কোভিড-১৯: ‘আটকে রাখলেন’ স্বজনরা, বৃদ্ধের মৃত্যু

কোভিড-১৯ উপসর্গ দেখা দেওয়ায় ফেনীর সোনাগাজীতে এক ব্যক্তিকে ঘরে আটকে রাখার পর একা মারা গেছেন।

ফেনী প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 June 2020, 07:02 AM
Updated : 2 June 2020, 07:02 AM

ডাকাডাকি করলেও পরিবারের সদস্যরা তার কাছে যায়নি, এমনকি তাকে পানি বা দুপুরে খাবারও দেয়নি বলে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা জানিয়েছেন।

সোনাগাজী উপজেলার মতিগঞ্জ ইউনিয়নের ৫৫ বছর বয়সী এই ব্যক্তি রোববার রাতে মারা যান।

তার ছোট ছেলের বরাতে ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মো. রবিউজ্জামান বলেন, রোববার হাসপাতালে গিয়ে কোভিড–১৯ পরীক্ষার নমুনা দেন এই ব্যক্তি। বাড়ি ফিরলে পরিবারের লোকজন তাকে তার শোয়ার ঘরে আটকে রাখে। বাইরে থেকে দরজায় ছিটকিনি লাগিয়ে দেয় পরিবারের সদস্যরা। এরপর পরিবারের কেউ সাহাব উদ্দিনের সঙ্গে কথা বলেনি।

চেয়ারম্যান বলেন, দুপুরে তাকে খাবারও দেয়নি। বিকেলে তার শ্বাসকষ্ট ও কাশি বেড়ে যায়। এ সময় তিনি চিৎকার করে খাবার চাইলেও কেউ দেয়নি। ছোট ছেলে এগিয়ে গেলে বোনেরা বাধা দেয়। চিৎকার করতে করতে রাত ১০টার দিকে তার মৃত্যু হয়। পরে সাড়া না পেয়ে পরিবারের লোকজন জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে তাকে পড়ে থাকতে দেখে। এরপর সবাই যার যার ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়।

পরে ছোট ছেলে ‘বাবা মারা গেছে’ বলে চিৎকার করলে একজন প্রতিবেশী চেয়ারম্যানকে জানান।

ইউনিয়ন পরিষদের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য ফেরদৌস রাসেল বলেন, রাত ১টার দিকে গ্রামপুলিশ নিয়ে চেয়ারম্যানসহ তারা কয়েকজন ওই বাসায় যান। অনেক ডাকাডাকির পর বাড়ির লোকজন প্রধান দরজা খুলে দিয়ে যার যার ঘরে চলে যায়।

“বাড়ির একটি ঘরের বাইরে থেকে ছিটকিনি লাগানো ছিল। ছিটকিনি খুলে আমরা ভেতরে ভীভৎস দৃশ্য দেখতে পাই। ওই ব্যক্তি মেঝেতে গড়াগড়ি করেছিলেন। তার কাপড় খোলা অবস্থায় পাশে পড়ে ছিল।”

পরে ইসলামী আন্দোলনের দাফন দল তার দাফনের উদ্যোগ নেয়।

ওই দলের একজন সদস্য বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, চেয়ারম্যানের কাছে খবর পেয়ে তারা ঘটনাস্থলে যান। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে তাদের পিপিই এবং থানা থেকে মরদেহ রাখার ব্যাগ দেওয়া হয়।

“কিন্তু স্থানীয় মসজিদ থেকে খাটিয়া আনতে লোক পাঠালে মসজিদ কমিটির লোকজন দিতে চাননি। তারা তাকে গ্রামে কবর দিতেও বাধা দেন। কবর খোঁড়ার কোদাল এবং গোসলের পর্দাও তারা দিতে চাননি। পরে চেয়রাম্যান গ্রামের লোকদের বুঝিয়ে খাট, পর্দার কাপড় ও কোদাল সংগ্রহ করেন। চেয়ারম্যান নিজের টাকায় কাফনের কাপড় কেনেন।”

অবশেষে গ্রামপুলিশ ও দাফন দল জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করেন। কবর খোঁড়া, জানাজা ও দাফন কাজে অংশ নেন চেয়ারম্যানসহ সাতজন।

চেয়ারম্যান বলেন, ওই ব্যক্তি দীর্ঘদিন ধরে চট্টগ্রামে একটি পেট্রল পাম্পে চাকরি করতেন। তিনি তার চার ভাইকে প্রবাসে পাঠিয়ে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তিনটি মেয়ে বিয়ে দিয়ে জামাইদের প্রতিষ্ঠিত করেছেন। নিজেও বহু অর্থসম্পদের মালিক হয়েছেন। টাকা-পয়সা রোজগার করে সারা জীবনের উপার্জন দিয়ে পরিবারের সদস্য ও স্বজনদের জন্য অনেক কিছু করেছেন। তার এমন মৃত্যু হল। এর চেয়ে হৃদয়বিদারক আর কী হতে পারে? মহান আল্লাহর কাছে দোয়া করি, কোনো শত্রুকেও যেন তিনি এমন মৃত্যু না দেন। এই মৃত্যু থেকে পৃথিবীর সব মানুষের শিক্ষা নেওয়া উচিত। করোনাভাইরাস মহামারিতে মানবতা যেন আজ থমকে গেছে।

চেয়ারম্যান জানান, কিছু দিন আগে তার শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়। একই সঙ্গে জ্বর ও কাশি ছিল। স্থানীয়ভাবে চিকিৎসা নিয়ে তিনি সুস্থ হয়ে যান। হঠাৎ অসুস্থ হয়ে বুধবার রাতে চট্টগ্রাম থেকে বাড়ি আসেন। শনিবার রাত থেকে তার শ্বাসকষ্ট, জ্বর ও কাশি বেড়ে যায়। রোববার তিনি হাসপাতালে গিয়ে কোভিড–১৯ পরীক্ষার নমুনা দেন।

“তার স্ত্রী, তিন ছেলে, তিন মেয়ে ও তিন জামাতা রয়েছেন। দুই ছেলে কাজের সূত্রে গ্রামের বাইরে থাকেন। অন্যরা সবাই বাড়িতে ছিলেন।”

এ ব্যাপারে ওই ব্যক্তির পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তারা কেউ এ বিষয়ে কথা বলতে চাননি।

রোববার সকালে ওই ব্যক্তি নিজেই হাসপাতালে গিয়ে নমুনা দেন বলেন সোনাগাজী উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা উৎপল দাস জানিয়েছেন।

তিনি বলেন, ওই ব্যক্তির পরীক্ষা প্রতিবেদন এখনও পাওয়া যায়নি। এ উপজেলায় এ পর্যন্ত দুই চিকিৎসকসহ ২১ জনের কোভিড ১৯ শনাক্ত হয়েছে।