ভোগান্তি পেরিয়ে এসে কারখানা বন্ধ দেখে পোশাককর্মীদের শঙ্কা-ক্ষোভ

তৈরি পোশাক কারখানা খোলার কথা শুনে দূর দূরান্ত থেকে ভোগান্তি নিয়ে এসে কাজে যোগ দিতে না পেরে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সাভার, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জের হাজার হাজার শ্রমিকরা।

সাভার, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 April 2020, 02:15 PM
Updated : 5 April 2020, 03:56 PM

তারা বলছেন, কারখানা যে খোলা হবে না, তা আগে জানালে তারা ঝুঁকি নিয়ে কষ্ট করে বাড়ি থেকে আসতেন না।

আবার কাজে যোগ দিতে না পারায় বেতন না পাওয়া এবং ছাঁটাই হওয়ার আতঙ্কও রয়েছে অনেকের মধ্যে।

দেশে নভেল করোনাভাইরাস মহামারী ঠেকাতে গত ২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত সরকার অফিস আদালত ও যানবাহন চলাচল বন্ধ করে সবাইকে ঘরে থাকার নির্দেশনা দিলেও পোশাক কারখানার বিষয়ে স্পষ্ট কোনো ঘোষণা ছিল না।

তখন পোশাক শিল্প মালিকদের দুই সংগঠন বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ অধিকাংশ কারখানা বন্ধের সিদ্ধান্ত দিলে শ্রমিকরা বাড়ি ফিরে যান।

এরপর ‘লকডাউনের’ মেয়াদ ১১ এপ্রিল পর্যন্ত বাড়ানো হলেও শনি ও রোববার কিছু পোশাক কারখানা খুলবে শুনে শুক্রবার থেকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুরের পথে রওনা হন অনেক পোশাক শ্রমিক। গণপরিবহন বন্ধ থাকায় তাদের বেশিরভাগই হেঁটেই রওনা হন।

দলে দলে শ্রমিকদের ফেরার এই ঘটনায় রোগ ছড়ানোর ঝুঁকি তৈরি হওয়ায় তীব্র সমালোচনা শুরু হলে বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ নেতারা সব ধরনের পোশাক কারখানা ১১ এপ্রিল পর্যন্ত বন্ধ রাখতে মালিকদের প্রতি আহ্বান জানান শনিবার রাতে।

এরপর রোববার সকাল থেকে সাভার, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন কারখানায় এসেও ফিরে যেতে হয় হাজার হাজার শ্রমিককে। আবার কিছু কারাখানা খোলা রাখায় সাভার ও গাজীপুরে বিক্ষোভও হয়েছে।

আশুলিয়ার জিরাব পুকুরপাড় এলাকার অ্যালায়েন্স নিট কম্পোজিট লিমিটেডের শ্রমিক রিপন মোহন্ত বলেন, আগের ঘোষণা অনুযায়ী তারা সকালে কারখানায় গেলে কর্তৃপক্ষ সকাল সাড়ে ১০টায় ছুটি ঘোষণা করে। এখন এই অবস্থায় বেতন পাওয়া যাবে কি না, তা নিয়ে তিনি দুশ্চিন্তায় আছেন।

গাজীপুরের ভোগড়া এলাকার গবিব অ্যান্ড গরিব স্যুয়েটার কারখানায় অপারেটরের কাজ করেন জলিল মিয়া। তিনি বলেন, গত ২৬ মার্চ কারখানা বন্ধ হওয়ায় তারা গ্রামের বাড়ি চলে গিয়েছিলেন। অনেক কষ্ট করে রোববার কাজে যোগ দেওয়ার জন্য ফিরেছেন।

“এসে জানতে পারলাম যে ১১ এপ্রিল পর্যন্ত ছুটি বাড়ানো হয়েছে। এখন মালিক আমাদের ফিরে যেতে বলছে। কিন্তু বেতন দেয়নি। কবে পাব তাও বলেনি। বলছে, পরে দেওয়া হবে। এখন তো আমাদের হাত খালি। বাড়ি ভাড়া, দোকানে বকেয়া পরিশোধ করতে হবে। আমরা দুশ্চিন্তার মধ্যে আছি।”

এ বিষয়ে ওই কারখানার পরিচালক মো. ফজলুল হক বলেন, তিনি শনিবার রাত ১০টায় জানতে পারেন বিজিএমইএ ১১ এপ্রিল পর্যন্ত ছুটির ঘোষণা দিয়েছে। ফলে শ্রমিকদের আগে জানানো সম্ভব হয়নি।

“আগে সিদ্ধান্তমত ছুটি শেষে রোববার কারখানা চালু হওয়ার কথা। সেই হিসেবে শ্রমিকরা সকালেই কারখানায় চলে আসে। তাই কারখানা না খুলে তাদের ১১ এপ্রিল আসতে বলেছি। বিজিএমইএ ছুটি বাড়ানোর ঘোষণা আগে দিতে পারত।”

১১ এপ্রিল কারখানা খুললে বেতনের বিষয়ে ঘোষণা দেবেন বলে তিনি জানান।

গাজীপুর শিল্পাঞ্চল পুলিশের পরিদর্শক মো. আসাদুজ্জামান বলেন, আগের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রোববার সকালে কাজে যোগ দিতে না পেরে শ্রমিকরা মহাসড়কে অবস্থান নিয়ে কিছুক্ষণ বিক্ষোভ দেখিয়েছে। পরে পুলিশ গিয়ে তাদের বুঝিয়ে সরিয়ে দিয়েছে।

অধিকাংশ কারখানা বন্ধ থাকলেও গাজীপুরে কিছু কারখানায় কাজ শুরু হয়েছে। আবার অনেক কারখানা ২৬ তারিখের পরও বন্ধ হয়নি বলে শ্রমিকরা জানিয়েছেন ।

গাজীপুরের হোতাপড়া এলাকায় এনার্জিপ্যাক ফ্যাশনস লিমিটেডের ব্যবস্থাপক মো. সফিকুল ইসলাম রাজীব বলেন, তারা ২৬ মার্চ থেকে বন্ধ রাখলেও সংক্রমণ ঠেকানোর ‘সব ব্যবস্থা নিয়ে’ আবার কারখানা চালু করেছেন।

“আমরা শ্রমিকদের মধ্যে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখেছি। তাপমাত্রা মাপা হচ্ছে। সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা আছে।”

রাজীব বলেন, “এখন যেসব ক্রয়াদেশ আছে সেগুলোর কাজ করছি। এখনও জার্মানিতে মার্কেট খোলা আছে। কারখানা বন্ধ রাখলে জার্মানিতে আমাদের অর্ডারগুলো বাতিল হয়ে যাবে। তাই আমরা উৎপাদন অব্যাহত রেখেছি। আমাদের জনবল সাড়ে চার হাজার। সবাই নিরাপদে কাজ করছে।”

শ্রীপুর উপজেলার প্যারামাউন্ট টেক্সটাইলে ২৬ তারিখের পরও কাজ হয়েছে। তবে যারা বাড়ি চলে গিয়েছিলেন, রোববার ফেরার পর তাদের আর ঢুকতে দেওয়া হয়নি বলে জানান ওই কারখানার অপারেটর জুয়েল মিয়া।

শিল্পাঞ্চল পুলিশের পরিদর্শক মো. আসাদুজ্জামানও জানিয়েছেন, ওই কারখানা আগেও বন্ধ হয়নি, এখনও কাজ চলছে।

ছুটি থেকে ফেরা শ্রমিকদের কেন ঢুকতে দেওয়া হয়নি, সে বিষয়ে কারখানা কর্তৃপক্ষের বক্তব্য জানা যায়নি।

গাজীপুরের কোনাবাড়ি ও কাশিপুর এলাকাতেও কিছু কারখানা খোলা রয়েছে বলে জানিয়েছেন কাশিমপুর এলাকায় কর্মরত শিল্প পুলিশের পরিদর্শক আব্দুল জলিল।

ঢাকা রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের (ডিইপিজেড) মহাব্যবস্থাপক আবদুস সোবহান বলেন, সাভার ইপিজেডের বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও রোববার বেশ কিছু কারখানা খুলে দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে সেসব কারখানায় পারসোনাল প্রটেকশন ইকুইপমেন্ট (পিপিই) তৈরি হচ্ছে সেগুলো খোলা হয়েছে। তবে প্রয়োজন হলে এসব প্রতিষ্ঠানও বন্ধ করে দেওয়া হতে পারে।

গাজীপুর ও সাভারের মত নারায়ণগঞ্জের আদমজী ইপিজেডসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের হাজার হাজার শ্রমিক সকালে কারখানায় এসে কাজে যোগ দিতে পারেননি।

আদমজী ইপিজেডে এক ডজনের বেশি বড় কারখানা রয়েছে। সেসব কারখানায় ৩৫ থেকে ৪০ হাজারের মত শ্রমিক কাজ করেন।

ছুটি শেষে কাজে যোগ দিতে ভোর থেকেই হাজার হাজার শ্রমিককে পায়ে হেঁটে অথবা অটোরিকশায় করে ইপিজেডে আসতে দেখা যায়। এই পরিস্থিতিতে নারায়ণগঞ্জ-আদমজী-ডেমরা সড়কে শ্রমিকদের ঢল নামে।

ইপিজেড গেইটের সামনে নিরাপত্তা প্রহরীরা বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলেও শ্রমিকরা মানেননি। কিন্তু কারখানায় গিয়ে তারা জানতে পারেন, ছুটি ১১ এপ্রিল পর্যন্ত বেড়েছে।

নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার পঞ্চবটি বিসিক শিল্পনগরীর অধিকাংশ পোশাক কারখানাও এদিন বন্ধ ছিল। সেখানেও অনেক শ্রমিক কাজে যোগ দিতে এসে ফিরে গেছেন।

শিল্প পুলিশ-৪ এর পুলিশ সুপার সৈকত শাহীন বলেন, নারায়ণগঞ্জ জেলায় ২৪৫৯টি পোশাক কারখানায় ৪৫ লাখ শ্রমিক কাজ করে। এর মধ্যে বিজিএমইএ ও বিকেএমইএর সদস্যভুক্ত ৪০টি পোশাক কারখানাসহ নিটিং, ডাইং, সিমেন্ট, বিস্কুটসহ বিভিন্ন ধরনের ২৭৫টি কারখানা রোববার খোলা ছিল।

“যেসব কারখানা বন্ধ সেখানেও অনেক শ্রমিক সকালে কাজে যোগ দিতে এসে ফিরে গেছে।”

এদিকে কারখানা খোলা রাখায় প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের ব্যাপক বিস্তার ঘটতে পারে বলে উদ্বেগ রয়েছে।

গার্মেন্ট শ্রমিক ঐক্য ফোরামের সভাপতি মোশরেফা মিশু বলেন, “শ্রমঘন এলাকায় করোনাভাইরাস থেকে কতটুকু নিরাপত্তা পাবেন শ্রমিকরা তা নিয়ে আমরা আতঙ্কে রয়েছি। অনেক জায়গায় ছাঁটাইয়ের পরিকল্পনা চলছে বলেও শুনেছি। এদিকে সামনে ঈদ। শ্রমিকরা শঙ্কায় রয়েছেন।”

এক্সপোর্টারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি ও বিজিএমইএ সদস্য মো. আব্দুস সালাম মুর্শেদী আশ্বাস দিয়েছেন, বেতন নিয়ে কোনো ‘সমস্যা হবে না’।

“আশুলিয়া এলাকায় কারখানার মালিকদের নিয়ে বৈঠক হয়েছে। ১২ থেকে ১৫ এপ্রিলের মধ্যে বেতন-ভাতা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এছাড়া কারখানায় করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধে সব ধরনের সতর্কতা ও প্রতিরোধী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

বিজিএমইএর সভাপতি রুবানা হকও আশ্বস্ত করেছেন, “তারা বেতন পাবেন। এটা নিয়ে তাদের শঙ্কিত হবার প্রয়োজন নেই। একইভাবে ছুটির কারণে তারা চাকরি হারাবেন না।”

আরও পড়ুন