ক্ষেত ফেটে চৌচির, সেচের পানি দিয়েছে মাছে

মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল হাইল হাওরের বোরো ধানের জমি ফেটে চৌচির হয়ে গেছে; অথচ ক্ষেতে সেচের জন্য নির্মিত রাবার ড্যামের পানি মাছের খামারে দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন কৃষকরা।

মৌলভীবাজার প্রতিনিধিবিকুল চক্রববর্তীবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 11 April 2020, 10:27 PM
Updated : 12 April 2020, 05:20 AM

‘হীন স্বার্থে’ কৃষকদের পানি না দিয়ে ফিসারি ও বিলের মাছ চাষিদের বিকল্প পথে পানি দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ করে কৃষকরা শ্রীমঙ্গল উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার কাছে গত ৯ এপ্রিল লিখিত অভিযোগ করেছেন।

কৃষকদের এ অভিযোগের খবর পেয়ে গত শুক্রবার হাইল হাওরের শ্রীমঙ্গল ইউনিয়নের উত্তরশূর এলাকায় সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, পানির অভাবে শত শত একর বোরো ধানের ক্ষেত ফেটে হা হয়ে আছে। বোরো ধান পাকার সময় হয়ে এলেও বেশির ভাগ ধানের শীষ আসেনি; অনেক গাছের আগা মরে যাচ্ছে।

স্থানীয় কৃষক নেপাল বৈদ্য জানান, সাড়ে চার একর জমিতে এবার বোরো লাগিয়েছেন তিনি কিন্তু ‘পানির অভাবে এখন পর্যন্ত প্রায় দুই একর জমির ফসল পুড়ে গেছে।’

অনেক টাকা খরচ করে করা তার বোরো ক্ষেত ‘খরায় সব শেষ হয়ে যাবে।’

“কয়েক দফা বৃষ্টি না হলে এ বছর না খেয়ে মরতে হবে।”

স্থানীয় কৃষকরা জানান, প্রায় বছরই বোরো ফসলের সময় পানির অভাবে ফসল হারান তারা। তাই তাদের আবেদনের প্রেক্ষিতে পানি সেচের জন্য পাঁচ বছর আগে হাওরের অদূরে প্রায় পাঁচ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি রাবার ড্যাম নির্মাণ করে সরকার। এ ড্যাম থেকে শ্রীমঙ্গল সদর ইউনিয়ন, আশিদ্রোন ইউনিয়ন ও ভুনবীর ইউনিয়নের কৃষকদের পানি দিয়ে থাকে।

প্রথম কয়েক বছর এর সুফল পেলেও এ ড্যাম এখন তাদের অঞ্চলের ‘দরিদ্র কৃষকদের দীর্ঘশ্বাসের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।’

তাদের অভিযোগ, এ বছর অন্য সবাইকে পানি দিলেও শ্রীমঙ্গল ইউনিয়নের অংশে পানি না দেওয়ায় শত শত একর জমি পানির অভাবে মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়েছে।

এ ড্যাম নির্মাণের পর পানি ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা আনতে লংলা নদী সমবায় সমিতি নামে একটি সমিতি গড়ে তোলা হয়। ভুনবীর ইউপি চেয়ারম্যান চেরাগ আলী এ সমিতির সভাপতি আর স্থানীয় ইউপি সদস্য দুদু মিয়া সাধারণ সম্পাদক।

অপর কৃষক ওমর আলী অভিযোগ করেন, বোরো ফসলের এ পানি পাশের ব্র্যাক মাছের খামারে বিক্রি করছে এ সমিতি।

সামনে করোনাভাইরাস থেকে খাদ্য সঙ্কট দেখা দিলে এ ফসলে পরিবার পরিজন নিয়ে দুবেলা খেয়ে পরে বেঁচে থাকতে পারতেন জানিয়ে তিনি বলেন, “ফসল নষ্ট হলে তো বউ ছেলে নিয়ে পথে বসতে হবে।”

সাত একর জমিতে এবার বোরো চাষ করা এই কৃষক জানান, গত এক মাস ধরে রাবার ড্যামের ‘পাম্প-ম্যানের’ কাছে ধর্ণা দিয়েও পানি পাচ্ছেন না তিনি।

“ধানের চারায় এ সময় ফুল এসেছে আর সেই সময়ে পানির অভাবে চারা শুকিয়ে ধূসর বর্ণ ধারণ করছে।

“এই ফসল ঘরে তুলতে না পারলে, না খেয়ে থাকতে হবে।”

একই এলাকার তিন একর জমিতে বোরো আবাদ করা কৃষক ইন্নান মিয়া জানান, জমি তৈরি, বীজ, চারা রোপন, সার ও পরিচর্যা করে এ পযর্ন্ত চারা বড় করতে সব খরচ করে ফেলেছেন।

“সরকার থেকে কোনো সহায়তাও পাওয়া যায়নি।”

এখন পানির অভাবে এ শস্য ঘরে তুলতে না পারলে পরিজন নিয়ে না খেয়ে থাকতে হবে তাদের বলে জানান তিনি।

একই অবস্থা এ এলাকার রহমত আলী, মিন্টু বৈদ্য, মা. মইনুদ্দিন, ছবির মিয়া, মংগল মিয়া, ফয়জুল্লাহ, ওমর মিয়াসহ আরোও অনেক প্রান্তিক কৃষকের।

তারা জানান, ড্যামে অপর অংশে বিলাসের পাড়ে ফসল কম এমন জমিতেও বিভিন্ন ফিসারিতে পর্যাপ্ত পানি দেওয়া হয়েছে। অথচ কৃষিকাজের জন্য নির্মিত সরকারি এ ড্যাম্পের পানি থেকে কৃষকরাই বঞ্চিত হচ্ছেন।

গত ৯ এপ্রিল স্থানীয় কৃষকদের উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার পানি সেচের আবেদনের প্রসঙ্গে স্থানীয় ইউপি সদস্য দুদু মিয়া বলেন, আশিদ্রোন, উত্তরসূর ও ভূনবীর এলাকায় এ ড্যাম্পের পানি বণ্টন করা হয়। কিন্তু এবার খরার কারণে গোপলা নদীর পানি প্রবাহ কমে গেছে। একই সাথে চারিদিকে পানির চাহিদা বেড় যাওয়ায় এ সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে।

“২-১ দিনের মধ্যে এ সমস্যা কেটে যাবে।”

একইভাবে ছড়ায় পানির স্রোত কমের কথা পাড়েন ড্যাম্প অপারেটর সুরুক মিয়াও।

তিনি বলেন, “পানির জন্য এতদিন কেউ তার কাছে আসেনি।

“এখন খরার কবলে পড়ে সব জায়গা থেকে পানির চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় তারা এসেছেন। সবাই এক সাথে আসায় সাময়িক এ সমস্যা দেখা দিয়েছে।”

ড্যামের পানি মাছের খামারে বিক্রির বিষয়ে জানতে চাইলে সুরুক মিয়া বলেন, “আগে দিয়েছি এখন বন্ধ।”

তিনি জানান, সমিতির সদস্যরা পানির মূল্য হিসেবে ‘কেয়ার’ প্রতি আধামণ করে ধান দেওয়ার কথা, কিন্তু বেশির ভাগ কৃষক তাও দেন না।

ড্যাম্পের রক্ষণাবেক্ষণে রশিদ মূলে ব্র্যাক ফিসারিতে ৩০ হাজার টাকায় কিছু পানি বিক্রি করা হয়েছে বলে তিনি জানান।

“কৃষকরা খরচ দিতে হবে তাই তারা আগে পানি নিতে আসেননি। তারা মনে করেছিলেন বৃষ্টি হলে পানি লাগবে না। এখন বৃষ্টি হয়নি তারা এসেছেন পানি নিতে।

“তারপরও তারা নিয়ম অনুযায়ী টাকা দিতে নারাজ। গত বছরের দুই হাজার টাকা এখনও তারা দেননি। এ বছর তিন দিন আগে ৫ হাজার টাকা দিয়েছেন।

“তাদের পানির বাঁধ ছাড়া আছে, পানি যাচ্ছে তবে কম। ছড়ায় স্রোত বাড়লে বেশি যাবে।”

এ ব্যাপারে  শনিবার দুপুরে শ্রীমঙ্গল উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা নিলুফার ইয়াসমিন বলেন, “এবার তো বৃষ্টি নেই। ফলে বিলাসের উৎসমূখে পানি কম আসছে।

“তাছাড়া ড্যাম থেকে উত্তরসূর পর্যন্ত কয়েক কিলোমিটার পথে প্রয়োজনীয় কোনো ড্রেন নেই। অনেক স্থানে সংস্কার অভাবে ড্রেন মুখ বন্ধ হয়ে গেছে। এ কারণে পানি যেতে অনেকটা সময় লাগে।”

তিনি জানান, ইউপি সদস্য দুদু মিয়া ও ড্যামের দেখাশোনার দায়িত্বে থাকা সুরুক মিয়াকে বলে দিয়েছেন-যতদ্রুত সম্ভব পানি প্রবাহের সব প্রতিবন্ধকতা দূর করে ক্ষতিগ্রস্ত জমিতে সেচের পানি দেওয়ার জন্য।

“এছাড়া বিলাসে দিকে যে সব জমিতে আবাদ নেই অথচ পানি চলে যাচ্ছে তা বন্ধ করতে বলেছি।”

তিনি জানান, এবার শ্রীমঙ্গলে ৯ হাজার ৪শ’ ১২ হেক্টর জমিতে বোরো চাষাবাদ হয়েছে। এর মধ্যে হাওরে তিন হাজার হেক্টর; যার বেশির ভাগ পানি সঙ্কটে পড়েছে।

তবে শ্রীমঙ্গল ইউনিয়নের উত্তর উত্তরশূর অংশে বেশ ক্ষতি হয়েছে উল্লেখ করে তিনি দাবি করেন, দ্রুত বৃষ্টি ও ড্যামের পানি আসলে এখনও অনেক জমিতে প্রত্যাশিত ফসল পাওয়া সম্ভব।