সম্প্রীতির শিক্ষা ছড়াচ্ছে যে মন্দির মসজিদ

মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের ভৈরবগঞ্জ বাজারে গেলে শুনতে পাবেন কখনো আজানের ধ্বনি আবার কখনো মন্দিরের ঘণ্টার শব্দ।

বিকুল চক্রবর্তী মৌলভীবাজার প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 Dec 2019, 07:35 AM
Updated : 9 Dec 2019, 07:35 AM

সেখানে মাত্র কয়েক গজ ব্যবধানে গড়ে উঠেছে ভৈরব মন্দিরের পাশেই মাজদিহি জামে মসজিদ।

মাজদিহি জামে মসিজিদে ১৫ বছর ধরে নামাজ পড়ান মৌলানা জাফর আহমদ।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘এ অঞ্চলের প্রায় শত বছরের ইতিহাসে দুই ধর্মের মধ্যে কোনো তিক্ততার ঘটনা নেই। ‘

মসজিদে নামাজ পড়িয়ে বের হয়ে প্রায়ই ভৈরব মন্দিরের পুরহিত জন্মজয় ভট্টাচার্য্যর সাথে দেখা হয় তার। কুশল বিনিময় করেন করেন পরস্পর সেসময়।

ভৈরব মন্দির কবে স্থাপিত হয়েছিল তার নির্দিষ্ট ইতিহাস না পাওয়া গেলেও কালাপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান মজুল বলেন, “তবে প্রায় দুইশ বছর আগে পূণ্যদত্তের পরিবার এটি স্থাপন করেছিলেন। এ ভৈরব মন্দিরের নামানুসারে ভৈরব বাজারের নামকরণ করা হয়েছে।”

তবে মিরাশদার পূণ্যদত্ত এখানে প্রায় দুইশ বছর আগে ভৈরবতলি স্থাপনের কথা বললেও তখন মন্দির ছিল না বলে দাবি করেন ভৈরব মন্দিরের পরিচালনা পরিষদের সভাপতি গৌরা দেবভ

কোনো এক সময় ছোট পরিসরে মন্দির করে মহাদেবাংশ ভৈরব দেবতার মূর্তি স্থাপন করে উল্লেখ করে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কয়েক বছর আগে এলাকার এক সমাজসেবী দিলীপ দেব এ মন্দির পুনায় নির্মাণ করেন।”

তবে ১৯৪৭ ভারতবর্ষ ব্রিটিশ শাসন মুক্ত হওয়ার পর মাজদিহি চা বাগানের কর্তৃপক্ষ ও এলাকাবাসী মসজিদটি স্থাপন করে বলে জানান তিনি। তখন থেকে পাশাপাশি অবস্থানে দুই ধর্মের মানুষ ধর্মকর্ম পালন করে যাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন তিনি।

বিংশ শতকে হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িক রাজনীতির কবলে পড়ে ব্রিটিশ ভারত বহু দাঙ্গা প্রত্যক্ষ করেছে। দেশভাগের পর পাকিস্তান আমল থেকে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর নানা নির্যাতনের ঘটনাও দেশে কম ঘটেনি।

তবে শ্রীমঙ্গল উপজেলায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পরিচয় বহন করে এমন অনেক স্থাপনা রয়েছে বলে জানান উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান রনধীর কুমার দেব।

কোনো ধর্মীয় দ্বিধাদ্বন্দ্ব নেই বলে তিনি যোগ করেন, “তবে কখনও এ রকম ঘটনার হয়ে থাকলে তা শুধুই রাজনৈতিক হীন উদ্দেশ্য বৈকি আর কিছু নয়।”

আর বাপ-দাদার আমল থেকে মসজিদের পাশেই মন্দিরে পূর্জাচনা দেখে আসা মাজদিহি জামে মসিজিদের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মতিন জানান, গত ৪০ বছর ধরে এই মসজিদে নামাজ পড়ছি।

“মন্দিরের পূজার্চনা নামাজে কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেনি বরং নামাজের সময় হিন্দুধর্মালম্বীরা বাদ্যযন্ত্র নিয়ন্ত্রণে রেখে সহায়তা করে আসছেন।”

এ মন্দিরের ২০ গজ ব্যবধানে পরে প্রতিষ্ঠিত মাজদিহি জামে মসজিদ ও ঈদগাহর মাঝে দেয়াল ও স্থাপনার দিকে দৃষ্টি টেনে মন্দিরের সভাপতি গৌরা দেব বলেন, “এ দুই ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কোনো দেয়াল ছিল না।

“দুই ধর্মের মানুষ কাছাকাছি অবস্থানে ধর্মকর্ম পালন করলেও এখানে কোনো ধরণের সাম্প্রদায়িক সম্প্রতি বিনষ্টের ঘটনা ঘটেনি।”

আর মন্দিরের পুরহিত জন্মজয় ভট্টাচার্য্য বলেন, “বাধা বিপত্তি তো দূরের কথা বরং পূর্জাচনায় মুসল্লি ভাইয়েরা সহায়তাও করেন।”

২৫/৩০ বছর ধরে এখানে পূজা পার্বন করে আসছেন জানিয়ে তিনি যোগ করেন, “এখানে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিরাজমান। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে মুসলমান ধর্মালম্বীদের নিমন্ত্রণ করলে তারাও অনুষ্ঠানে আসেন।“

পূজা পার্বন বাঙালির সংস্কৃতির অংশ উল্লেখ করে কালাপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান বলেন, “এখানে পাশাপাশি মন্দির মসজিদ থাকায় দুই ধর্মের মানুষই একে অন্যের ধর্ম সম্পর্কে অভিজ্ঞতা নিতে পারছেন। যা সমাজে বিভেদহীন চলাফেরার সহায়ক।”

সংসদ সদস্য উপাধ্যক্ষ আব্দুস শহীদ তার এ নির্বাচনী এলাকা শ্রীমঙ্গল-কমলগঞ্জের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথা বলতে গিয়ে জানান, কমলগঞ্জের পাত্রখলা চা বাগানে একই সাথে গোরস্থান, শ্মশান ও খ্রিস্টান সমাধি সম্প্রীতির আরো এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

এ মন্দির-মসিজিদের সবচেয়ে কাছে বাস করেন কবি শেখ শাহ্ জামাল আহমদ। তিনি বলেন, প্রায়ই অনেক রাত পর্যন্ত ভৈরব মন্দিরে পূর্জাচনা হয়, কীর্তন হয়।

এ মন্দির ও মসজিদটি ঢাকা মৌলভীবাজার মহাসড়কের পাশে হওয়ার দিকে দৃষ্টি টেনে স্থানীয় চাতালী চা বাগান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বিজয় নুনিয়া বলেন, “প্রতিদিন বহু যানবাহনের যাতায়াতকারী পথচারীও এর থেকে সম্প্রীতির শিক্ষা গ্রহণ করছেন।”