নেত্রকোণার হাওরে কৃষকের হাসিতে করোনাভাইরাসের ছায়া

নেত্রকোণায় হাওরাঞ্চলে এবার বোরো ধানের ভালো ফলন হলেও করোনাভাইরাসের কালো ছায়া কৃষকদের মুখে আঁধার হয়ে নেমেছে।

লাভলু পাল চৌধুরী নেত্রকোণা প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 April 2020, 07:14 PM
Updated : 10 April 2020, 07:14 PM

জেলার বাইরে থেকে অন্য বছরের মতো এবার কৃষি শ্রমিক আসা নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে।

কৃষকরা বলছেন, শ্রমিক না এলে মাঠের ফসল মাঠেই পড়ে থাকবে; গোলায় তোলা সম্ভব হবে না।

তবে কৃষি কর্মকর্তরা বলছেন, ধান কাটতে কৃষকদের জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার। 

ছোট-বড় মিলিয়ে ৮২টি হাওর নিয়ে ৪০৮ বর্গকিলোমিটারের হাওরাঞ্চল নেত্রকোণার মদন, মোহনগঞ্জ, খালিয়াজুরি ছাড়াও কলমাকান্দা ও আটপাড়ার উপজেলার একাংশ। এক ফসলী কৃষির এই হাওর এলাকায় আবাদি জমি রয়েছে প্রায় ৫০ হাজার হেক্টর। হাওরপাড়ে থাকা ৮০ হাজারেরও বেশি কৃষক সেখানের জমিতে বোরো আবাদ করেই জীবিকা চালান।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও হাওর পাড়ের কৃষকেরা জানান, নেত্রকোণায় বোরো আবাদ হয়েছে এক লাখ ৮৪ হাজার ৫৩০ হেক্টর জমিতে। এর মধ্যে এবার হাওর এলাকায়  আবাদ হয়েছে ৪০ হাজার ৮৬৫ হেক্টর জমি। ব্রি -২৮ ধান আবাদ করায় মাঠে আগাম ধান পাকতে শুরু করেছে। তিন থেকে চার দিনের মধ্যে কাটা শুরু হবে।

প্রতিবছর জামালপুর, টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ, গাইবান্দা, পাবনাসহ উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলা থেকে কৃষি শ্রমিকেরা এসে ধান কাটেন। কিন্তু এবার করোনাভাইরাসের কারণে যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ থাকাসহ অন্য জেলার মানুষ প্রবেশে নিষেধাজ্ঞার কারণে এখনও কোনো শ্রমিক আসেননি। এ অবস্থায় কৃষকেরা ফসল নিয়ে পড়েছেন বিপাকে।

মদন উপজেলা সদরের কৃষক নুরুল হক রুনু বলেন, “জমি তো অনেক, যদি বাইরের লোক না আসে তাহলে আমরা জমি কাটতে পারব না। করোনাভাইরাসের জন্য গাড়ি আসে না। যদি তাদরকে সুযোগ কইরা দেয় যারা বাইরের শ্রমিক ধান কাটবে তাদের জন্য, তাহলে আমাদের জন্যে খুব ভালো হয়।”

খালিয়াজুরীর গাজীপুর গ্রামের কৃষক আইন উদ্দিন বলেন, “আমরার এই দেশে যদি বাইরের লোক না আসে আমরা ধান কাটতে পারব না। কাইট্যা আমরা কুলাইতে পারব না। পানি ধান তল কইরা ফালব। আমরা বাইরের লোক চাই। আমরার ফসল তুলতে গেলে বাইরের লোক লাগব। এই মেশিন লাগব। পরে বোমামেশিন (কাটা-মারাই যন্ত্র) লাগব। আগে যে মাড়া (মাড়াই) দিছি এখন আার মাড়া দিতে পারি না। অহন কাইট্যা খালি ভাংগানি।”

ধার দেনা করে আবাদ করা ফসল ফলানোর কথা জানিয়ে কৃষকেরা করোনাভাইরাসের জন্য শ্রমিক না আসায় ধান কাটা, মারাইয়ের যন্ত্র দিয়ে সহযোগিতার দাবি জানিয়েছেন সরকারের কাছে।

খালিয়াজুরী উপজেলার দিঘলহাটি গ্রামের জীবন চন্দ্র সরকার বলেন, “২৪ কাঠা জমি আমি করছি। অহন তো লোক নাই। রেনাফেনা (ঋণ) কইরা করছি। অহন যদি লোক এ্ই দেশে না আসে জমি কাটার সামর্থ্য আমরার নাই। কীভাবে কীকরব এখন আমরা দুশ্চিন্তায় আছি। সরকারের কাছে আবেদন এইডাই। আমাদের এলাকায় যাতে লোক আসে, আসার সুযোগ দেয়, এইডাই আমাদের চাওয়া পাওয়া।”

খালিয়াজুরী সদরের কৃষক শফিকুল ইসলাম তালুকদার বলেন, “আমার লাগানো ১৫ একর জমি কাটার জন্য অন্তত ২০ জন লেবার লাগে। এখন লেবার পাচ্ছি না। লেবারের অভাবে খুব সমস্যায় আছি। এইগুলা কাটার জন্যে করোনাভাইরাসের জন্যে কোনো লেবার আসতেছে না আমাদের এলাকায়। কাটার জন্য সরকারিভাবে যদি আমাদের যন্ত্র দিয়া সহযোগিতা করত, ধান কাটার মেশিন দিয়া যদি সহযোগিতা করত, তাহলে আমরা হাওরের ধানগুলা গোলায় তুলতে পারতাম।”

খালিয়াজুরীর নয়াপাড়া গ্রামের স্বাধীন চন্দ্র বর্মণ বলেন, “খালিয়াজুরী ভাটি অঞ্চলে আমরার একটা ফসল। যদি শ্রমিক না আসে, বাইরের মানুষ না আসে, তাহলে আমরা ধানগুলা তুলতে পারব না। সমস্যা হইব তুলতে। সমস্যা মানে তুলতেই পারব না যদি দাওয়াল (ধানকাটা শ্রমিক) না আসে।”

মোহনগঞ্জের বরান্তর গ্রামের কবীর হোসেন বলেন, “আমরা যারা কৃষি শ্রমিক আছি কৃষি কাজ করি- সারা বছরেই একটাই ফসল। বাইর থেকে দাওয়াল না আসলে বা শ্রমিক না আসলে এইটা কী করে তুলব আমাদের গোলাতে। তাছাড়া আগাম বন্যা যে কোনো সময় হয়ে যেতে পারে। বন্যার কবলে পড়লে তো সব ফসলই পানির নিচে চলে যাবে। হাওরে যে ফসল রক্ষা বাঁধ রয়েছে তা সব সময় কার্যকর হয় না। বন্যার ধরনের ওপর নির্ভর করে। একটু আধটু পানি আইলে এসব বাঁধে কিছুটা কাজ হয়। এইসব সমস্যা নিয়া আমরা দুশ্চিন্তায় আছি।”

দ্রুত ফসল কাটতে পাউবোর চিঠি কৃষি বিভাগকে

নেত্রকোণা পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকৌশলী মুহাম্মদ আক্তারুজ্জামান গত ৫ এপ্রিল নেত্রকোণা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক হাবিবুর রহমানকে চলমান বোরো মওসুমের পাকা ধান কাটা নিয়ে চিঠি দিয়েছেন।

চিঠিতে তিনি বলেন, হাওরে পাকা ধান কাটা শুরু হয়েছে। তবে কিছুদিন ধরে করোনাভাইরাস সংক্রান্ত কারণে ধান কাটা শ্রমিকের সংখ্যা অপ্রতুল। আবহাওয়ার পূর্বাভাস অনুযায়ী চলতি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের শেষ দুই- তিন দিন এবং চলতি মাসের শেষ সপ্তাহে ভারি বৃষ্টিপাত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এ কারণে সময়মত ধান কাটতে না পারলে হাওরে পাকা ধান কাটা ব্যাহত ও আগাম বন্যায় হাওরের ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তাই কৃষককূল চলতি মওসুমে সম্পূর্ণ পাকা ধান ঘরে তুলতে পারবে কিনা এ নিয়ে খুব দুশ্চিন্তায় আছে।

তাই আপনার দপ্তর থেকে হাওর এলাকায় পর্যাপ্ত পরিমাণে ধান কাটার মেশিন সরবরাহের ব্যবস্থা করে দ্রুত সময়ে ধান কাটার বিষয়ে ব্লক সুপারভাইজারদের সক্রিয় করার ব্যবস্থা নিন।

হাওরে ফসল রক্ষা বাঁধ

নেত্রকোণায় ৩৩০ কিলোমিটার ফসল রক্ষা বাঁধের মধ্যে ১০০ কিলোমিটার ডুবন্ত বাঁধ রয়েছে। এ বছর ১৪ কোটি  টাকা ব্যায়ে বাঁধের সংস্কার কাজ করা হয়। সংস্কার কাজে সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তা ও এলাকার কৃষকদের নিয়ে গঠিত ১২৩টি প্রকল্প বাস্তাবায়ন কমিটি গঠন করা হয়। তারাই কাজ তদারকি করেন।

তবে কৃষকদের অভিযোগ, বাঁধ সংস্কারের বিভিন্ন প্রকল্প অংশে কাজে গাফিলতি হয়েছে। প্রকল্পের প্রাক্কলন অনুযায়ী সব কাজ হয়নি।

খালিযাজুরীর কৃষক মনির হোসেন অভিযোগ করেন, “বাঁধের যে ফিনিশিং তা করা হয়নি। ঘাস লাগানো হয়নি প্রায় জায়গাতেই। আবার যেখানে লাগানো হয়েছে তাও লোকদেখানো। এছাড়াও সঠিক পরিমাণ মাটিকাটা হয়নি। বাঁধের কিনার থেকে মাটি কেটে বাঁধে ফেলেছে প্রকল্পের নিয়ম না মেনে অনেকস্থানে। এসব ক্ষেত্রে প্রকল্প বাস্তাবায়নে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের তদারকি ছিল দুর্বল।”

এ ব্যাপারে খালিয়াজুরী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এ এইচ এম আরিফুল ইসলাম  বলেন, প্রকল্পের শেষ দিকে করোনাভাইরাসের কারণে শ্রমিক পাওয়া যায়নি। তাই ফিনিশিং কাজটা ভালভাবে সম্পন্ন হয়নি। ঘাস  লাগানো যায়নি সবস্থানে।

জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মুহাম্মদ আক্তারুজ্জামান বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে বেশকিছু প্রকল্পের শেষ দিকে শ্রমিক সংকট দেখা দেয়। এতে করে ফিনিশিং কাজ যেমন ঘাস লাগানো সম্ভব হয়নি। তবে এখনও চেষ্টা হচ্ছে।

আগামী ২৮ থেকে ৩০ এপ্রিলের মধ্যে যেভাবেই হোক হাওরের ফসল কাটা সম্পন্ন করতে পরামর্শ দেন তিনি।

এই মাসের শেষ দিকে ভারি বৃষ্টিপাত হতে পারে। কোনো ঝুঁকি নেওয়া উচিৎ হবে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, মে মাসের ১০ তারিখ নাগাদ ডুবন্ত যে ফসল রক্ষা বাঁধগুলো আছে সেগুলোতে হযত ফসল রক্ষা করা সম্ভব হতে পারে। তবে যেহেতু ভারি বৃষ্টিপাতের শঙ্কা আছে তাই একটু আগেই ফসল তুলে শেষ করতে হবে।

হাওরের ধান কাটায় কৃষি যন্ত্রসহ সব ধরনের সহযোগিতা নিয়ে সরকার কৃষকের পাশে থাকবে বলছেন জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক হাবিবুর রহমান।

তিনি বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে করোনাজনিত কারণে কৃষকের ধান কর্তনে বিশেষ করে শ্রমিকের অভাবে কৃষকের সমস্যা হতে পারে। ইতিমধ্যে সরকার হাওর এলাকার জন্যে প্রায় ২৮টি কম্বাইন্ড হারভেষ্টার তাদের বরাদ্দ দিয়েছে। এর মধ্যে তারা পেয়ে ডাবেন।

“পাশাপাশি যে সময় শ্রমিকেরা বাইরের জেলা থেকে এসে কাজ করে; বিশেষ করে টাঙ্গাইল, পাবনা, গাইবান্ধা- আমরা এইসব জেলায় যোগাযোগ করছি। তাদেরকে এনে সরকারি ব্যবস্থাপনায় স্বাস্থ্যবিধি অনুযায়ী যাতে মাঠে কাজ করতে পারে এই ব্যবস্থা করার জন্যে আমরা চেষ্টা করছি।”

হাবিবুর রহমান বলেন, “নেত্রকোণা জেলায় বোরো উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে চাল সাত লক্ষ ৪৫ হাজার মেট্রিক টন। আশা করছি বেশি হবে।”

তিনি জানান, এবার জাতীয়ভাবে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ৪৮ লাখ ৫৬ হাজার হেক্টর জমি। এর মধ্যে ৪৭ লাখ ৫৪ হাজার ৪০ হেক্টর জমিতে চাষ হয়। এই জমিতে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২ কোটি ৪ লাখ ৩৬ হাজার মেট্রিক টন।