লিবিয়ায় বাংলাদেশি হত্যা: পাঁচ জেলার ১৫ জন

লিবিয়ায় পাচারকারী ও তাদের স্বজনদের গুলিতে প্রাণ হারানো ২৬ বাংলাদেশির মধ্যে ১৫ জনের বাড়ি পাঁচ জেলায়। এর মধ্যে শুধু মাদারীপুরের রয়েছেন ১১ জন।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 May 2020, 06:22 PM
Updated : 30 May 2020, 06:26 PM

অন্যরা হলেন মাগুরা, ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ ও যশোরের একজন করে।

উন্নত জীবিকার সন্ধানে ইউরোপ যাওয়ার জন্য লিবিয়ায় দুর্গম পথ পাড়ি দিচ্ছিলেন ৩৮ বাংলাদেশি।

তাদের মধ্যে বেঁচে যাওয়া এক বাংলাদেশি জানান, ১৫ দিন আগে বেনগাজি থেকে মরুভূমি পাড়ি দিয়ে মানবপাচারকারীরা তাদের ত্রিপোলি নিয়ে যাচ্ছিল। তিনিসহ মোট ৩৮ জন বাংলাদেশি মিজদাহ শহরের কাছে লিবিয়ান মিলিশিয়া বাহিনীর হাতে জিম্মি হন। এরপর তাদের কাছে আরও টাকা দাবি করা নিয়ে একজন পাচারকারী খুন হওয়ার পর তার স্বজনরা গুলি করে ২৬ বাংলাদেশি ও চার আফ্রিকানকে হত্যা করে।

বৃহস্পতিবার লিবিয়ার ত্রিপলি থেকে ১৮০ কিলোমিটার দক্ষিণের শহর মিজদাহতে এই ঘটনা ঘটে।

ওই ঘটনায় আহত ১১ জন সে দেশের হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন; আর প্রাণে বেঁচে যাওয়া এই ব্যক্তি আত্মগোপণে আছেন।

নিহতদের মধ্যে ১৫ জন রয়েছেন পাঁচ জেলার।

মাদারীপুরের ১১ জন নিহত, ৩ জন আহত

মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার আমগ্রাম ইউনিয়নের নরারকান্দি গ্রামের তরিত মোল্লা তার ছোট ছেলে আয়নাল মোল্লাকে (২২) ইতালি পাঠানোর জন্য জুলহাস সরদার নামের এক দালালকে টাকা দেন।

আয়নালের বাবা তরিত মোল্লা বলেন, “জমিজমা, ঘরের সোনা গহনা যা ছিল সব বিক্রি করে ছেলেকে দালালের মাধমে বিদেশ পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু এখন আমার ছেলেও গেছে, সবই গেছে।”

আয়নালের পরিবারে বাবা ছাড়াও রয়েছেন মা সেলিনা বেগম, বড় বোন ও বড় ভাই।

একই অবস্থা রাজৈর উপজেলার ইশিবপুরের আসাদুলের।

আসাদুলের বড় ভাই শাহাদাত হোসেন বলেন, “জমিজমা বলতে যা ছিল সব বিক্রি করেছি। এখন আর কিছু নাই। ভাইও নাই। আমির দাললাকে ১০ লাখ টাকা দিয়েছি। পরে আরও কয়েক দফায় কয়েক লাখ দিয়েছি। এখন সব স্বপ্ন শেষ।”

ইশিবপুর ইউনিয়নের হুজুরিয়া গ্রামের নারায়ন দত্ত ও তার পরিবারের সদস্যরা বলেন, তারা খবর পাচ্ছেন তার ছেলে বাপ্পি দত্তর গায়ে গুলি লেগেছে, সে এখনও জীবিত।

তারা তাকে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করতে সরকারের কাছে আবেদন জানান।

রাজৈর থানার ওসি শওকত জাহান বলেন, লিবিয়ায় স্বজনদের নিহতের খবর শুনে শুক্রবার রাজৈর উপজেলার হোসেনপুরে জুলহাস সরদারের বাড়িতে হামলা চালাতে যায় স্থানীয়রা। খবর পেয়ে পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।

“পুলিশ জুলহাসের করোনাভাইরাসের উপসর্গের খবর পেয়ে হেফাজতে রেখে সদর হাসপাতালের আইসলোশনে রাখা হয়েছে। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে।”

গোপালগঞ্জের সুজনের মুক্তিপণ দশ লাখ টাকা

চার মাস আগে দালালের সঙ্গে লিবিয়ার উদ্দেশে বাড়ি ছেড়েছিলেন গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলার বামনডাঙ্গা গ্রামের সুজন মৃধা (২০)।

সুজনের ছোট ভাই সুমন মৃধা (১৬) বলেন, পরিবারের বড় ছেলে সুজন। মা-বাবা ও চার ভাইবোনের এ সংসারের হাল ধরতেই সে লিবিয়া গিয়েছিল।

“চার লাখ টাকার নিয়ে দালাল চক্র তাকে লিবিয়া পাঠায়। চলতি বছরের ২৭ জানুয়ারি বাড়ি ছাড়ে সুজন।”

মুকসুদপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তসলিমা আলি বলেন, বিষয়টি বিভিন্ন গণমাধ্যম থেকে শুনেছি। খোঁজ খবর নেওয়া হচ্ছে। আমরা দালাল চক্র ধরতে চেষ্টা করছি।”

দশ লাখ টাকা চেয়েছিল ফরিদপুরের কামরুলের জন্য

ফরিদপুরের সালথা উপজেলার বল্লভদী ইউনিয়নের আলমপুর গ্রামের কবির শেখ জমি বিক্রি করে ও এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে ছেলে কামরুল ইসলাম শেখকে বিদেশে পাঠিয়েছিলেন।

নিহত কামরুল ইসলামের স্ত্রী ও দুই বছরের একটি ছেলে রয়েছে। নিহতের বাবা কবির শেখ বলেন, গত ডিসেম্বরে গোপালগঞ্জ জেলার মোকসেদপুর উপজেলার গোয়ালা গ্রামের আব্দুর রবের মাধ্যমে সাড়ে চার লাখ টাকার বিনিময়ে কামরুলকে বিদেশ পাঠান তিনি।

নিহতের বড় ভাই ফারুক শেখ বলেন, লিবিয়ায় পৌঁছার পর দালাল চক্র তাকে আটকে রেখে নির্যাতন শুরু করে। এরপর মোবাইল ফোনে তাদের সাথে যোগাযোগ করে কামরুলকে ইতালি পাঠানোর কথা বলে ১০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে পাচারকারীরা।

সালথা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হাসিব সরকার বলেন, “বিষয়টি জানতে পেরে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ওই পরিবারের সাথে যোগাযোগ করা হচ্ছে। তাদের সকল ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছি আমরা।”

আইনি প্রক্রিয়া শেষে কামরুলের লাশ দেশে আনার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করার উদ্যোগ নেওয়া হবে বলে তিনি জানান।

যশোরের রাকিবুল ছিলেন স্নতকের ছাত্র

যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার শংকরপুর ইউনিয়নের খাটিয়াবাড়িয়া গ্রামের ইসরাফিল হোসেন ও মহিরুন নেসার ছেলে রাকিবুল ইসলাম (২০)। তাদের চার সন্তানের মধ্যে রাকিবুল ছোট।

যশোর সরকারি সিটি কলেজের অর্থনীতি বিভাগের স্নাতক (সম্মান) প্রথম বর্ষের এই ছাত্র গত ফেব্রুয়ারি মাসে লিবিয়ার উদ্দেশে বাড়ি ছাড়েন।

তার বাবা ইসরাফিল বলেন, পাচারকারীরা মুক্তিপণ চাওয়ার পর সন্তানের জীবন বাঁচানোর জন্য তারা বাড়ির ভিটা ও জমি বিক্রি করে টাকা সংগ্রহ করার সিদ্ধান্ত নেন। মুক্তিপণ দাবিকারীদের কাছ থেকে ১ জুন পর্যন্ত সময় নেওয়া হয়েছিল। পাঠানোর আগেই খবর মৃত্যুর খবর এলো।

মাগুরার নিহত একজন, আহত একজন

মাগুরার মোহাম্মদপুর উপজেলার বিনোদপুর ইউনিয়নের নারায়ণপুর গ্রামেন লালচাঁদ বিশ্বাস ছিলেন টাইলস মিস্ত্রি।

লালচাঁদের বাবা ইউনুস আলী বলেন, “প্রায় আট মাস আগে আমার ছেলে একই গ্রামের জিয়ার মাধ্যমে ঢাকায় বসবাসকারী কুষ্টিয়ার ‘আদম ব্যাবসায়ী’ কামাল হাজির মাধ্যমে লিবিয়ার মাঝদা শহরে পৌঁছায়।”

জমি বন্ধক, সমিতির ঋণ, গরু, ছাগল, গাছ বিক্রি করে সাড়ে পাঁচ লাখ দেন আদম ব্যাপারীকে দেন বলে তিনি জানান।

আহত তরিকুল একই গ্রামের

তরিকুলের ভগ্নিপাতি মিকাইল হোসেন বলেন, লাল চাঁদ ও তরিকুল আট মাস আগে একই সঙ্গে লিবিয়ার উদ্দেশে বাড়ি ছাড়েন।

“তাকেও জমি বন্ধক, একাধিক সমিতির ঋণ করে লিবিয়া পাঠানো হয়। লালচাঁদ গুলিতে মারা গেলেও তারিকুল আহত হয়েছেন। তার হাতে গুলিবিদ্ধ লেগেছে।”

তরিকুলের মা-বাবা ছাড়াও স্ত্রী ও দুই বছর বয়সী সন্তান রয়েছে বলে ভগ্নিপতি জানান।

মাগুরার জেলা প্রশাসক আশরাফুল আলম বলেন, “ফ্লাইট বন্ধ থাকায় একটু সময় লাগলেও লিবিয়াতে বাংলাদেশের দূতাবাসের মাধ্যমে মৃতদেহ দেশে আনার চেষ্টা করা হবে বলে আমার ধারণা।”