অবরুদ্ধে গাইবান্ধায় ধানকাটার দিনমজুরি নেমে অর্ধেক

করোনাভাইরাস রোধে দেশের অবরুদ্ধ পরিস্থিতিতে গাইবান্ধায় কম মজুরিতে বোরো ধান কাটতে নানা পেশার শ্রমজীবীরা ভিড় করায় শ্রমিক সঙ্কট নাই বলছেন সংশ্লিষ্টরা।

তাজুল ইসলাম রেজা গাইবান্ধা প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 May 2020, 02:15 PM
Updated : 8 May 2020, 02:17 PM

গত বছর এ জেলায় দিনে ‘আট ঘণ্টা’ ধান কাটার জন্য যেখানে ‘৫০০ থেকে ৬০০ টাকা’ দিন-মজুরি দিতে হয়, সেখানে এবার ‘৩০০ থেকে ৩৫০ টাকায়’ ধান কাটতে মজুরদের সঙ্গে রফা করতে পারছেন কৃষকরা।

কৃষি কর্মকর্তা, কৃষক ও মজুররা বলছেন, দেশ অবরুদ্ধ থাকায় অন্যান্য পেশার শ্রমজীবীরা কাজ হারিয়েছেন। এতে কর্মহীন হয়ে পড়া এসব মানুষ ধান কাটতে নেমে পড়ায় এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে এবার।

করোনাভাইরাস প্রকোপের এ পরিস্থিতিতে কৃষিশ্রমিকের সঙ্কট না থাকার কথা জানিয়ে গাইবান্ধা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. মাসুদুর রহমান বলেন, “গাইবান্ধায় সাধারণত একদিনের মজুরি ৪৫০-৫০০ টাকা কিন্তু বর্তমানে একদিনের মজুরি ৩০০-৩৫০ টাকা চলছে।”

সাধারণত সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত কাজের ভিত্তিতে একদিনের মজুরি ধরা হয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিভিন্ন পেশার লোকজন ধান কাটতে যোগ দেওয়া এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।

সাদুল্লাপুর উপজেলার খোর্দ্দ পাটানোছা গ্রামের ইজিবাইক চালক আংগুর মিয়া বলেন, লকডাউনের কারণে গাড়ি চালাতে পারছি না। তাই ৩৫০ টাকা দিন মুজুরিতে ধান কাটছি।

একই ধাপেরহাট ইউনিয়নের হাছানপাড়া গ্রামের রিকশা-ভ্যান চালক ছোলায়মান মিয়া (৪৮) বলেন, “চারিদিকে করোনা।

“ধান কাটা ছাড়া আর কোনো কাজ নাই। তাই বেকার হয়ে বসে থাকার চেয়ে ৩৫০ টাকা দিন মুজুরিতেই ধান কাটছি।”

গতবছর ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা দিন মুজুরিতে ধান কেটেছেন জানিয়ে একই গ্রামের কৃষিশ্রমিক ফজলু মিয়া (৪০) বলেন, এ বছর করোনাভাইরাসের কারণে জমির মালিকরা সহজেই ধান কাটার শ্রমিক পাওয়ায় ৩৫০ টাকার বেশি দিচ্ছে না।

গাইবান্ধা সদর উপজেলার বল্লমঝাড় ইউনিয়নের তালুক মন্দুয়ার গ্রামের হোটের শ্রমিক রেজাউল মিয়া (৫০) বলেন, “করোনার কারণে হাতে কোনো কাজ নাই। তাই ৫০০/৬০০ টাকার জায়গায় ৩৫০ টাকা মজুরিতে ধান কাটছি।”

একই উপজেলার ঘাগোয়া গ্রামের কৃষক খলিল মিয়া (৪৫) জানান, বোরো ও আমন মৌসুমে তার এলাকায় ধান কাটতে কৃষিশ্রমিকের চাহিদা থাকায় কৃষি শ্রমিক সঙ্কটও দেখা দেয়। এ সুযোগে কৃষিমুজুরের মূল্য বৃদ্ধি পায়।

“কিন্তু চলতি বছর এরকম পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়নি।”     

ফুলছড়ি উপজেলার রসুলপুর গ্রামের কৃষক হাসেম মিয়ার (৪৮) গ্রামের অনেক কৃষিশ্রমিক ধান কাটা মৌসুমে অন্য এলাকায় গিয়ে কাজ করেন। এ বছর যেতে না পারায় কৃষিশ্রমিকের সঙ্কট দেখা দেয়নি বলে মনে করছেন তিনি।

“আমি এবার ১০ বিঘা জমিতে বোরো ধানের চাষ করেছি। এলাকায় ধান কাটা শুরু হয়েছে। সুলভ মূল্যে কৃষিশ্রমিক দিয়ে ধান কাটাচ্ছি।”

সাদুল্লাপুর উপজেলার হবিবুল্লাপুর গ্রামের দিনমজুর মঞ্জু প্রামানিক জানান, জমির ধান কাটতে এখন রিকশা-ভ্যান, অটোটেম্পু চালকসহ নানা কাজের শ্রমজীবীরা যোগ দিয়েছেন।

“এ কারণে ধান কাটার ভড়া মৌসুমেও আমরা এখন বেকার হয়ে পড়ে আছি। ফলে সংসারে স্ত্রী ও দুই মেয়েসহ চারজন খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাচ্ছি।”

একই উপজেলার ধাপেরহাট ইউনিয়নের হাসানপাড়া গ্রামের দিনমজুর হাইবার আলীও বলেন, “বোরো ধান কাটা মৌসুমেও কাজ অভাবে বসে আছি।”

করোনা পরিস্থিতিতে সব কিছু বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে ভাবছেন তিনি।

গত বছরের মত এবারও ধান কাটার মজুরের অভাব হবে ভেবে বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মীরাসহ মন্ত্রীদেরও বিভিন্ন জেলায় বোরো ধান কাটায় অংশ নিতে দেখা গেছে। বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষরা বিনামূল্যে কৃষকের ধান কেটে দেওয়ায় তাদের ধন্যবাদও জানিয়েছিলেন কৃষিমন্ত্রী।

তবে গাইবান্ধা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য-এ জেলার সাতটি উপজেলায় এক লাখ ১৬ হাজার কৃষিশ্রমিক রয়েছে। এরমধ্যে করোনাকালে আট হাজার ৩২৭ জনকে প্রত্যায়নপত্র দিয়ে দেশের বিভিন্ন জেলায় কাজে পাঠানো হয়।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মাসুদুর রহমান জানান, এছাড়াও জেলায় ধান কাটা মেশিন ১৬টি হারভেস্টার বিতরণ করা হয়েছে। একটি হারভেস্টার ঘণ্টায় তিন বিঘা (সাড়ে ৭ বিঘায় ১ হেক্টর) জমির ধান কাটতে পারে। এতে এক বিঘার ধান কাটতে খরচ পড়ে এক হাজার টাকা।

“ফলে ধান কাটতে কোনো সমস্যা হবে না।”

গাইবান্ধা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য-এ বছর জেলার সাতটি উপজেলায় এক লাখ ৩০ হাজার ৬০০ হেক্টর জমিতে বোরো চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়। তবে চাষ হয়েছে কিছুটা কম-এক লাখ ২৭ হাজার ৫০০ হেক্টরে।

উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী পাঁচ লাখ ৪০ হাজার মেট্রিক টন চাল পাওয়া আশা সরকারি হিসেবে। মে মাসই এ জেলার বোরো ধান কাটার ভরা মৌসুম। শুক্রবার পর্যন্ত জেলায় শতকরা ১২ ভাগ অর্থাৎ ১৫ হাজার হেক্টর জমির ধান কাটা হয়েছে বলে কৃষি দপ্তরের তথ্য।

তবে পাকা ধানের এ মৌসুমে আবহাওয়া বিরূপ। প্রতিদিন বিকালে আকাশ ঘন অন্ধকার হয়ে অঝোর ধারায় ঝরছে বৃষ্টি, বইছে ঝড়ো হাওয়া। এতে দ্রুত ধান ঘরে তোলার তাড়ায় রয়েছে কৃষকরা।