তালাকের ফতোয়ায় দুই বছর একঘরে

মৌখিক তালাক দিয়ে ফের সংসার করায় লালমনিরহাটে একটি পরিবারকে দুই বছর ধরে একঘরে করে রেখেছে সমাজপতিরা। পরিবারটির সদস্যদের মসজিদে নামাজ পড়তে কিংবা স্থানীয় বাজারে কেনাকাটা করতেও দেওয়া হচ্ছে না। তারা কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানও করতে পারছে না।  

লালমনিরহাট প্রতিনিধিআনিছুর রহমান লাডলা, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 March 2020, 01:57 PM
Updated : 9 March 2020, 02:05 PM

এই ঘটনার শিকার পরিবারটির বাস কালীগঞ্জ উপজেলার দলগ্রাম ইউনিয়নের শ্রীখাতা বালাপাড়া গ্রামে। মানবিক বিপর্যয়ের শিকার এই পরিবারের সদস্যদের অনেকটা অবরুদ্ধ জীবনযাপন করতে হচ্ছে।  

এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তি ও পুলিশে অভিযোগ দিয়েও কোনো সুরাহা হয়নি; কেউ কেউ সহমর্মিতা প্রকাশ করলেও এ সমস্যা সমাধঅনে কোনো উদ্যোগ নেয়নি।

সোমবার সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, শ্রীখাতা বালাপাড়া গ্রামের  জহুরুল ইসলামের (৬৫) প্রথম স্ত্রী মারা গেলে ২০০৩ সালে তিনি পার্শ্ববর্তী মদাতী ইউনিয়নের মনজিলা বেগমকে (৩৫) বিয়ে করেন। স্বামী সন্তান নিয়ে তাদের দিন ভালোই কাটছিল। বছর দুয়েক আগে পারিবারিক ঝগড়ার এক পর্যায়ে জহুরুল মৌখিকভাবে তালাক দেন স্ত্রী মনজিলাকে। এতে মনজিলা রাগ করে তার ভাইয়ের বাড়িতে চলে যান। সেখানে তিনি এক মাস অবস্থান করেন; তবে পরে আপোষ মীমাংসা হলে বাড়ি ফিরে আসেন।

কিন্তু এতে বাধ সাধেন স্থানীয় মসজিদ কমিটির সভাপতিসহ গ্রামের কয়েকজন।

এই সমাজপতিদের ভাষ্য, তালাক কার্যকর হয়ে গেছে। নতুন করে সংসার করা যাবে না। কিন্তু তারা তা অমান্য করে সংসার অব্যাহত রাখায় বালাপাড়া জামে মসজিদ কমিটির সভাপতি ও সাবেক ইউপি সদস্য নুর আমিনসহ কয়েকজন ওই পরিবারকে একঘরে করার ঘোষণা দেন। এই স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ককে অবৈধ ঘোষণা করে জহুরুলকে মসজিদে নামাজ পড়া বন্ধ করে দেন। অন্যের জমির উপর চলাচল করতে বাধা দিচ্ছে। গ্রামের দোকান থেকে কেনাকাটা করতে দেওয়া হচ্ছে না।

ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা বলেন, পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে সম্প্রতি জহুরুল তার নাতরি মুখে ভাত অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। এলাকার অনেককেই দাওয়াত দেন তারা। গরু ও ছাগল জবাই দেওয়ার জন্য স্থানীয় মসজিদের ইমাম আইয়ুব আলীকে ডাকা হলে তিনি আসেননি। পরে কালীগঞ্জ উপজেলা সদর থেকে মওলানা ডেকে এনে পশু জবাইসহ অন্যান্য ধর্মীয় কাজ করানো হয়। কিন্তু গ্রামের লোকজন তাদের দাওয়াতে আসেনি।

এক ঘরে করার বিষয়ে গ্রামের মফিজুল ইসলাম, নুর আমিন, শাহজাহান আলী, আইয়ুব আলী ও মনির মিয়ার বিরুদ্ধে কালীগঞ্জ থানায় অভিযোগ দায়ের করেছেন মনজিলা।

প্রতিবেশী রেবা, রহিমা, দুলালী ও এরশাদসহ অনেকেই বলেন, ঠেক (একঘরে) করার বিষয়ে লিখিত সম্মতিপত্রে গ্রামের একশজন বাসিন্দা স্বাক্ষর করেছেন। সম্মতিপত্রে যারা স্বাক্ষর করেননি তারা গোপনে তাদের সঙ্গে মেলামেশা করছেন।

তাদের ভাষ্য, এটা আইনের বিষয় নয়, শরিয়ত অনুযায়ী তালাক হয়েছে। তাই তাদের ‘ঠেক’ করা হয়েছে।

এ ব্যাপারে মনজিলা বলেন, “বাহে, হামার স্বামী রাগ করি তালাক দিছে। এলাকার লোকজন এটাকে তালাক মনে করে হামাক ঠেক (একঘরে) করেছে। হামার বাড়িত কাও (কেউ) আসে না। হামাকো অন্যের বাড়িতে যাবার দেয় না। এলাকার দোকান থেকে খরচও বন্ধ করে দিছে দেওয়ানিরঘর (সমাজপতিরা)।

“থানায় অভিযোগ দিলে ওসি সাহেব বলেছেন তার করার কিছু নেই।”

মনজিলা বলেন, “বাহে, দুনিয়াত কি ভালো মানুষ নাই? এমন লজ্জা নিয়া কি বাঁচা যায়?”

মনজিলার স্বামী জহুরুল ইসলাম বলেন, “বাহে, হামার মতো গরিব মানুষের সমাজে একা থাকা অনেক কষ্টকর। হামার স্বামী- স্ত্রীর মধ্যে কোনো সমস্যা নেই। রাগের মাথায় তালাক দিয়েছিলাম। পরে ভুল বুঝতে পেরে ওকে ঘরে উঠিয়েছি। অথচ সমাজপতিরা ধর্মের কথা বলে আমার সাথে অধর্মের কাজ করছেন। মসজিদে নামাজ পড়তে দেয় না ওরা। আল্লাহর ঘর হামার জন্য বন্ধ করে দিয়েছে সমাজপতিরা।”

মসজিদের ইমাম আইয়ুব আলী ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, “ভয়ে অনুষ্ঠানের গরু -ছাগল জবাই করতে যাইনি।”  

নামাজ পড়তে না দেওয়ার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “ইমামের বেতন হয় মসজিদ কমিটির অনুদানে। তাই অনেক কিছু বলা যায় না।”

কালীগঞ্জ উপজেলার করিমপুর নেছারিয়া দাখিল মাদ্রাসার সুপারিনটেনডেন্ট আবু জাফর বলেন, “সালিশ বৈঠকে সবার উপস্থিতিতে বলেছিলাম, শরিয়ত অনুযায়ী এটা তালাক হয়নি। এলাকার লোকজনের কোরআন হাদিস সম্পর্কে ভালো ধারণা না থাকায় ওই পরিবারকে তারা একঘরে করে রেখেছেন।”

মসজিদ কমিটির সভাপতি ও সাবেক ইউপি সদস্য নুর আমিন বলেন, “আমি এককভাবে একঘরে করেনি। সমাজের দশজন সিদ্ধান্ত নিয়ে তাদের একঘরে করেছেন।”

মসজিদে নামাজ পড়তে না দেওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “মসজিদ সবারই। জহুরুল নামাজ পড়তে পারে, তবে জামাতে নয়, দশজনের সঙ্গে নয়। তাকে আলাদা নামাজ পড়তে হবে। এটা সবার সিদ্ধান্ত। তাকে গ্রামবাসীর সামনে ভুল স্বীকার করতে হবে।”

মুসলিম পারিবারিক আইনে তালাক দিতে হলে লিখিত নোটিশ পাঠাতে হয় স্বামী বা স্ত্রীকে। একই নোটিশ স্বামী বা স্ত্রীর এলাকার ইউপি চেয়ারম্যান কিংবা ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কাছেও পাঠতে হবে। এরপর ইউপি চেয়ারম্যান কিংবা ওয়ার্ড কাউন্সিলর তাদের দুপক্ষকে ডেকে মীমাংসার উদ্যোগ নেবেন। তিনি কোনো উদ্যোগ না নিলে কিংবা দুপক্ষ অথবা যেকোনো একপক্ষ তার ডাকে সাড়া না দিলে তালাকের নোটিশ পাঠানোর ৯০ দিনের মধ্যে কার্যকর হয়ে যাবে।  

দলগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান খ ম শফিকুল ইসলাম বলেন, “মনজিলা ও তার স্বামীকে একঘরে করে রাখাটা চরম ঘৃণ্য ও অমানবিক কাজ।”

লালমনিরহাট জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য সফুরা বেগম রুমি বলেন, একঘরে করে রাখার ঘটনাটি সংবিধান ও প্রচলিত আইনকে চ্যালেঞ্জের শামিল। এর সুষ্ঠু বিচার হওয়া উচিত।

লালমনিরহাট পুলিশ সুপার আবিদা সুলতানা বলেন, বিষয়টি সমাধানের জন্য সংশ্লিষ্ট থানার ওসিকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।