নদী ও জলাশয় রক্ষায় দেশজুড়ে অবৈধদের উচ্ছেদ শুরু

নদ-নদী, খাল-ছড়াসহ প্রাকৃতিক জলাশয় উদ্ধারে সারা দেশে এক যোগে অবৈধ দখলদার উচ্ছেদে অভিযান শুরু হয়েছে।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 Dec 2019, 10:41 AM
Updated : 23 Dec 2019, 10:48 AM

সোমবার সকাল থেকে দেশের ৬৪টি জেলায় এ অভিযান শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছেন উচ্ছেদ অভিযান সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

সম্প্রতি পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় এক বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, সারাদেশের নদ-নদী, খাল ও প্রাকৃতিক জলাশয়ে প্রায় ৪০ হাজার অবৈধ স্থাপনা চিহ্নিত করেছেন তারা।

এ সব উচ্ছেদের ব্যাপারে গত ৫ নভেম্বর এ মন্ত্রণালয় থেকে জেলার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নির্দেশ পাঠানো হয়।

সেই প্রসঙ্গ টেনে গাজীপুর জেলার টঙ্গী রাজস্ব সার্কেলের সহকারী কমিশনার (ভূমি) এ কে এম গোলাম মোর্শেদ খান জানান,  ৬৪ জেলার নদ, নদী, খাল, ছড়াসহ অন্যান্য সরকারি জলাধারের তীরের তালিকা করা অবৈধ স্থাপনা একযোগে উচ্ছেদ শুরু হচ্ছে সোমবার থেকে।

তবে অবৈধভাবে নির্মিত কারখানার ভবন, দোকানপাটসহ বিভিন্ন স্থাপনার পাশাপাশি ‘ছিন্নমূল’ মানুষের আশ্রয়ও ভেঙে ফেলার খবর পাওয়া গেছে।  তীব্র শীতে ঘর হারানো এ মানুষগুলোর পুনরবাসনের ব্যবস্থার কথা আগে থেকেই ভাবা দরকার ছিল বলে মত দিয়েছেন কোনো কোনো স্থানীয় জনপ্রতিনিধি।

বিভিন্ন সময় ঢাকার বুড়িগঙ্গা নদীসহ বিভিন্ন নদ-নদীর পাড় উদ্ধারের অভিযান চালানো হলেও  পরে তা আবার দখল হয়ে যেতে দেখা গেছে।  এবার তাই দখল মুক্ত করার পরপরই সেসব জায়গা পানি উন্নয়ন বোর্ডের চলমান প্রকল্পের কাজে লাগানোর কথা ভাবছে কর্মকর্তারা।

জেলায় উচ্ছেদ অভিযান নিয়ে প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর:

গাজীপুর

সকাল থেকে গাজীপুর জেলা প্রশাসন ও বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড যৌথভাবে ওই উচ্ছেদ শুরু করে।

এ সময় ভ্রাম্যমাণ আদালতে নেতৃত্ব দেন টঙ্গী রাজস্ব সা‌র্কেলের সহকারী ক‌মিশনার (ভূ‌মি) গোলাম মো‌র্শেদ খান।

বাংলা‌দেশ পা‌নি উন্নয়ন বো‌র্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মো. সাজ্জাদ হো‌সেন জানান, সরকারি জলাধার তীরবর্তী  অবৈধ স্থাপনা ও দখলদার‌দের তা‌লিকা অনুযায়ী সোমবার টঙ্গী বাজার (নদী বন্দর) এলাকায় তুরাগ পা‌ড়ে অবৈধভা‌বে গ‌ড়ে ওঠা শতা‌ধিক দোকানপাট উচ্ছেদ করা হ‌য়ে‌ছে।

সহকারী ক‌মিশনার গোলাম মো‌র্শেদ খান জানান, টঙ্গীর পাগাড় এলাকায় তুরাগ ন‌দের তী‌রে অবৈধভা‌বে নির্মিত দি মা‌র্চেন্টস্ লি‌মি‌টেডের স্থাপনা গত এপ্রিলে উচ্ছেদ করা হয়। তারা তুরাগ ন‌দের সীমানায় কারখানার শেড নির্মাণ ও কাঁটাতা‌রের বেড়া ‌দি‌য়ে আবার দখল ক‌রেছে।

“সোমবার দুপু‌রে ওই শেড ও কাঁটা তা‌রের বেড়া উচ্ছেদ ক‌রে কারখানা কর্তৃপক্ষ‌কে দুই লাখ টাকা জ‌রিমানা করা হ‌য়ে‌ছে।

“এই অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ অভিযান অব্যহত থাক‌বে।”

শরীয়তপুর

পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে সকাল ১০টায় শরীয়তপুর শহরের ডাকবাংলা এলাকায় এ অভিযান শুরু হয়।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী মোহাম্মদ তারেক হাসান বলেন, মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে সারা দেশে উচ্ছেদ অভিযানের অংশ হিসেবে শরীয়তপুরে সরকারি খালের উপর অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হচ্ছে।

জেলার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মামুনুর রশিদ বলেন, শরীয়তপুর ডাকবাংলা মোড়ে ৭০টি প্রতিষ্ঠান, বটতলায় কয়েকটি আধাপাকা ও টং দোকান ভেক্যু মেশিন দিয়ে ভেঙে দেওয়া হয়েছে।

এ সময় ব্যবসায়ীরা  দোকান পাট ও দোকানের মালামাল সরিয়ে নেওয়ার জন্য সময় চাইলে ও সময় দেওয়া হয়নি বলে ব্যবসায়ীদের অভিযোগ।

এর আগে জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে ১ নম্বর খাশ খতিয়ানের জমি পরিমাপ করে ব্যবসায়ীদেরকে নোটিশ দেওয়া হয়েছিল।

বি বিষয়ে কারো কোনো আপত্তি থাকলে তা শোনার গত রোববার শুনানির দিন ঠিক করা হয়েছিল। এ শুনানির পর সোমবার সকাল থেকে প্রশাসন উচ্ছেদ অভিযান শুরু করে বলে মামুনুর রশিদ জানিয়েছেন।

উচ্ছেদকালে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ছাড়াও পুলিশ, পানি উন্নয়ন বোর্ড, ভূমি বিষয়ক কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

তবে এলাকার এক ব্যবসায়ী ইয়াকুব আলী পাহাড় বলেন, “আমরা জেলা পরিষদ থেকে বন্দোবস্ত নিয়ে ব্যবসা করে আসছি। ২০১৯ সাল পর্যন্ত লিজের টাকা পরিশোধ করা আছে।

“এরপরেও আমাদেরকে মালামাল সরিয়ে নেওয়ার সময় না দিয়ে ভাংচুর শুরু করেছে। আমরা দোকানপাট ও মালামাল সরিয়ে নেওয়ার জন্য সময় চাই।” 

জেলা পরিষেদ থেকে লিজ নিয়ে টাকা পরিশোধ করে ব্যবসা করছেন ভাষ্য অপর আরেক ব্যবসায়ী শাহজাহান হাওলাদারের।

মালামাল সরানোর সময় দেওয়ার অভিযোগ তুলে তিনি বলেন, “উচ্ছেদ করে আমাদের অনেক ক্ষতি করেছে।”

গোপালগঞ্জ

সোমবার সকালে শহরের গেটপাড়া, চরনারায়নদিয়া ও বেদগ্রামে  পানিউন্নয়ন বোর্ড উচ্ছেদ অভিযান চালায় গোপালগঞ্জে পানি উন্নয়ন বোর্ড ও সড়ক বিভাগ।

গোপালগঞ্জ পানিউন্নয়ন বোর্ডের  নির্বাহী প্রকৌশলী বিশ্বজিৎ বৈদ্য বলেন, সোমবার ৫২টি স্থাপনা উচ্ছেদ করে পানি উন্নয় বোর্ড অন্তত পাঁচ কোটি টাকার সরকারি সম্পত্তি উদ্ধার করেছে।

এ ছাড়া  গোপালগঞ্জ সড়ক বিভাগ শহরের পুলিশ লাইন্স মোড় থেকে চাপাইল ব্রিজ পর্যন্ত উচ্ছেদ অভিযান শুরু করেছে।

এদিন সকালে সড়ক বিভাগ পুলিশ লাইন থেকে উচ্ছেদ অভিযান আরম্ভ করে।

ময়মনসিংহ

ময়মনসিংহে ব্রহ্মপুত্র নদের তীরবর্তী সরকারি খাস জমির অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে অভিযান শুরু করেছে জেলা প্রশাসন, পানি উন্নয়ন বোর্ড ও পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়।

সকাল ৯টা থেকে নগরীর কালীবাড়ি গুদারাঘাট এলাকা থেকে এ উচ্ছেদ অভিযান শুরু হয়। এতে বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় নদের জায়গা দখল করে গড়ে উঠা পাকা-আধাপাকা ও টিনশেড ঘর এবং দোকানপাট।

অভিযানের নেতৃত্ব দেন জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আবুল হাশেম ও সদরের সহকারী কমিশনার (ভূমি) এম সাজ্জাদুল হাসান।

এম সাজ্জাদুল হাসান বলেন, “মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা রয়েছে আমাদের দেশের জলাশয়গুলো অর্থাৎ নদ-নদী যেগুলো আছে সেগুলো উদ্ধার  করতে হবে।”

“সেই নির্দেশনার প্রেক্ষিতেই ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসন, পানি উন্নয়ন বোর্ড ও পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের যৌথ উদ্যোগে ময়মনসিংহে উচ্ছেদ কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে।”

এ কার্যক্রম অব্যাহত থাকলে দেশের নদীগুলো নতুন করে প্রাণ ফিরে পাবে বলে আশা করছেন তিনি।

ময়মনসিংহের পাটগুদাম ব্রিজ থেকে কাচারিঘাট পর্যন্ত হাজারের বেশি অবৈধ স্থাপনা রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “সেগুলো ধারাবাহিক অভিযানের মধ্যদিয়ে দখলমুক্ত করা হবে।”

এদিকে, এ উচ্ছেদ অভিযানে বাসস্থান হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন কিছু ছিন্নমূল মানুষ। তারা বলছেন, মাথা গোজার ঠাঁইটুকু ভেঙে ফেলায় তাদের খোলা আকাশের নিচে থাকতে হবে।

“এদেশে রোহিঙ্গারা থাকার জায়গা পেলেও আমরা পাই না। আমরা থাকার মতো আশ্রয় চাই। “

সিলেট

সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলার আটগ্রামে সুরমা নদীতে অবৈধ দখলদার উচ্ছেদে অভিযান শুরু করেছে পানি উন্নয়নবোর্ড ও জেলা প্রশাসন।

সোমবার সকাল ১০টায় জকিগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বিজন কুমার সিংহের নেতৃত্বে এ অভিযান শুরু হয়।

সিলেট পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ বিভাগীয় প্রকৌশলী মো. মনির হোসেন জানান, জকিগঞ্জের আটগ্রাম বাজারে অভিযানে সুরমা নদীর তীরে গড়ে তোলা প্রায় ৫৫টি স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়।

এছাড়া সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের বেড়ি বাঁধের উপর নির্মিত ৩৫টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছে বলে জানান তিনি।

পর্যায়ক্রমে সিলেটের সব উপজেলায় অবৈধ দখলদার উচ্ছেদে অভিযান শুরু হবে বলে জানিয়েছেন পানি উন্নয়নবোর্ডের এ কর্মকর্তা।

ফরিদপুর

ফরিদপুরে কুমার নদের পাড়ে গড়ে ওঠা অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে নেমেছে প্রশাসন।  

ফরিদপুর জেলা প্রশাসন, পানি উন্নয়ন বোর্ড ও পৌরসভার তত্ত্বাবধানে সোমবার সকাল ১০টার দিকে শহরের আলিমুজ্জামান ব্রিজের নিচে কুমার নদের পাড়ে এ অভিযান শুরু হয়।

সরেজমিনে দেখা গেছে, আলিমুজ্জামান বেইলি ব্রিজের নিচে গড়ে ওঠা কাঁচা ঘর ভেঙে দেওয়া হয়। এ সময় সেখানে বসতিরা নানা অভিযোগ করতে থাকেন।

সাজেদা বেগম নিলু বলেন, “প্রায় ৩০ বছর যাবত আমরা এখানে বসবাস করছি। আমাদের কিছু না জানিয়েই সকালে ঘরবাড়ি ভেঙে ফেলা হয়। আমরা মালামাল ঠিকভাবে সরাতেও পারিনি। এ সব গরিব পরিবারগুলোকে উচ্ছেদের আগে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা উচিত ছিল।

লতা নামে আরেকজন বলেন, “আমি ফুটপাতে পরাটা ও চটপটি বিক্রি করি। বিভিন্ন সমিতিতে আমার কিস্তি রয়েছে। এখন এখান থেকে উচ্ছেদ হলে আমরা কোথায় যাব? কিস্তির টাকাই বা পরিশোধ করব কীভাবে?”

ফরিদপুর পৌর মেয়র শেখ মাহতাব আলী মেথু বলেন, “এখানে বসবাসকারীদের কিছু সময় দেওয়ার দরকার ছিল। এই শীতের সময় এরা কোথায় যাবে। তাদের পুনর্বাসনের ব্যাবস্থা নেওয়া হলে ভালো হতো।”

বাগেরহাট

জেলা শহরের দড়াটানা ব্রিজ এলাকা থেকে এ অভিযান শুরু হয়।

বাগেরহাট সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. তানজিল্লুর রহমান জানান, একই সময়ে জেলার চিতলমারী উপজেলার মধুমতি নদীর তীরে গড়ে ওঠা অবৈধ স্থাপনাও উচ্ছেদ করে প্রশাসন।

“বাগেরহাট শহরে ভৈরব নদীর তীর দখল করে গড়ে ওঠা সব অবৈধ স্থাপনা ভেঙে ফেলা হয়েছে। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয় ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে।

শহরের দড়াটানা ব্রিজ থেকে থেকে মুন্সীগঞ্জ ব্রিজ এলাকার সব স্থাপনা উচ্ছেদ করা হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “যারা নদীর তীর দখল করার চেষ্টা করবে তাদের কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।”