খুলনায় আমরণ অনশনে যোগ দেওয়া পাটকল শ্রমিকের মৃত্যু

রাষ্ট্রায়াত্ত পাটকলে মজুরি কমিশনসহ ১১ দফা বাস্তবায়নের দাবিতে আমরণ অনশনে অংশ নেওয়া এক শ্রমিক খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা গেছেন।

খুলনা প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 Dec 2019, 03:19 PM
Updated : 12 Dec 2019, 04:43 PM

বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তিনি মারা যান বলে জানিয়েছেন রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল সিবিএ-নন সিবিএ সংগ্রাম পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক খলিলুর রহমান।

খুলনা মেট্রো পলিটন পুলিশের এডিসি মনিরুজ্জামান মিঠু বলেন, একজন শ্রমিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন।

নিহত আব্দুস সাত্তার (৫৫) প্লাটিনাম জুটমিলের হেসিয়ান তাঁতের শ্রমিক ছিলেন। তার গ্রামের বাড়ি পটুয়াখালী জেলায় বলে শ্রমিক নেতারা জানিয়েছেন।

খালিশপুরে প্লাটিনাম জুটমিলের সামনে অনশনস্থলের পাশে নিহত সাত্তারের লাশ রাখা হয়েছে। তার মৃত্যুর খবরে আন্দোলনরত শ্রমিকরা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠায় সেখানে দাঙ্গা পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।

সেখানে দায়িত্বরত খালিশপুর থানা ওসি সাব্বির আহমেদ বলেন, “হাসপাতালে সাত্তারের মারা যাওয়ার খবর শ্রমিক নেতাদের মাধ্যমে জানতে পেরেছি।”

তার লাশ নিয়ে শ্রমিকরা যেন কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটাতে পারেন তা নিয়ন্ত্রণে ঘটনাস্থলে দাঙ্গা পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে বলে জানান তিনি।

গত ১০ ডিসেম্বর মজুরি কমিশন বাস্তবায়নসহ ১১ দফা দাবিতে দেশের ১২টি রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলের শ্রমিকরা আমরণ অনশন কর্মসূচি শুরু করেন। রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল সিবিএ-নন সিবিএ সংগ্রাম পরিষদের ডাকে এ আন্দোলনে অংশ নিয়েছে খুলনা অঞ্চলের রাষ্ট্রায়ত্ত আটটি পাটকলের শ্রমিকরা।

রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল সিবিএ-নন সিবিএ সংগ্রাম পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক খলিলুর রহমান বলেন, “শীতে এবং অনাহারে প্রায় শতাধিক শ্রমিক অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তাদের মধ্যে ২৫/২৬ জনকে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

“এর মধ্যে প্লাটিনাম জুট মিলের তাঁত বিভাগের শ্রমিক আব্দুস সাত্তার অনশনরত অবস্থায় সকালে অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে সন্ধ্যায় তিনি মারা যান।”

প্লাটিনাম জুট মিলের সিবিএ সাধারণ সম্পাদক মো. হুমায়ুন কবির খানও জানান, অনশনে অসুস্থ হওয়ায় আব্দুস সাত্তারকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।

বকেয়া মজুরির দাবিতে খুলনা অঞ্চলের রাষ্ট্রায়ত্ত নয়টি পাটকলের শ্রমিকেরা গত ২৩ নভেম্বর থেকে দাবি আদায়ের লক্ষ্যে সভা, বিক্ষোভ মিছিলসহ ধর্মঘটের মত কর্মসূচি পালন করে আসছে।

আন্দোলনে থাকা খুলনা অঞ্চলের পাটকলগুলো হচ্ছে- ক্রিসেন্ট জুট মিল, খালিশপুর জুট মিল, দৌলতপুর জুট মিল, প্লাটিনাম জুবিলি জুট মিল, স্টার জুট মিল, আলিম জুট মিল ও ইস্টার্ন জুট মিল, কার্পেটিং জুট মিল জেজেআই জুটমিল।

এদিকে, প্লাটিনাম জুটমিলের সিবিএ সভাপতি শাহানা শারমিন জানান, গত বুধবার রাতে শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ানের বাসায় শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে। সেখানে প্রতিমন্ত্রী ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত কর্মসূচি স্থগিত করার প্রস্তাব দেন। কিন্তু শ্রমিক নেতারা তা মানেননি।

মজুরি কমিশন বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত তারা অনশন চালিয়ে যাবে বালে জানান তিনি।

স্টার জুট মিলের সিবিএ সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মান্নান জানান, গত দুইদিনে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন শতাধিক শ্রমিক। বেশি অসুস্থ শ্রমিকদের হাসপাতালে পাঠানো হচ্ছে। এছাড়া দুর্বল হয়ে পড়া শ্রমিকদের স্যালাইন দেওয়া হচ্ছে।

এদিকে অনশন কর্মসূচির কারণে পাটকলগুলোতে উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। একই সঙ্গে বিআইডিসি সড়কের দোকানপাটও বন্ধ রয়েছে। অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে গোটা শিল্পাঞ্চলে।

বাংলাদেশ জুট মিলস কর্পোরেশনের (বিজেএমসি) খুলনা আঞ্চলিক কার্যালয়ের সমন্বয়কারী মো. বনিজ উদ্দিন মিয়া জানান, শ্রমিকদের আন্দোলনের বিষয়টি বিজেএমসির প্রধান কার্যালয়কে জানানো হয়েছে।

২০০৮ সালে নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামী লীগ পাট খাতকে লাভজনক করার অঙ্গীকার করে। তারা ক্ষমতায় আসার পর বিজেএমসিকে লাভজনক করতে কর্মপরিকল্পনা করে। ২০০৯ সালে পাটকল বেসরকারীকরণ প্রক্রিয়া থেকে সরে আসে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার।

এরপরই বেসরকারি হাতে ছেড়ে দেওয়া বিভিন্ন পাটকল সরকারের হাতে নিয়ে নতুন করে চালানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়।

পাট মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনের (বিজেএমসি) আওতাধীন ২৬টি পাটকলের মধ্যে বর্তমানে চালু আছে ২৫টি। এর মধ্যে ২২টি পাটকল ও ৩টি নন-জুট। মিলস ফার্নিশিংস লিমিটেড নামের নন-জুট কারখানা ছাড়া বাকি ২৪ প্রতিষ্ঠান লোকসানে।

২০১৬-১৭ অর্থবছরে বিজেএমসির পাটকলগুলোর (জুট ও নন-জুট) লোকসানের পরিমাণ ছিল ৪৮১ কোটি টাকা।

অপরদিকে বেসরকারি খাতের পাটকলগুলো ভালো করছে, তাদের রপ্তানি আয়ও বেড়েছে। কিন্তু সরকারের হাতে থাকা ২২টি পাটকলের সবগুলোয় লোকসান হওয়ায় প্রতিবছরই সরকারি টাকা দিয়ে টিকিয়ে রাখা হচ্ছে বিজিএমসি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে।

এরপর বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া খুলনার খালিশপুর জুট মিলস, দৌলতপুর জুট মিলস, সিরাজগঞ্জের জাতীয় জুট মিলস, চট্টগ্রামের কর্ণফুলী জুট মিলস ও ফোরাম কার্পেটস ফ্যাক্টরি ফিরিয়ে নিয়ে চালু করে সরকার। লোকসান পাল্লা বাড়ছেই তারা।

বাংলাদেশ রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল সিবিএ-নন সিবিএ পরিষদের নেতা সোহরাব হোসেন বলেন, বিজেএমসি সময়ের পাট অসময়ে কিনতে গিয়ে কোটি কোটি টাকা গচ্চা যায়। পরে দোষ দেয় সব শ্রমিকের।

অন্যদিকে বিপণন বিভাগের অদক্ষতার কারণে পাটপণ্যের দাম কম মেলে। পণ্য অবিক্রীত থাকে বলেও জানান এই শ্রমিকনেতা।