পাহাড়ে ১১টি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভাষার বর্ণমালা রয়েছে। এসব ভাষা গোষ্ঠীর কেউ কেউ শুধু তাদের ভাষায় নামটুকুই শুধু লিখতে পারেন বলে জানাচ্ছেন। তবে শিখেও চর্চার অভাবে মাতৃভাষায় পড়া ও লেখায় ভুলে গেছেন বলে অনেকেই স্বীকার করেছেন।
আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা দিবসে ভাষা শহীদদের স্মরণে বান্দরবানে শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে এসে এমন এসব কথা জানিয়েছেন আদিবাসী লোকজন।
ভোর হওয়ার সাথে সাথে শহীদদের স্মরণে ফুল দিতে আসে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের কর্মীরা। প্রভাতফেরী করে শ্রদ্ধা জানায় আদিবাসীদের সামাজিক ও সংস্কৃতিক সংগঠনগুলোও।
আদিবাসীদের ভাষা পরিস্থিতির উন্নয়নে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের মারমা ভাষার লেখক ও প্রশিক্ষক ক্যশৈপ্রু খোকা চারটি বিষয়কে গুরুত্ব দিচ্ছেন।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সরকারিভাবে শুরু হওয়া পাঁচটি মাতৃভাষায় শিক্ষাকে আরও ত্বরান্তি করা, দ্বিতীয় ধাপে বয়স্ক শিক্ষাকেন্দ্র চালু করা, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মাতৃভাষা চর্চা হিসেবে গান, ছড়া, কবিতা ও গল্প লেখার আয়োজন করা এবং কারবারী, হেডম্যান ও সাকের্ল প্রধানদের মাধ্যমে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগকে সহযোগিতা করা।
এই পদ্ধতি গ্রহণ করে সংখ্যায় কম জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে বর্ণমালা ও ভাষা শিক্ষার ব্যবস্থা আরও সহজ আওতায় চলে আসবে বলে মনে করছেন তিনি।
শহরে ক্যচিংঘাটা এলাকা থেকে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে আসে বীর বাহাদুর স্কুল এন্ড কলেজের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা।
তাদের শিক্ষক মিথোয়াং রাখাইন জানান নিজের নামটাই শুধু তিনি লিখতে পারেন। এছাড়া রাখাইন ভাষায় আর কিছু পারেন না।
“রাখাইনদের অনেকেই নিজের মাতৃভাষায় লিখতে ও পড়তে জানেন। ভাষা চর্চাও হয়ে থাকেন।’
সেই স্কুলের আরেক শিক্ষক সাচিং উ মারমা জানান, তিনিও নিজের নাম লিখতে পারেন মাত্র। তবে পড়তে জানেন না।
তারা মনে করেন ভাষার চর্চা না থাকলে ছোটছোট জনগোষ্ঠীর ভাষা আরও বিপন্ন হবে।
মাতৃভাষা চর্চা প্রসঙ্গে সংস্কৃতিকর্মী সিয়ং খুমি বলেন, তাদের জনগোষ্ঠীর বয়োজ্যেষ্ঠরা বেশির ভাগ লিখতে ও পড়তে পারলেও নতুন প্রজন্মরা সেভাবে পারেন না। তবে খুমিরা পাহাড়ে খুব কম ভাষার জনগোষ্ঠী বলে জানান তিনি।
সিয়ং খুমি জানান, এখনও সরকারিভাবে খুমির জনসংখ্যা এক হাজার ৭২৯ জন মাত্র। বান্দরবানে রুমা, থনাচি ও রোয়াংছড়িতে এদের বসবাস।
তবে তাদের সামাজিক সংগঠন খুমি সোস্যাল কাউন্সিলের মতে, বর্তমানে তাদের জনসংখ্যা সাড়ে তিন হাজারের মত রয়েছে।
ছোটবেলায় বর্ণমালা চর্চা করার সুযোগ পাননি উল্লেখ করে খেয়াং ভাষা কমিটির সদস্য অংজাই খেয়াং জানান, পড়তে পারা দূরে থাক, নিজের নামটাও লিখতে জানেন না তিনি।
“বর্তমানে কাজের চাপ ও বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার কারনে শেখা আর হয়ে ওঠে না।”
ফুল দিতে তিনি সঙ্গে নিয়ে এসেছেন তার মেয়ে ও ছেলেকে।
ভাষা কমিটির সদস্য হয়েও শেখার কেন সুযোগ করে নেওয়া হয়নি এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, খেয়াং বর্ণমালা খুব বেশি দিন আগে তৈরি হয়নি। পাঠদানের ব্যবস্থাও করা যায়নি। নিজে না জানলেও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা ভেবে বর্ণমালা ও ভাষা শিক্ষার কার্যক্রম উদ্যোগ নেওয়া হবে।
বর্ণমালা শেখার প্রশিক্ষণ নেওয়া চাক সম্প্রদায়ে কাইংকো কালচারার ইন্সটিটিউট-এর পরিচালাক অংজাই উই চাক বলেন, লিখতে পারি। কিছুটা পড়তেও পারি। কিন্তু ভাষা চর্চা খুব একটা নেই।
“চাক বর্ণমালা উদ্ভাবনের পর বর্ণমালা ও ভাষা শেখার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। এখন বই ছাপানোর আর্থিক সংকট ও ব্যবস্থাপনার অভাবে এ কার্যক্রম থেমে আছে। নতুন প্রজন্মরা বর্ণমালা শেখার অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।”
বান্দরবান সরকারি কলেজের হিসাব বিজ্ঞান বিভাগে মাস্টার্সের ছাত্র থোয়াইক্যজাই চাক বলেন, “আগে লিখতে ও পড়তাম জানতাম। চর্চার অভাবে ভুলে গেছি।”
ত্রিপুরা কল্যাণ সংসদের সাধারণ সম্পাদক সুকান্ত ত্রিপুরা জানিয়েছেন, রোমান হরফে ত্রিপুরাদের ককবরক ভাষা রয়েছে। এখন নিজেদের হরফ দিয়ে বর্ণমালা লেখার কাজ চলছে।
ত্রিপুরাদেরও ব্যক্তিবিশেষে লিখতে, পড়তে জানলেও বেশির ভাগ লোকজন মাতৃভাষা লিখতে-পড়তে সেভাবে পরেন না বলে জানান তিনি।