শনিবার দুপুর দেড়টার দিকে মুন্সীগঞ্জ সদরে ধলেশ্বরী নদী থেকে পুলিশ লাশটি উদ্ধার করে।
এর আগে শুক্রবার একই জেলার ধলেশ্বরী নদী থেকে প্রকৌশলী মাহফুজুর রহমান জিসানের লাশ উদ্ধার করা হয় নিখোঁজের পাঁচদিন পর।
এদিকে, এই দুই প্রকৌশলীর নিখোঁজ ও লাশ উদ্ধার ঘটনার স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে তদন্তে নেমেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।
গত ৫ জানুয়ারি রাতে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার রাজাপুর এলাকায় বুড়িগঙ্গা এন্টারপ্রাইজের ভেকু মেরামতের কাজ শেষ করে ফেরার পথে নিখোঁজ হন বাংলা ক্যাট কোম্পানির দুই যন্ত্র প্রকৌশলী মাহফুজুর রহমান জিসান ও লিখন সরকার।
মুন্সীগঞ্জ সদর থানার ওসি মো. আনিচুর রহমান জানান, দুপুরে ক্রাউন সিমেন্ট কারখানার কাছাকাছি ধলেশ্বরী নদীতে লিখন সরকারের লাশ ভেসে উঠলে স্থানীয়রা পুলিশকে জানায়। পরে মুন্সীগঞ্জ সদর থানা পুলিশ ও নৌ-থানা পুলিশ যৌথভাবে লাশটি উদ্ধার করে থানায় নিয়ে যায়।
খবর পেয়ে নিহত লিখন সরকারের স্বজনরা গিয়ে লাশ শনাক্ত করেন বলে তিনি জানান।
ওসি আনিচুর বলেন, সুরতহালে নিহতের শরীরে আঘাতের তেমন কোনো চিহ্ন পাওয়া যায়নি। তবে দীর্ঘ ছয়দিন নদীতে থাকার কারণে লাশে পচন ধরেছে। স্বজনদের দাবির প্রেক্ষিতে লাশ ময়নাতদন্তের জন্য মুন্সীগঞ্জ সদর হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর নিশ্চিত হওয়া যাবে এটি হত্যাকাণ্ড নাকি দূর্ঘটনা।
ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হলে লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হবে বলে আনিচুর জানান।
শুক্রবার বেলা ১১টার দিকে নিখোঁজের পাঁচদিন পর লিখন সরকারের সহকর্মী বাংলা ক্যাট কোম্পানির প্রকৌশলী মাহফুজুর রহমান জিসানের পেট কাটা লাশ উদ্ধার করে ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দল।
পরে মুন্সীগঞ্জ সদর হাসপাতালে ময়নাতদন্ত শেষে জিসানের লাশ শনিবার বিকালে স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করে।
স্বজনরা জানান, লাশ গ্রামের বাড়ি রাজশাহীর বোয়ালিয়া থানার সুলতানাবাদ এলাকায় নিয়ে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হবে।
এদিকে জিসানের স্বজনদের কাছ থেকে জানা গেছে, নারায়ণগঞ্জ পুলিশ ব্যুরো ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) এর পরিদর্শক নাসির উদ্দিনের নেতৃত্বে একটি দল শনিবার মুন্সীগঞ্জে গিয়ে লাশের সুরতহাল তৈরিসহ পরিবারের লোকজনের সঙ্গে কথা বলেছেন।
পাশাপাশি বাংলা ক্যাট কোম্পানির প্রশাসনিক কর্মকর্তা (হড অব সিকিউরিটি এন্ড সেফটি) আশিক মাহমুদ এবং বুড়িগঙ্গা এন্টাপ্রাইজের স্বত্ত্বাধিকারি সজীব ও তার কর্মচারী পায়েলের সঙ্গে কথা বলেছেন বলেও তিনি জানান।
তদন্তের বিষয়টি স্বীকার করে নারায়ণগঞ্জ পুলিশ ব্যুরো ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) পরিদর্শক নাসির উদ্দিন বলেন, “বিভিন্ন গণমাধ্যমে জানতে পেরে আমরা থানা পুলিশের পাশাপাশি স্বপ্রণোদিত হয়েই তদন্ত শুরু করেছি। যেহেতু বিষয়টি স্পর্শকাতর, দুইজন প্রকৌশলী পাঁচ ছয় দিন নিখোঁজ থাকার পর লাশ উদ্ধার হয়েছে, তাই অমি নিজেই ঘটনাস্থলে গিয়ে লাশ দেখেছি। পারিপার্শ্বিক অবস্থা থতিয়ে দেখেছি।”
পিবিআই এর এই কর্মকর্তা আরও বলেন, “মুন্সীগঞ্জে গিয়ে অমি নিহতদের স্বজনদের সাথে কথা বলেছি। তাদের অভিযোগগুলো গুরুত্ব সহকারে নিয়ে আমরা সব বিষয় পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে খতিয়ে দেখছি। কোনো আলামত যেন নষ্ট না হয়ে যায় সেই বিষয়টিও আমরা গুরুত্ব দিয়ে দেখছি।”
এছাড়া যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ বুড়িগঙ্গা এন্টাপ্রাইজের মালিক সজীব, তার কর্মচারী পায়েল এবং বাংলা ক্যাটের প্রশাসনিক কর্মকর্তা আশিক মাহমুদের সঙ্গেও তিনি কথা বলেছেন বলে জানান।
ভিকটিমের পরিবার মামলা করলে এবং পিবিআইকে তদন্তভার দেওয়া হলে তারা সরাসরি তদন্ত করবেন বলে জানান পরিদর্শক নাসির।
লাশ বুঝে নেওয়ার পর জিসানের বড় ভাই মো. শোয়েব আহমেদ বলেন, জিসানের লাশ অক্ষত অবস্থায় পাওয়া যায়নি। মরদেহের মুখমণ্ডলে কয়েকটি আঘাতের চিহ্ন এবং পেট কাটা ছিল। মুখ ও পেট দিয়ে রক্তক্ষরণের আলামত দেখা গেছে।
তাই এটি হত্যাকাণ্ড বলে দাবি করে জিসানের বড় ভাই শোয়েব আহমেদ প্রশাসনের কাছে ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত চেয়েছেন।
শোয়েব আহমেদ আরও বলেন, “আমরা আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের প্রস্তুতি নিচ্ছি। প্রয়োজনে আমরা মামলা করব। যারা আমার বাইকে হত্যা করেছে তাদের দ্রুত গ্রেপ্তার চাই।”
জিসানের মামা শওকত শওকত আল হোসাইনের দাবি, নদীতে ডুবে তার ভাগিনার মৃত্যু হয়নি। জিসানকে হত্যা করা হয়েছে। যেহেতু তার শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাতের ক্ষত চিহ্ন পাওয়া গেছে, তাই এটি স্পষ্টভাবে হত্যাকাণ্ড বলে মনে হচ্ছে।
“আমার ভাগিনার লাশ আমরা অক্ষত পাইনি। জিসানের মুখ দিয়ে রক্ত বের হয়েছে, পেট কাটা রয়েছে এবং সেখান দিয়ে রক্তক্ষরণ হয়েছে। আমার ভাগিনাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। আমরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার দাবি করছি।”
গত ৫ জানুয়ারি রাতে এই দুই প্রকৌশলী নিখোঁজ হওয়ার পর জিসানের স্ত্রী রাকিয়া সুলতানা রাজধানীর আশুলিয়া থানায় বাদী হয়ে একটি সাধারণ ডায়েরি করেছেন।
জিসানের পরিবার শুরু থেকেই দাবি করে আসছেন, এ ঘটনার সাথে ফতুল্লার রাজাপুর এলাকার বুড়িগঙ্গা এন্টারপ্রাইজের স্বত্ত্বাধিকারী সজীব ও তার কর্মচারী পায়েল জড়িত আছেন।
ফতুল্লা মডেল থানার ওসি মো. আসলাম হোসেন বলেন, “জিসানের মরদেহের মুখমণ্ডলে হালকা ক্ষত চিহ্ন পাওয়া গেছে। নদীর তলদেশে দীর্ঘসময় থাকার কারণে রক্তক্ষরণ হতে পারে। পরিবারের দাবির বিষয়টি আমরা খতিয়ে দেখছি। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর নিশ্চিত করে বলা যাবে হত্যাকাণ্ড কিনা। তারপরেও আমরা সবদিক থেকে তদন্ত করে যাচ্ছি।”
মাহফুজুর রহমান জিসান ও লিখন সরকার দুজনই পরিবার নিয়ে রাজধানীর আশুলিয়া থানার ভেন্ডাবর এলাকায় একই মালিকের বাড়িতে ভাড়া বাসায় দীর্ঘদিন যাবত বসবাস করে আসছেন। জিসানের তিন বছরের ও তিন মাসের দুইটি ছেলে রয়েছে।