রংপুর চিনিকলের বিপুল দেনা, বিপদে শ্রমিক-আখচাষি

করোনভাইরাস মহামারীতে দেশে অবরুদ্ধ পরস্থিতিতে গাইবান্ধার মহিমাগঞ্জে রংপুর চিনিকল লিমিটেড বিপুল দেনা পরিশোধ না করায় শ্রমিক-কর্মচারী, আখচাষি ও ঠিকাদারার বিপাকে পড়েছেন।

তাজুল ইসলাম রেজা গাইবান্ধা প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 April 2020, 01:21 PM
Updated : 25 April 2020, 01:21 PM

শ্রমিক-কর্মচারী, আখচাষি ও ঠিকাদারের কাছে চিনিকল কর্তৃপক্ষের প্রায় ১০ কোটি টাকা দেনা রয়েছে বলে এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক রফিকুল ইসলাম জানান।

তিনি জানান, তাদের দেনার মধ্যে শ্রমিক-কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের গত চার মাসের বেতন-ভাতা বাবদ চার কোটি, আখ চাষিদের তিন কোটি ৯০ লাখ ও মালামাল সরবরাহকারী ঠিকাদারদের দুই কোটি টাকা।

এই পরিস্থিতিতে পরিবার-পরিজন নিয়ে তারা মানবেতর জীবনযাপন করছেন।

চিনিকল কর্তৃপক্ষ বলছে, করোনা পরিস্থিতির কারণে প্রধান কার্যালয়সহ বিভিন্ন দপ্তর বন্ধ; তাই টাকা ছাড় হচ্ছে না। এছাড়া দোকানপাট বন্ধ থাকায় চিনিকলে উৎপাদিত চিনি বাজারে বিক্রি করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে এই আর্থিক সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে।

চিনিকলের শ্রমিক আবু বকর সিদ্দিক বলেন, “করোনাভাইরাসের সময় বাড়ি থেকে বের হতে পারছি না। জমানো টাকা শেষ হওয়ায় ধারদেনা করে চলছি। বর্তমানে দোকানিরা আর বাকিতে খরচ দিতেও রাজি হচ্ছেন না। ফলে পরিবার পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছি।”

চিনিকলের আরেক শ্রমিক লিটন মিয়া বলেন, “বেতন না পাওয়ায় মানবেতর জীবনযাপন করছি। আমরা চিনিকলের চাকরিজীবী। তাই কোথাও হাত পাততে পারছি না। সরকারি বা বেসরকারি কোনো সাহায্যের তালিকাতেও আমাদের নাম উঠছে না। এভাবে আর কিছুদিন চললে আমাদের না খেয়েই মরতে হবে।”

রংপুর চিনিকল শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি আবু সুফিয়ান বলেন, শ্রমিক-কর্মচারীদের চার মাসের বেতন বকেয়া রয়েছে। ফলে তাদের পরিবার না খেয়েই দিনাতিপাত করছে। করোনা পরিস্থিতির কারণে চিনিকল বন্ধ। প্রায় প্রতিদিনই তারা বেতন-ভাতার দাবিতে চিনিকলে গিয়ে বিক্ষোভ করছেন।

ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান অবিলম্বে সরকারি হস্তক্ষেপ ও সহায়তার দাবি জানিয়ে বলেন, সম্প্রতি শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়নের পক্ষ থেকে বকেয়া বেতন চেয়ে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে আবেদন করা হয়েছে। কিন্তু এখনও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।

মহিমাগঞ্জ গ্রামের আখচাষি রেজাউল মিয়া বলেন, “তিনমাস আগে চিনিকলের আখ মাড়াই বন্ধ হয়েছে। কিন্তু চিনিকলের কাছে আখ সরবরাহের ৫০ হাজার টাকা এখনও পাই নাই। অথচ কথা ছিল আখ সরবরাহের পরপরই টাকা পরিশোধ করবে। একারণে আর্থিক সমস্যায় পড়েছি। টাকা অভাবে ক্ষেতের পাকা বোরো ধান কাটতে পাচ্ছি না।”

একই গ্রামের আখচাষি রফিকুল ইসলাম বলেন, “জমি আমার চার বিঘা। এর মধ্যে দুই বিঘায় আখ ও দুই বিঘায় বোরো ধান চাষ করি। আখ বিক্রি করে সংসারের দায়দেনা মেটাই। কিন্তু এবার আখ বিক্রির ৭০ হাজার টাকা বকেয়া পাইনি। তাই অর্থকষ্টে আছি।”

রংপুর চিনিকল আখচাষি কল্যাণ সমিতির সভাপতি জিন্নাত আলী প্রধান বলেন, “আখচাষিদের বকেয়া পরিশোধে চিনিকল কর্তৃপক্ষকে তাগাদা দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু কোনো কাজ হচ্ছে না।”

চিনিকলের মালামাল পরিবহন ঠিকাদার মুনসুর রহমান বলেন, “মাড়াই মৌসুম সময়ে চিনিকলে যেসব মালামাল পরিবহন করেছি, তার জন্য ২৫ লাখ টাকা পরিবহন বিল বকেয়া পড়ে আছে। কিন্তু চিনিকল বন্ধ হওয়ার তিনমাস পেরিয়ে যাচ্ছে। চিনিকলে ধর্না দিয়েও বিল পাচ্ছি না।”

তিনি বলেন, ঠিকাদারি করে তার জীবন চলে। বিল না পাওয়ায় মানবেতর জীবনযাপন করছেন।  

রংপুর চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রফিকুল ইসলাম জানান, রংপুর চিনিকলে প্রায় ১ হাজার স্থায়ী ও মৌসুমী শ্রমিক-কর্মচারD এবং কর্মকর্তা রয়েছেন। প্রতিমাসে তাদের বেতনভাতায় প্রয়োজন হয় ৯৫ লাখ টাকা। কিন্তু গত জানুয়ারি থেকে তারা বেতনভাতা পান না। তাদের বকেয়ার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪ কোটি টাকা। পাশাপাশি আখচাষিদের সরবরাহকৃত আখ বিক্রি বাবদ পাওনা ৩ কোটি ৯০ লাখ টাকা। এ ছাড়া প্রয়োজনীয় মালামাল সরবরাহকারী ঠিকাদারদের পাওনা রয়েছে প্রায় ২ কোটি টাকা।

রফিকুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প সংস্থার নিয়ন্ত্রণাধীন এই চিনিকলের আর্থিক সমস্যা সমাধানের জন্য ১২ কোটি টাকার চাহিদা জানিয়ে প্রধান কার্যালয়ে আবেদন করা হয়েছে। কিন্তু করোনা পরিস্থিতির কারণে অর্থ ছাড়ে বিলম্ব হওয়ায় এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।

“এ ছাড়া করোনার কারণে চা-মিষ্টির দোকান বন্ধ থাকায় স্থানীয় বাজারেও চিনি বিক্রি হচ্ছে না। এসব কারণে এই সমস্যার সমাধান বিলম্ব হচ্ছে।”