধীন বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও শিল্প প্রতিষ্ঠানের স্থাপনে নানা মহল বিরোধিতা করে আসছে।

এ ব্যাপারে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণাললের উপ মন্ত্রী হাবিবুন নাহার বলেন, সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য রক্ষা এবং পরিবেশের সুরক্ষা নিশ্চিত করেই সব ধরনের কার্যক্রম নেওয়া হচ্ছে।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করা নিয়ে যারা সমালোচনা করছে তারা প্রকৃত চিত্র না জেনেই করছে। জাতিসংঘ প্রতিনিধি দলও সুন্দরবন এসে ঘুরে গেছে, তারাও নেতিবাচক প্রতিবেদন দেয়নি। আমরা সুন্দরবনের সুরক্ষাও করব; মানুষকেও বাঁচাব।”

উপমন্ত্রী আরও বলেন, “প্রকল্প এলাকায় পরিদর্শন করে দেশের পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা নিশ্চিত হয়েছেন- কেন্দ্রের প্রযুক্তিগত কারণে বায়ুদুষণের ক্ষতি হবে না। বর্ষা মৌসুমে তো প্রভাব পড়বেই না। শুকনো মৌসুমেও বায়ু যাবে সুন্দরবনের উল্টো দিকে, যাতে ন্যূনতম নেতিবাচক প্রভাব থাকবে না পরিবেশে।”

ঘূর্ণিঝড়ের পর সুন্দরনের ক্ষয়ক্ষতির প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, এবার আড়াই কোটি টাকার মতো অবকাঠামো ক্ষতি হয়েছে। তাদরকির কারণে পাচার ও চোরাকারবারি কমেছে। বণ্যপ্রাণীদের আবাস্থলও নিরাপদ রয়েছে।

ঘুরে দাঁড়ায় প্রকৃতি

সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশের উপকূলে আঘাত হানা অধিকাংশ ঘূর্ণিঝড়ই গেছে সুন্দরবনের উপর দিয়ে। বুক আগলে দিয়ে ঝড়ের ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে এরপওর সুন্দরবন ঘুরে দাঁড়িয়েছে।

উল্লেখ করার মতো ১৯৮৮ ও ১৯৯৭ সালের ঘূর্ণিঝড়, পরবর্তীতে সিডর, আইলা, রোয়ানু, ফণী, বুলবুল  গিয়েছে সুন্দরবন দিয়ে।

সর্বশেষ ঘূর্ণিঝড় আম্পানে গতবছরের বুলবুলের চেয়ে ৩ গুণ বেশি ক্ষতি হয়েছে বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনের। এবার আম্পানে বনের ১২ হাজার ৩৫৮টি গাছ ভেঙেছে। বন বিভাগের অবকাঠামোর ক্ষয়ক্ষতির হয়েছে অন্তত ২ কোটি ১৫ লাখ টাকার।

বনবিভাগের খুলনা অঞ্চলেরর বন সংরক্ষক মো. মঈনুদ্দিন খাঁন সাংবাদিকদের বলেন, “সুন্দরবনকে সময় দিলে সিডর, আইলা ও বুলবুলের আঘাতের ক্ষয়ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার মতো করেই আম্পানের ক্ষয়ক্ষতিও কাটিয়ে উঠবে।”

আম্পানের আঘাতে বনের ক্ষয়ক্ষতির হিসাব নিরুপণে পরিদর্শনে গিয়ে সুন্দরবনের পূর্ব বিভাগের বন কর্মকর্তা মুহাম্মদ বেলায়েত হোসেন বলেন, “ ঝড় আম্পানের আঘাতে বনের ক্ষতি হয়েছে। আমরা সেই ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছি। বর্তমানে পেশাজীবী ও পর্যটকদের প্রবেশ কম থাকায় বনে এখন সুনশান নীরবতা বিরাজ করছে। বন্যপ্রাণীর দল যেন মুক্তির স্বাদ নিচ্ছে। অপূর্ব সেই দৃশ্য দেখলে মনে হবে যেন বন্যপ্রাণীর দল নতুন পরিবেশে নতুন জীবন ফিরে পেয়েছে। প্রকৃতির এটিই নিয়ম।”

বাঘ ও ডলফিন স্বস্তিতে

রয়েল বেঙ্গল টাইগার, বিরল প্রজাতির হরিণ, বানরসহ প্রাণিকূলের অবাধ বিচরণ এই সুন্দরবনে।

বন বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, ২০০১ সাল থেকে যে ৩৭টি বাঘ মারা গেছে তার মধ্যে ছিল পূর্ব বিভাগে ২২টি এবং পশ্চিম বিভাগে ১৫টি।

সুন্দরবনের পূর্ব বিভাগের বন কর্মকর্তা মুহাম্মদ বেলায়েত হোসেন বলেন, “২২টি বাঘের মধ্যে অন্তত ছয়টি বাঘ লোকালয়ে ঢুকে পড়ায় এলাকাবাসীর পিটুনি ও গুলিতে মারা পড়েছে। পাঁচটি বাঘের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে বয়সের কারণে। অন্যগুলো মারা গেছে ঝড়ের জলোচ্ছ্বাস ও চোরা শিকারিদের হাতে।”

এ বন কর্মকর্তা জানান, এই সময়ের মধ্যে পশ্চিম বিভাগে মোট ১৫টি বাঘের মৃত্যু হয়, যার মধ্যে লোকালয়ে ঢুকে পড়ায় পিটুনিতে মারা যায় আটটি। সুন্দরবনে বাঘের মৃত্যুর এই হার আগের তুলনায় অনেক কমে গেছে।

বেলায়েত হোসেন জানান, সুন্দরবন পূর্ব বিভাগ দুটি রেঞ্জে বিভক্ত। একটি চাঁদপাই অন্যটি শরণখোলা রেঞ্জ। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সুন্দরবনের দুটি রেঞ্জ থেকে পাশ পারমিট নিয়ে বৈধভাবে জেলে, বাওয়ালি ও মৌয়াল মিলিয়ে নানা পেশার ৮৪ হাজার ৯৯৬ জন প্রবেশ করেন। এদের কাছ থেকে সরকার রাজস্ব পেয়েছে ৫ কোটি ৩৫ লাখ ৫৫ হাজার ৮৬৮ টাকা।

বন কর্মকর্তা জানান, পূর্ব সুন্দরবনের চাঁদপাই ডলফিন অভয়ারণ্যে ৫৬০ হেক্টরে, দুধমুখী ডলফিন অভয়ারণ্যে ১৭০ হেক্টরে এবং ঢাংমারি ডলফিন অভয়ারণ্যে ৩৪০ হেক্টরে ডলফিনের নির্ধারিত আবাসস্থল। এই ডলফিনের  আবাসস্থলে জেলেদের মাছ ধরা একেবারেই নিষিদ্ধ।

এই বনকর্মকর্তা বলেন, বনের ভেতরের নদনদীগুলোতে ইঞ্জিন চালিত নৌযান চলা কম থাকায় সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যের পরিবর্তন হয়েছে। তবে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়া এবং অপরিকল্পিত মাছ চাষের ফলে উপকূলীয় জেলায় কৃষি জমির উর্বরা শক্তি কমে যাচ্ছে।