কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসন নিয়ে নাগরিক সমাজের প্রশ্ন

মধ্যরাতে সাংবাদিককে বাড়ি থেকে তুলে এনে দণ্ড দিয়ে কারাগারে পাঠানোর ঘটনায় শঙ্কিত কুড়িগ্রামের নাগরিক সমাজ।

তাজুল ইসলাম রেজাবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 March 2020, 06:14 PM
Updated : 15 March 2020, 09:12 PM

শুক্রবার মাঝরাতে কুড়িগ্রামের সাংবাদিক আরিফুল ইসলাম রিগানের বাড়িতে হানা দেয় প্রশাসন। তুলে এনে সে রাতে তাকে বিবস্ত্র করে চোখ বেঁধে মারধর করার অভিযোগ করেন রোববার জামিনে মুক্ত হয়ে আরিফ। মদ ও গাঁজা রাখায় দায়ে জরিমানা ও এক বছরের সাজা দিয়ে তাকে কারাগারে পাঠিয়েছিল সে রাতের ভ্রাম্যমাণ আদালত।

আরিফকে সাজা দেওয়ার পর থেকেই দেশ জুড়ে প্রতিবাদ শুরু হয়। মন্ত্রণালয় থেকে তদন্ত করে দ্রুত পরিস্থিতির সামাল দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়। চাপের মুখে আরিফ জামিনে মুক্তি পান।

তবে আরিফের মুখে নির্যাতনের ভয়াবহ বর্ণনা শুনে নাগরিক সমাজের প্রশাসন নিয়ে প্রশ্ন জেগেছে।

কুড়িগ্রামের আইনজীবী ও জেলা বাসদ নেতা শামসুল ইসলাম বলেন, বর্ণনা শুনে বোঝা যায়, শুধু মারপিট আর কারাদণ্ড দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা। তাকে বিবস্ত্র করে ভিডিও ক্যামেরায় সেই দৃশ্য ধারণ করেছে।

“কেমন বিকৃত রুচি জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের,  প্রশাসনের সব কর্মকর্তা কি অসুস্থ?“

তিনি প্রশ্ন তুলেছেন-এ কর্মকর্তাদের কাছে কতটা নিরাপদ উত্তরের পিছিয়ে থাকা এই জনপদের সাধারণ মানুষ?

জেলার প্রবীণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব জেলা ন্যাপের সাবেক সভাপতি এটিএম এনামুল চৌধুরী বলেন, “পূর্ব পাকিস্তানের সময়েও প্রশাসনের এ রকম ভুমিকা দেখা যেত না।

“সবকিছু দলীয়করণ এমনভাবে করা হয়েছে যে, এখন রাষ্ট্রের দলীয় কর্মকর্তাদের কাছে আমরা কেউ নিরাপদ নই।”

জেলা কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক নুর মোহাম্মদ আনসার জানান, সম্প্রতি জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের জন্য তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির বিভিন্ন পদে ৪০ থেকে ৫০ জন্য লোক নিয়োগে অনিয়ম ও বিশাল বাণিজ্য নিয়ে প্রশ্ন ওঠে কুড়িগ্রামে।

“এ বিষয়ে সাংবাদিক আরিফ বিভিন্ন সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লেখেন। এই কারণে জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা এতটা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে।

“এই ঘটনার সাথে শুধু জেলা প্রশাসনই নয়, স্থানীয় সরকার, দলীয় লোকজনেরও ইঙ্গিত আছে। ঘটনাটির সুষ্ঠু তদন্ত হলেই প্রকৃত ঘটনা… থলের বিড়াল বেড়িয়ে আসবে।”

জামিনে মুক্তি পর আরিফের দেওয়া বক্তব্যের ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে দেখা যায়, আরিফ বলছেন, ‘দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকেই আরডিসি নাজিম উদ্দিন আমার মাথায় কিল-ঘুষি মারতে শুরু করেন এবং অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ শুরু করেন।

“এরপর আমাকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যান। আমি বারবার বলেছি, “আমার কী দোষ? আমি তো কোনও অন্যায় করিনি।” তিনি বলেন, “বড় সাংবাদিক হয়ে গেছিস। তোর সাংবাদিকতা ছোটাবো। ডিসির বিরুদ্ধে লিখিস।”

“এসব বলে আমাকে টেনে হিঁচড়ে গাড়িতে ওঠায়। তারপর বলেন, “এর চোখ বাঁধো। এর দিন শেষ। একে আজই এনকাউন্টারে দেবো।”

“আমাকেও তিনি (আরডিসি নাজিম উদ্দিন) বারবার বলেন, ‘তুই কলেমা পড়ে নে, তোকে এনকাউন্টারে দেওয়া হবে।’ এই কথা শোনার পর আমি পুরো আপসেট হয়ে ভাবি, সত্যিই তারা আমাকে মেরে ফেলার জন্য নিয়ে যাচ্ছে।”

আরিফুলকে আরও বলতে দেখা যায়, “এ সময় তাদের কাছে অনুনয় বিনয় করে আমার প্রাণ ভিক্ষা চাই। তাদের বলি, আমার বাবা-মা নেই, আমাকে মেরে ফেলা হলে দু’টি সন্তান এতিম হয়ে যাবে। পরে তারা আমাকে গাড়িতে করে একটি ভবনে নিয়ে চোখের কাপড় একটু খুললে বুঝতে পারি এটা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়।

“নাজিম উদ্দিনের নেতৃত্বে আমাকে একটি কক্ষে নিয়ে অকথ্য ভাষায় গালাগালিসহ বিবস্ত্র করে বেধড়ক মারধর করে এবং বলে তোর ভিডিও করে রাখছি।’ তিনি বলেন, ‘আটকের বিষয়ে বারবার আমার অপরাধের বিষয় জানতে চাইলে নিজাম উদ্দিন বলেন, তুই আমাদের অনেক জ্বালাচ্ছিস। তোকে সাংবাদিকতা শেখাবো। এরপর চোখ বাঁধা অবস্থায় চারটি কাগজে স্বাক্ষর নিয়ে রাতেই আমাকে কারাগারে পাঠিয়ে দেয়।

“আমাকে কেন কারাগারে পাঠানো হলো এবং কেন ধরে আনা হলো কিছুই বলা হয়নি। আমাকে যে নির্যাতন করা হয়েছে তার আঘাতের চিহ্ন আমার শরীরে আছে।”

আরিফের বিষয়ে জানতে চাইলে ‘আরিফ বর্তমানে ভালো আছেন’ উল্লেখ করে কুড়িগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. রেদওয়ান ফেরদৌস সজিব বলেন, “তার শারীরিক বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। এসব রিপোর্ট হাতে এলে প্রকৃত অবস্থা জানা যাবে।”

এসব অভিযোগের বিষয়ে কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসনের বক্তব্য জানা সম্ভব না হলেও রোববার এক সংবাদ সম্মেলনে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন জানিয়েছেন, স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে ওই ঘটনার তদন্ত করে ডিসির বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা পাওয়ায় তার বিরুদ্ধে এই ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

সচিবালয়ের এ ব্রিফিংয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, “তাকে প্রত্যাহার করা হবে। এরপর তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হবে। কর্ম অনুযায়ী তার শাস্তি হবে।”

তিনি বলেন, “তদন্তে অনেকগুলো অনিয়ম দেখেছি। বিভাগীয় প্রক্রিয়া অনুযায়ী ব্যবস্থা নেব। অহেতুক যে সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে... সত্যতা পেয়েছি বিধায় বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

বিসিএস ২০তম ব্যাচের কর্মকর্তা সুলতানা ২০১৮ সালের ৩ মার্চ থেকে কুড়িগ্রাম জেলার ডিসির দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। কুড়িগ্রাম শহরের একটি সরকারি পুকুর সংস্কারের পর তিনি নিজের নামানুসারে ওই পুকুরের নাম ‘সুলতানা সরোবর’ রাখতে চেয়েছিলেন উল্লেখ করে বাংলা ট্রিবিউনে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় দশ মাস আগে।