পাহাড়ে মাতৃভাষা শিক্ষা: ৪ বছর পরও ‘শিক্ষক নাই’

প্রাথমিকে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর শিশুদের মাতৃভাষা শিক্ষা শুরুর চার বছর পরও শিক্ষকের অভাবে এখনও তা অকার্যকর বলছেন সংশ্লিষ্টরা।

খাগড়াছড়ি প্রতিনিধিআবু দাউদ, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 Feb 2020, 05:27 PM
Updated : 21 Feb 2020, 09:57 AM

দীর্ঘদিনের দাবির প্রেক্ষিতে ২০১৭ সালে আওয়ামী লীগ সরকার দেশে প্রথমবারের মত পাহাড়ি শিশুদের হাতে তুলে দেয় তাদের মাতৃভাষার বই। সে বছর পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা এবং সমতল অঞ্চলের সাদ্রি ও গারো ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর শিশুদের জন্য মাতৃভাষার পাঠ্যপুস্তক বিতরণ করা হয়।

প্রথম বছর শুধু প্রাক-প্রাথমিকের এসব বই ছাপায় জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তব বোর্ড (এনসিটিবি)। পর্যায়ক্রমে পরের বছর প্রথম শ্রেণির, ২০১৯ সালে দ্বিতীয় শ্রেণির এবং এবার ২০২০ সালের তৃতীয় শ্রেণির মাতৃভাষা বইও ছাপিয়েছে।

বছরের প্রথম দিন পাহাড়ি শিশুরা তাদের মায়ের ভাষায় বই পেয়ে খুশি, আনন্দিত তাদের অভিভাবকরাও বলছেন তাই। আর বাংলা, ইংরেজির পাশপাশি বিদ্যালয়ে মায়ের ভাষায় পড়ার সুযোগ তৈরি হওয়ায় পাহাড়ের শিশুরা জড়তা কাটিয়ে বিদ্যালয়মুখী হবে বলে আশাবাদী স্থানীয় ভাষা গবেষকরা।

মারমা ভাষা কমিটির সদস্য ডা. অংক্যজাই মারমা জাননা, প্রাক-প্রাথমিকে শতভাগই মাতৃভাষায় পাঠ্যপুস্তক রচিত হয়েছে। প্রথম শ্রেণিতে ৭৫ শতাংশ মাতৃভাষা আর ২৫ শতাংশ বাংলা, দ্বিতীয় শ্রেণিতে ৫০ শতাংশ মাতৃভাষা আর ৫০ শতাংশ বাংলা এবং তৃতীয় শ্রেণিতে ২৫ শতাংশ মাতৃভাষা আর ৭৫ শতাংশ বাংলায় পাঠ্যপুস্তক রচনার আপাতত সিদ্ধান্ত নিয়েছে এসসিটিবি।

এছাড়াও দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্যায়ে ম্রো, বিঞ্চুপ্রিয়া মণিপুরী ও মৈতৈ মণিপুরী, তঞ্চঙ্গা, খাসিসহ দেশের অপর সব ভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা চালুর পরিকল্পনা রয়েছে বলেন তিনি।

তবে শুরুর পর চার বছরেও জেলার বিদ্যালয়গুলোয় পুরোদমে মাতৃভাষার এ পাঠ্যক্রম চালু করতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। এসব ভাষার পাঠ্যবই হাতে কলমে শিক্ষা দেওয়ার মত প্রশিক্ষিত শিক্ষক না থাকায় সরকারের এ উদ্যোগ থমকে পড়ার উপক্রম হয়েছে বলছেন ওসব স্কুলের শিক্ষকরা।

স্থানীয় শিক্ষকরা বলছেন, মাতৃভাষায় প্রশিক্ষিত শিক্ষক না থাকায় তারা শিশুদের মাতৃভাষার পাঠ্যপুস্তক পড়াতে পারছেন না। অনেক বিদ্যালয়ে সেই বইগুলো এতদিনেও বস্তাবন্দি পড়ে রয়েছে বলে জানাচ্ছেন তারা।

খাগড়াছড়ির কমলছড়িমূখ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সিরাজুল ইসলাম বলেন, “আমার স্কুল শতভাগ চাকমা অধ্যুষিত। শিক্ষার্থীদের চাকমা ভাষায় পাঠদান করাতে পারলে ভালো হত। ঝরেপড়ার হার কমত। ক্লাস হতে পারত আনন্দময় কিন্তু শিক্ষকরা ওই ভাষায় পাঠদান করাতে না পারায় সমস্যায় পড়েছি।

মাতৃভাষার বইগুলো ফেলে রাখা ছাড়া উপায় কী পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে তিনি বলেন, তবে জেলা পরিষদ থেকে প্রশিক্ষণ শুরু হয়েছে। সব শিক্ষকের প্রশিক্ষণ শেষ হলে সঙ্কটের সমাধান হতে পারে।

মহালছড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মৌসুমী ত্রিপুরা জানান, মাতৃভাষার বই হাতে পেয়ে শিশুরা খুবই খুশি। কিন্তু নিজের ভাষার বর্ণমালার সাথে পরিচিতি না থাকায় শিক্ষকরাই সেসব বই পড়াতে পারছেন না।

একই কথা বললেন শিক্ষিকা দিপা ত্রিপুরা।

এদিকে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের উদ্যোগে গত তিন বছর ধরে স্বল্পমেয়াদী ভাষাভিত্তিক প্রশিক্ষণ চললেও তা পর্যাপ্ত নয় দাবি তাদের।

তবে এসব মাতৃভাষার পাঠ্যপুস্তক রচনাকে যুগান্তকরী উদ্যোগ উল্লেখ করে খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কংজরী চৌধুরী বলেন, “একটি নতুন প্রক্রিয়া হিসেবে কিছু সীমাবদ্ধতা থাকলেও দিনে দিনে তা আমরা কাটিয়ে উঠতে পারব।”

শিক্ষক প্রশিক্ষণের চলমান কার্যক্রমকে আরো জোরালো ও কার্যকরভাবে বাস্তবায়নের আশার বাণী শুনিয়ে তিনি বলেন, ভবিষ্যতে ভাষাভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগে জোর দেওয়া হলে সমস্যা অনেকটাই কাটিয়ে উঠতে পারব।

ত্রিপুরা ভাষা কমিটির সদস্য ও মাতৃভাষায় শিক্ষা কার্যক্রম চালুর অন্যতম উদ্যোক্তা সংগঠক মথুরা বিকাশ ত্রিপুরা।

মাতৃভাষার এ শিক্ষাক্রম চালুর উদ্যোগকে সাধুবাদ জানালেও বিদ্যালয়ে এসব বই পড়ানোর জন্য আরও অনেক কাজ বাকী রয়েছে মনে করেন মথুরা বিকাশ।

তিনি বলেন, তিন পার্বত্য জেলাতে বিদ্যমান তিনটি শিক্ষক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে (পিটিআই) মাতৃভাষায় শিক্ষার ওপর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা জরুরি হয়ে পড়েছে।

পিটিআই-এর কারিকুলামে মাতৃভাষার শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করার ওপরও গুরুত্ব আরোপ করেন তিনি।

এবার খাগড়াছড়ি জেলায় প্রাক-প্রাথমিক স্তরে ১১ হাজার ৬৪৩ জন, প্রথম শ্রেণিতে ১০ হাজার ৪৫৫ জন, দ্বিতীয় শ্রেণিতে ৯ হাজার ২৯২ জন, ৯ হাজার ১৬৫জন চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা শিশু মাতৃভাষার বই পেয়েছে জানাচ্ছে জেলা শিক্ষা অফিস।

মাতৃভাষার বইয়ের সাথে শিশুদের মাঝে মাতৃভাষার বর্ণমালা ভিত্তিক অনুশীলন খাতাও বিতরণ করা হয়েছে।

জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ফাতেমা মেহের ইয়াসমিন জানিয়েছেন, খাগড়াছড়ি পিটিআই-এর মাধ্যমে প্রত্যেক শিক্ষককে মাতৃভাষার প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।

“এরই মধ্যে ৯০ জন শিক্ষককে মাতৃভাষার পাঠ্যসূচি অনুযায়ী প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।”