পাটকল শ্রমিকদের দ্বিতীয় দফার অনশন দ্বিতীয় দিনে

পাটখাতে প্রয়োজনীয় অর্থবরাদ্দ, রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলে বকেয়া মজুরি পরিশোধসহ ১১ দফা দাবিতে খুলনায় শ্রমিকদের দ্বিতীয় দফার ‘আমরণ অনশন’ দ্বিতীয় দিনেও অব্যাহত রয়েছে।

খুলনা প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 Dec 2019, 07:25 AM
Updated : 30 Dec 2019, 07:25 AM

সোমবার খুলনার খালিশপুরের দৌলতপুর জুটমিল ও দিঘলিয়ার স্টার জুটমিলের শ্রমিকরা বিআইডিসি রোডের প্লাটিনাম গেইটের পুবপাশে এবং প্লাটিনাম জুট মিলের শ্রমিকরা মিলের পশ্চিম ফটকে সামিয়ানা টাঙিয়ে অনশন করতে দেখা যায়।

এছাড়া ক্রিসেন্ট জুটমিল গেইট, খালিশপুর জুটমিল গেইট, আটরা শিল্পাঞ্চলের আলিম ও ইস্টার্ন জুটমিলের শ্রমিকরাও তাদের মিলগেইটে এ কর্মসূচি পালন করেছেন। পাটকলের উৎপাদন বন্ধ রেখে খালিশপুর বিআইডিসি রোড, আটরা ও রাজঘাট এলাকার খুলনা-যশোর মহাসড়কে শ্রমিকরা অবস্থান নিয়েছেন বলে খবর রয়েছে।

গত রোববার দুপুরে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল সিবিএ-ননসিবিএ সংগ্রাম পরিষদের ব্যানারে দ্বিতীয় দফায় স্ব স্ব মিলগেইটের সামনের সড়কে অনশন কর্মসূচি শুরু করেন তারা। খুলনা ছাড়াও রাজশাহী ও নরসিংদীতে শ্রমিকরা এ অনশন করছে বলে জানিয়েছেন শ্রমিক নেতারা। প্রথম দফার অনশনে দেশের ২৬টি রাষ্ট্রায়াত্ত পাটকলের মধ্যে ১২টির শ্রমিকরা যোগ দেয়।

সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, খালিশপুর, ক্রিসেন্ট, প্লাটিনাম, স্টার ও দৌলতপুর জুটমিলসহ কয়েকটি মিলের প্রধান গেইটের সামনের বিআইডিসি সড়কে প্রথম দফা আমরণ অনশনের প্যান্ডেলেই আবার দ্বিতীয় দফায় কর্মসূচি শুরু করেছেন শ্রমিকরা।

আলীম জুট মিলের সিবিএ সভাপতি মো. সাইফুল ইসলাম লিটু বলেন, রোববার দুপুর থেকে অনশনে বসেছি। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত কর্মসূচি চালিয়ে যাব। প্রয়োজনে মৃত্যু হলেও অনশন ভাঙব না।

“শ্রমিকরা মজুরি না পাওয়ায় মানবেতর জীবন যাপন করছেন। তারা তাদের সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ, ঘরভাড়া দিতে পারছেন না। এ অবস্থায় বাধ্য হয়েই আন্দোলনে নেমেছেন।

“সব সেক্টরে মজুরি কমিশন বাস্তবায়ন হলেও পাটকল শ্রমিকদের অনীহা করা হচ্ছে। মজুরি কমিশন বাস্তবায়ন, পাটখাতে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ ও পিপিপি বাতিলসহ ১১ দফা দাবিতে আমরা আন্দোলনে নেমেছি।”

রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল সিবিএ-নন সিবিএ সংগ্রাম পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক ও ক্রিসেন্ট জুট মিলের সাবেক সিবিএ সভাপতি মুরাদ হোসেন বলেন, দাবি মেনে নেওয়ার জন্য লম্বা সময় চেয়েছে মন্ত্রণালয়।

“বারবার তারা সময় চাইছে, তাদের সময় দেওয়া হয়েছে। শ্রমিকরা আর সময় দিতে চায় না। দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ায় আমরা আন্দোলনে নেমেছি।”

প্লাটিনাম জুট মিলের সিবিএ সভাপতি শাহানা শারমিন বলেন, শ্রমিকরা দাবি না মানা পর্যন্ত ঘরে ফিরবে না। অনেক সময় দেওয়া হয়েছে, আর না। শ্রমিকরা এবার দাবি আদায়ের শপথ করেছে। যেকোনো মূল্য দাবি আদায় করেই তারা ঘরে ফিরবে।

“গত ১৩ ডিসেম্বর রাতে শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ানের আশ্বাসের প্রেক্ষিতে তিনদিনের জন্য আমরণ অনশন কর্মসূচি স্থগিত করেছিলেন শ্রমিকরা।

“ওই রাতে শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন শ্রম প্রতিমন্ত্রী। এ সময় তিনি ১৫ ডিসেম্বর শ্রমিকদের মজুরি কমিশন বাস্তবায়নে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা এবং বিকেলে বিজেএমসি সভাকক্ষে শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে সভার কথা জানান। ওই সভা থেকে ভালো ফলাফল আসতে পারে জানিয়ে প্রতিমন্ত্রী শ্রমিক নেতাদের অনশন তুলে নিয়ে ঘরে ফিরে যেতে বলেন।

“এ আশ্বাসের প্রেক্ষিতে প্রথম দফায় ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত অনশন স্থগিত করেছিলেন শ্রমিকরা। রাতে তারা বাড়ি ফিরলেও অনশনস্থলের প্যান্ডেল সেভাবেই রাখা হয়।

শাহানা শারমিন বলেন, ১৪ ডিসেম্বর থেকে খুলনা অঞ্চলের সকল পাটকলের শ্রমিকরা কাজে  যোগ দেন । কিন্তু ১৫ ডিসেম্বর ঢাকায় অনুষ্ঠিত বৈঠক ব্যর্থ হয়। পরে শ্রমিক নেতাদের কাছে ২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় চাওয়া হয়।

“ওইদিন শ্রম প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকেও ভালো কোনো ফল হয়নি। ওই বৈঠকে প্রতিমন্ত্রী ২৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় চান । কিন্তু ২৬ ডিসেম্বরের বৈঠকে মজুরি কমিশনের বিষয়ে কোনো সুরাহা না হওয়ায় ২৯ ডিসেম্বর থেকে আবারও আমরণ অনশন কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন শ্রমিক নেতারা।”

গত ২৩ নভেম্বর থেকে ১১ দফা দাবিতে আন্দোলনে নামে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল শ্রমিকরা। বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে ১০ ডিসেম্বর দুপুর প্রথম দফায় ‘আমরণ অনশনে’ বসে তারা। ওই কর্মসূচিতে খুলনা অঞ্চলের রাষ্ট্রায়ত্ত নয়টি পাটকলের মধ্যে আটটি ক্রিসেন্ট জুটমিল, খালিশপুর জুটমিল, দৌলতপুর জুটমিল, প্লাটিনাম জুটমিল, স্টার জুটমিল, আলিম জুটমিল, ইস্টার্ন জুটমিল ও জেজেআই এর শ্রমিকরা আন্দোলনে অংশ নেন। যশোরের কার্পেটিং জুটমিলের শ্রমিকরা এ কর্মসূচিতে যোগ দেননি।

২০০৮ সালে নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামী লীগ পাট খাতকে লাভজনক করার অঙ্গীকার করে। তারা ক্ষমতায় আসার পর বিজেএমসিকে লাভজনক করতে কর্মপরিকল্পনা করে। ২০০৯ সালে পাটকল বেসরকারীকরণ প্রক্রিয়া থেকে সরে আসে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার।

এরপরই বেসরকারি হাতে ছেড়ে দেওয়া বিভিন্ন পাটকল সরকারের হাতে নিয়ে নতুন করে চালানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়।

পাট মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনের (বিজেএমসি) আওতাধীন ২৬টি পাটকলের মধ্যে বর্তমানে চালু আছে ২৫টি। এর মধ্যে ২২টি পাটকল ও ৩টি নন-জুট। মিলস ফার্নিশিংস লিমিটেড নামের নন-জুট কারখানা ছাড়া বাকি ২৪ প্রতিষ্ঠান লোকসানে।

২০১৬-১৭ অর্থবছরে বিজেএমসির পাটকলগুলোর (জুট ও নন-জুট) লোকসানের পরিমাণ ছিল ৪৮১ কোটি টাকা।

অপরদিকে বেসরকারি খাতের পাটকলগুলো ভালো করছে, তাদের রপ্তানি আয়ও বেড়েছে। কিন্তু সরকারের হাতে থাকা ২২টি পাটকলের সবগুলোয় লোকসান হওয়ায় প্রতিবছরই সরকারি টাকা দিয়ে টিকিয়ে রাখা হচ্ছে বিজিএমসি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে।