রাষ্ট্রপতির ক্ষমায় ফাঁসি এড়ানো আসলাম ফকির ফের হত্যা মামলায়

রাষ্ট্রপতির ক্ষমায় ফাঁসির দণ্ড থেকে রক্ষা পেয়ে কারামুক্ত হওয়ার তিন বছরের মাথায় আবারও হত্যা মামলায় জড়িয়েছেন ফরিদপুরের সদরপুর উপজেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি আসলাম ফকির।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকফরিদপুর প্রতিনিধি ও বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 April 2020, 01:26 PM
Updated : 24 April 2020, 02:24 PM

ভাঙ্গা সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার গাজী রবিউল ইসলাম জানান, ভাঙ্গা উপজেলার মানিকদহ ইউনিয়নের লক্ষ্মীপুর গ্রামে তিন দিন আগে দুই পক্ষের সংঘাতের মধ্যে একজন নিহতের ঘটনায় ওই মামলা হয়েছে। 

গত মঙ্গলবার ওই সংঘর্ষের ঘটনার পরদিন স্থানীয় বাসিন্দা শাজাহান মাতুব্বর (৫৪) বাদী হয়ে হত্যা, ভাঙচুর, লুটপাট ও হামলার অভিযোগে মামলাটি দায়ের করেন।

আসলাম ফকিরসহ ৫৪ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতপরিচয় আরও ১৫ থেকে ২০ জনকে ওই মামলায় আসামি করা হয়েছে।

মামলার অভিযোগে বলা হয়, ২১ এপ্রিল রাতে লক্ষ্মীপুর গ্রামের লতিফ মাতুব্বরের ঘরের টিনের চালের পানি শাজাহানের ভাতিজা রফিক মাতুব্বরের বাড়ির উঠানে পড়াকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়।

“এর জের ধরে আসলাম ফকির ও উসমান ফকিরের হুকুমে আসামিরা লাঠি, লোহার রড, চায়নিজ কুড়াল, চাপাতি ও ধারালো অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে প্রথমে রফিক মাতুব্বরকে পিটিয়ে গুরুতর আহত করে তার বাড়ি ভাংচুর করে। এসময় শহীদ মাতুব্বর তাদের বাধা দিতে গেলে তাকে কুপিয়ে ও পিটিয়ে আহত করা হয়।”

ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পর মারা যান শহীদ, যিনি শাজাহান মাতুব্বরের আত্মীয়।

অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রবিউল বলেন, “প্রধান আসামি আসলাম ফকিরসহ অন্যরা পলাতক রয়েছেন। তাদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে।”

আসলাম ভাঙ্গা উপজেলার মানিকদহ ইউনিয়নের মানিকদহ গ্রামের বাসিন্দা হলেও লেখাপড়া ও রাজনীতি করেন পাশের সদরপুর উপজেলায়। তিনি ওই উপজেলা যুবলীগের সভাপতিও ছিলেন।

মানিকদহ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শাহেদ আলীকে কুপিয়ে হত্যার দায়ে ২০০৩ সালে মৃত্যুদণ্ডের রায় হলেও পরে তিনি মানসিক অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে ২০১৫ সালে রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করে প্রাণভিক্ষা পান এবং পরে সাধারণ ক্ষমার সুযোগে ২০১৭ সালে কারাগার থেকে মুক্তি পান।

তার বিরুদ্ধে আবার হত্যার অভিযোগ সম্পর্কে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আসলাম ফকিরের বিষয়টি আমি শুনেছি। অপরাধ করলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

আসলাম কীভাবে প্রাণভিক্ষা পেয়েছিলেন জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, “আমি ফাইল না দেখে কিছু বলতে পারব না। সম্ভবত মেন্টাল কিছু দেখিয়েছিল। তবে যা-ই হোক, অপরাধ করলে অবশ্যই সাজা পেতে হবে। এখানে কোনো ছাড় নেই।”

ফরিদপুরের জেলা ও দায়রা জজ আদালত আসলাম ফকিরকে যে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়েছিল, হাই কোর্টও তা বহাল ছিল। আসলাম ২০১৩ সালের ১৯ মে দোষ স্বীকার করে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করলে তাও খারিজ হয়ে গিয়েছিল।

কিন্তু ফাঁসি কার্যকরের উদ্যোগের মধ্যেই আসলামের প্রাণভিক্ষা চেয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে দ্বিতীয় দফা আবেদন করা হয়। সেখানে তার ‘মানসিক অসুস্থতার’ কথা বলা হয়।

দ্বিতীয় দফায় আসলাম ফকিরের প্রাণভিক্ষার আবেদন গ্রহণ করেন রাষ্ট্রপতি। ২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি দণ্ড হ্রাস করে আসলামকে ১৪ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

এর এক মাসের মাথায় বিশেষ দিবসে বন্দিদের সাধারণ ক্ষমার সুযোগে আসলাম ফকিরের মুক্তির জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অনানুষ্ঠানিক চিঠি (ডিও লেটার) দেন ফরিদপুর-৪ আসনের সাবেক সাংসদ নিলুফার জাফরউল্যাহ।

তবে সেসময় আসলামকে মুক্তি দেওয়া হয়নি। ১৩ বছর ২দিন কারাভোগের পর ২০১৭ সালের ২৫ অগাস্ট গাজীপুর হাই সিকিউরিটি কারাগার থেকে মুক্তি পান সাবেক এই যুবলীগে নেতা।

এ বিষয়ে কথা বলতে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফরউল্যাহর স্ত্রী নিলুফার জাফরউল্যাহকে ফোন করা হলে তিনি অসুস্থতার কথা বলে ফোন কেটে দেন।

ফরিদপুর-৪ (ভাঙ্গা, সদরপুর, চরভদ্রাসন) আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য মুজিবুর রহমান চৌধুরী নিক্সন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আসলাম ফকির একজন প্রাক্তন চেয়রম্যানকে খুন করে জেলে যান। প্রথমবার রাষ্ট্রপতি তাকে ক্ষমা করেননি। ফাঁসির লাল চিঠি রাষ্ট্রপতির কাছে গেলে আসলাম পাগল সেজে জোর তদবিরের মাধ্যমের রাষ্ট্রপতির ক্ষমা পান।

“ক্ষমা পাওয়ার পর আমার আসনের সাবেক এমপি কাজী জাফরউল্যাহ এই আসলামকে ওই (নিহত) চেয়ারম্যনের বাড়ির সামনে মঞ্চ করে সংবর্ধনা দেন। তখন চেয়ারম্যনের স্ত্রী আমার এখানে এসে কান্নাকাটি করেন। আমি তখন প্রতিবাদ করেছিলাম। প্রতিবাদ সমাবেশে বলেছিলাম, একজন খুনের আসামি এভাবে ছাড়া পাওয়া মানে আরেকটি খুনকে উৎসাহিত করা।”

নিক্সন বলেন, “দুই দিন আগে সেই আসলাম নিজে দাঁড়িয়ে থেকে আরেকটি খুন করেছে। শুধু খুনই করেনি সে, দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে।... এভাবে খুনের আসামিকে বের করে এনে আরেকটি খুন করানোর দায়িত্ব কে নেবে?”

বর্তমান সাংসদের এই মন্তব্যের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ সাবেক সাংসদ কাজী জাফরউল্যাহ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এটা টোটালি মিথ্যা কথা, সে আওয়ামী লীগের লোক। দীর্ঘ ২০-২৫ বছর যুবলীগের সভাপতি ছিল। এখন খুনের পরে আমার উপর দোষ চাপাচ্ছে।”

আসলামের মুক্তির পর তাকে সংবর্ধনা দেওয়া নিয়ে নিক্সন চৌধুরীর বক্তব্যের বিষয়ে প্রশ্ন করলে আওয়ামী লীগ নেতা জাফরউল্যাহ বলেন, “এখন খুনের পরে সে আমার লোক হয়ে গেল?”

তিনি দাবি করেন, তিন দিন আগের ওই হত্যাকাণ্ডের সময় আসলাম ফকির ‘আশেপাশেও ছিল না’।

“স্থানীয় প্রশাসন বিষয়টা জানে। নিক্সন চৌধুরীর দুই পক্ষের মারামারিতে একজন লোক খুন হয়েছে। আর আমরা তো ঢাকায় বসে আছি। তারপরও এলাকার প্রশাসনের কাছ থেকে খবর নিয়েছি, এই ঘটনার সঙ্গে আসলাম জড়িত না।”