ওএমএস-এর ‘ভিক্ষুক-দরিদ্র’ তালিকায় ধনাঢ্য আ.লীগ নেতার স্ত্রী-মেয়ে

সরকারি সহায়তা দিতে করা হতদরিদ্রদের তালিকায় এক ধনী আওয়ামী লীগ নেতা তার স্ত্রী, মেয়ে, ভাই, বোন, শ্যালক, শ্যালকের স্ত্রী, ভাইপো, বোনের দেবরসহ ১৩ স্বজনের নাম ঢুকিয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 11 May 2020, 02:35 PM
Updated : 11 May 2020, 02:53 PM

এ ঘটনায় জেলা আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্য বিষয়ক সম্পাদক এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইস্ডাস্ট্রিজের পরিচালক মো. শাহ আলমকে ‘কারণ দর্শাতে নোটিশ’ পাঠিয়েছে জেলা প্রশাসক।

সরকারি চাল বিতরণের ওএমএস-এর ডিলার সরকারি দলের এ নেতা ‘রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির এ জেলা ইউনিটের সাধারণ সম্পাদক বলে জানিয়েছেন স্থানীয় কয়েকজন। এছাড়া জেলা শহরের ‘হ্যালো সুইটি মিট’ এর মালিক এ নেতা জেলা রেস্তোরাঁ সমিতির সভাপতির দায়িত্বে রয়েছেন।

কোভিড-১৯ রোধে দেশে সরকার ঘোষিত ‘সাধারণ ছুটি’-তে অবরুদ্ধ দেশে কর্মহীন হয়ে পড়া মানুষের জন্যে সরকার এই বিশেষ ওএমএস সুবিধা চালু করেছে। এজন্য ভিক্ষুক, ভবঘুরে, কর্মহীন, হতদরিদ্র ও নিম্ন  আয়ের মানুষের দেওয়া হচ্ছে ওএমএস কার্ড।

গরিব মানুষের এ তালিকায় এ পর্যন্ত মো. শাহ আলমের পরিবারের ১৩টি নামসহ ৯১টি ‘বিতর্কিত নাম’ পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক সুবীর নাথ চৌধুরী।

এই ওএমএস তালিকায় দেখা গেছে-পৌরসভার ১০ নং ওয়ার্ডের তালিকার ১৬ নম্বরে রয়েছে তার স্ত্রী মোছাম্মৎ মমতাজ আলমের নাম, ১২ নম্বরে মেয়ে আফরোজার নাম।

জেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের এ নেতার তিন ভাই-বোন মো. সেলিম, মো. আলমগীর ও শামসুন্নাহারের নাম রয়েছে ৮, ৯ ও ২৭ নম্বর ক্রমিকে। এছাড়া, তার আরেক ভাই খোরশেদ মিয়ার ছেলে নাছিরের নাম রয়েছে ৭ নম্বরে; যদিও নাছির প্রবাসী।

ব্যবসায়ী ও ক্ষমতাসীন দলের এ নেতার শ্যালক মো. তাজুল ইসলামের নাম তালিকার ৩ নম্বরে এবং শ্যালকের স্ত্রী আসমা ইসলামের নাম ৫ নম্বরে রয়েছে। তার আরেক শ্যালকের স্ত্রী মোছাম্মৎ জান্নাতুল ইসলামের নাম রয়েছে তালিকার ১০ নম্বরে। এ নেতার আরেক শ্যালক প্রবাসী শফিকুল ইসলামের নামও রয়েছে তালিকার ১৩ নম্বরে।

এছাড়া তার বোনের তিন দেবর মতিউর রহমান, মাহবুবুর রহমান, লুৎফুর রহমানের নাম তালিকার ৭২, ৭৩ ও ৭৪ নম্বর ক্রমিকে রয়েছে।

আওয়ামী লীগ শাহ আলমের এই স্বজনরা সবাই স্বচ্ছল বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন।

মো. শাহ আলমের কাছে তালিকায় পরিবারের সদস্যদের নাম থাকার ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি সাংবাদিকদের জানান, এ বিষয়টা কাউন্সিলর বলতে পারবে। পৌরসভা যাচাই-বাছাই করে চূড়ান্ত করেছে।

“তাছাড়া আমি কোনো কার্ড বণ্টন করিনি। আমি হলাম ডিলার। ডিলার কোনো কার্ড দিতে পারে না।”

তবে ওএমএস কার্ডে বিত্তবানদের নাম তোলার ব্যাপারে জানতে চাইলে পৌরসভার ১০ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর মাকবুল হোসেন বলেন, “এ বিষয়ে আমি সৎ পথে রয়েছি। আমার জানা মতে আমি কোনো ভুল করিনি।”

এতটুকু বলেই তিনি মোবাইলফোনের লাইন কেটে দেওয়ায় তিনি এ কথা দিয়ে কী বোঝাতে চেয়েছেন তার ব্যাখ্যা শোনার সুযোগ হয়নি।

এদিকে, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক সুবীর নাথ চৌধুরী জানান, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় ভিক্ষুক, ভবঘুরে, হতদরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষ, যারা কোনো সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনির অর্ন্তভুক্ত নন, তাদের জন্য বিশেষ ওএমএস সুবিধা চালু করা হয়েছে।

এ সুবিধায় একজন ওএমএস কার্ডধারী প্রতি মাসে ১০ টাকা কেজি দরে ২০ কেজি করে চাল পাবেন। সেজন্য ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌরসভা এলাকায় ৯ হাজার ৬০০ জনকে দেওয়া হচ্ছে ওএমএস কার্ড বলে জানান তিনি।

ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের মাধ্যমে প্রথম দফায় প্রতিটি ওয়ার্ড থেকে ৫০০ জনের নামের তালিকা করার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, “প্রথম দফার তালিকা অনুযায়ী ইতোমধ্যে ১০ টাকা কেজি দরে ২০ কেজি করে চাল পেয়েছেন তারা।”

জেলা শহরের একটি পাঁচতলা বাড়ির মালিক আওয়ামী লীগ নেতা মো. শাহ আলমের ওই ১৩ জন আত্মীয়সহ বিতর্কিত ৯১ জনই এ দফার চাল তুলেছেন বলে জানিয়েছেন সুবীর নাথ চৌধুরী।

খাদ্য নিয়ন্ত্রক জানান, তালিকা থেকে আওয়ামী লীগ নেতার পরিবারের লোকজনসহ ৯১ জন সামর্থ্যবানের নাম বাদ দেওয়ার জন্যে চিঠি দিয়ে পৌর মেয়রকে নির্দেশ দিয়েছেন জেলা ওএমএস কমিটির সভাপতি জেলা প্রশাসক মো. হায়াত উদ দৌলার খান।

মো. শাহ আলম একজন ওএমএস ডিলার জানিয়ে তিনি আরো বলেন, “ওএমএস তালিকায় তার পরিবার-পরিজনের নাম থাকার কারণে জেলা প্রশাসক ইতোমধ্যে মো. শাহ আলমকে শোকজ (দর্শানোর নেটিশ) করেছেন।

“আগামী দুই দিনের মধ্যে তাকে উত্তর দিতে বলা হয়েছে। উত্তর সন্তোষজনক না হলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

ব্রাহ্মণবাড়িয়া সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) সভাপতি প্রকৌশলী মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, যাদেরকে তালিকা করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তারা যদি প্রকৃতদের এড়িয়ে তাদের পছন্দের লোকদের নাম দেন, সেটি তো ঠিক না। এতে করে যে উদ্দেশ্যে যাদের জন্য সরকার এ সুবিধা দিচ্ছে সেটি তারা পাবে না।

এদিকে, জেলা প্রশসকের পাঠানো বিতর্কিত ৯১ জনের তালিকা ইতোমধ্যে বাতিল করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌরসভার মেয়র নায়ার কবির।

পাশাপাশি পৌরসভার ইস্যু করা সব কার্ড পৌরসভার পক্ষ থেকে পুনরায় নিরীক্ষণের জন্যে একটি কমিটি করে দেওয়া হয়েছে। এ কমিটি ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেওছেন বললেন মেয়র।