‘বুলবুলে বেড়িবাঁধের ক্ষতি’ সারানোর আগেই আম্পানের হানায় শঙ্কা

ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুলের তাণ্ডবে’ ক্ষতিগ্রস্ত বেড়িবাঁধ চুইয়ে খুলনার কয়রা ও দাকোপে পানি ঢোকে বর্ষা মৌসুমেই। সেখানে বঙ্গোপসারের ইতিহাসের দ্বিতীয় ‘সুপার সাইক্লোন’ ধেয়ে আসায় শঙ্কায় পড়েছে এলাকাবাসী।

শুভ্র শচীন খুলনা প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 May 2020, 03:19 PM
Updated : 19 May 2020, 03:19 PM

নদীবেষ্টিত উপকূলীয় খুলনার লোকালয় কয়রা ও দাকোপে বেড়িবাঁধ নিয়ে শঙ্কা রয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ডও। সম্ভাব্য প্রবল পানি তোড় সামলাতে এরইমধ্যে জিওব্যাগ ফেলার কাজে নেমেছে এ বোর্ড।

সবার ছুটি বাতিলের কথা জানিয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের খুলনার ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী প্রকৌশলী পলাশ ব্যানার্জি বলেন, বেড়িবাঁধের বেশি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় জিওব্যাগ ফেলে ভাঙন রোধের চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে।

তবে কতগুলো জিওব্যাগ এখন ফেলা হচ্ছে তা জানাতে পারেননি এ প্রকৌশলী।

গত বছরের নভেম্বরে ঘুর্ণিঝড় বুলবুলের সময় থেকে এসব বেড়িবাঁধ ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ হয়ে পড়ে বলে জানিয়ে তিনি বলেন, এরপরই খুলনা পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে এসব মেরামতের জন্য ঢাকার প্রস্তাব পাঠানো হয়।

মাস দুয়েক আগে উপকূলীয় অঞ্চলের কয়রা বেড়িবাঁধ পরিদর্শন করে গেছেন পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী এনামুল হক শামীম।

চিহ্নিত ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধগুলো মেরামতের জন্য উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা মন্ত্রণালয়ে প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। মন্ত্রণালয়ে থেকে বরাদ্দ মিললে এসব স্থানে কাজ শুরু হবে বলেও তিনি জানান।

তবে চিংড়িচাষিরাও এসব বাঁধের ক্ষতি করে বলে অভিযোগ রয়েছে।

এদিকে, সিডরের মত শক্তি নিয়ে ঘূর্ণিঝড় আছড়ে পড়ার শঙ্কায় রয়েছে এ উপকূলে বাসিন্দারা।

উপকূলীয় জনপদ কয়রা ও দাকোপ চারদিকে নদীবেষ্টিত। শুধুমাত্র পানি উন্নয়ন বোর্ডের বেড়িবাঁধই দুইটি জনপদকে ঘিরে রেখেছে। বর্ষামৌসুমে আবহাওয়া বিরূপ হলেই পানির চাপে এসব বেড়িবাঁধের কোথাও কোথাও ভেঙে পানি প্রবেশ করে লোকালয়ে। সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধ কয়রা এলাকায়।

আম্পানের প্রভাবে মঙ্গলবার দুপুর থেকেই খুলনার আকাশে মেঘ ঘণীভূত হচ্ছে। ধীরে ধীরে বাতাসের বেগও বাড়ছে। শুরু হয়েছে বৃষ্টি। এমন পরিস্থিতিতে উপকূলীয় মানুষের মধ্যে ছড়িয়েছে আতঙ্ক।

মঙ্গলবার বাতাসের গতি বাড়তে থাকায় ইতিমধ্যে নদী তীরবর্তী বেড়িবাঁধের বাইরে ও বাঁধের কাছাকাছি অনেক বাসিন্দা আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছেন।

কয়রা উপজেলার মদিনাবাদ এলাকার বাসিন্দা ইসমাইল হোসেন জানান, ঘূর্ণিঝড় আম্পান আতঙ্কে রয়েছেন তারা। বিশেষকরে উপজেলার হরিণ খোলা, গোবরা, উত্তর বেদকাশী, দক্ষিণ বেদকাশী ও মহারাজপুরের মানুষ। কেননা এসব এলাকার বেড়িবাঁধ বেশ ঝুঁকিপূর্ণ।

কয়রা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ইমতিয়াজ উদ্দিন বলেন, দীর্ঘদিন সংস্কারের অভাবে কয়রার ২৫ কিলোমিটারের মতো বেড়িবাঁধ জীর্ণশীণ অবস্থায় রয়েছে।

তিনি বলেন, “বেড়িবাঁধের কোথাও কোথাও মাত্র দেড় থেকে দুই হাত মাটি অবশিষ্ট রয়েছে। অবস্থা এতটাই খারাপ যে, বাঁধের অনেক জায়গা দিয়ে চুইয়ে চুইয়ে পানি লোকালয়ে প্রবেশ করছে।”

এছাড়া বেড়ি বাঁধের অবস্থা নাজুক রয়েছে- দক্ষিণ বেদকাশি ইউনিয়নের আংটিহারা, খাসিটানা, জোড়শিং, মাটিয়াভাঙ্গা। উত্তর বেদকাশি ইউনিয়নের গাতিরঘেরি, গাববুনিয়া, গাজিপাড়া, কাটকাটা। কয়রা সদর ইউনিয়নের ৬ নম্বর কয়রা, ৪ নম্বর কয়রার পুরাতন লঞ্চঘাট সংলগ্ন এলাকা, মদিনাবাদ লঞ্চ ঘাট, ঘাটাখালি, হরিণখোলা। মহারাজপুর ইউনিয়নের উত্তর মঠবাড়ি, দশালিয়া, লোকা। মহেশ্বরীপুর ইউনিয়নের কালিবাড়ি, নয়ানি, শেখেরটেক এলাকায়।

ইমতিয়াজ উদ্দিন বলেন, “প্রধানমন্ত্রীর হুঁশিয়ারি সত্ত্বেও এক শ্রেণির চিংড়িচাষি বেড়িবাঁধ ছিদ্রকরে ঘেরে লবণ পানি তোলে। এত বাঁধ ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়ে।”

খুলনা আবহাওয়া অফিসের জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ আমিরুল আজাদ বলেন, ঘূর্ণিঝড়টি ধীর গতিতে এগিয়ে আসছে। বুধবার বিকালের দিকে খুলনা ও চট্টগ্রামের মধ্যবর্তী অঞ্চল দিয়ে সেটি আঘাত হানতে পারে।

মঙ্গলবার সকাল ৯টার দিকে আম্পান মোংলা বন্দর থেকে ৭৩০ কিলোমিটার দক্ষিণ দক্ষিণ-পশ্চিমে এবং পায়রা বন্দর থেকে ৭২৫ কিলোমিটার দক্ষিণ দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থান করছিল।  ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের ৯০ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের এক টানা গতিবেগ সর্বোচ্চ ২২৫ কিলোমিটার, যা ঝড়ো হাওয়া বেগে ২৩০ কিলোমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে বলেও জানান তিনি।

মঙ্গলবার আমিরুল আজাদ বলেন, মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরকে ৭ নম্বর সতর্কতা সংকেত এবং চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর ও কক্সবাজার উপকূলকে ৬ নম্বর সতর্ক সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে।

তবে ঝড়ের গতিপ্রকৃতি অনুযায়ী ওই সংকেত আরও বাড়বে। ঝড়টি ইতিমধ্যে সিডরের মত শক্তিশালী হয়ে উঠেছে।

“ঝড়ের প্রভাবে নদীতে জোয়ারের উচ্চতা স্বাভাবিকের চেয়ে ৫ থেকে ৭ ফুট বৃদ্ধি পেতে পারে। এতে উপকূলীয় এলাকা প্লবিত হওয়ার আশঙ্কা আছে।”

এদিকে শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় 'আম্পান' মোকাবেলায় সবরকম প্রস্তুতি নিয়েছে খুলনা জেলা প্রশাসন। সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে মোট ৬১২টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে।

জনসাধারণদের সতর্ক করে উপকূলের বিভিন্ন স্থানে চলছে মাইকিং। জেলা-উপজেলা পর্যায়ে খোলা হয়েছে নিয়ন্ত্রণ কক্ষ। রেড ক্রিসেন্ট, সিপিপিসহ ২ হাজার ৪৬০ জন স্বেচ্ছাসেবক কাজ করছেন। বিভিন্ন এনজিও’র রয়েছে আরও ১ হাজার ১০০ স্বেচ্ছাসেবক। এরইমধ্যে আশ্রয়কেন্দ্রগুলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হয়েছে। 

খুলনার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হেলাল হোসেন বলেন, ঘূর্ণিঝড় আম্পান উপকূলীয় এলাকায় আঘাত হানতে পারে এমন খবরের পর সতর্ক অবস্থানের রয়েছে খুলনার প্রশাসন। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে মোট ৬১২টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত করা হয়েছে। তবে এ সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। পর্যাপ্ত খাদ্যসামগ্রীও মজুত রাখা হয়েছে।

স্বাস্থ্যবিভাগের পক্ষ থেকে উপকূলীয় ৪টি উপজেলায় ১০৪টি মেডিকেল টিমের পাশাপাশি পর্যাপ্ত ওষুধ মজুত রাখা হয়েছে বলে জানিয়েছেন খুলনার সিভিল সার্জন ডা. সুজাত আহমেদ।