অগ্রহায়ণ মাসের শুরুতে হালকা শীতের আবহে জাবি ক্যাম্পাসে এসব পরিযায়ী পাখির আসা শুরু হয়। মাঘের শেষ পর্যন্ত থাকে থাকে তাদের এই পদচারণা।
ক্যাম্পাসের গাছপালায় ঢাকা সবুজ প্রকৃতি আর পাখির খাদ্য ও বসবাস উপযোগী জলাশয়গুলোও যেন বরণ করে নেয় অতিথি পাখিদের। তাই শীতকালে তারা এই জলাশয়গুলোকেই নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে বেছে নিচ্ছে।
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও পাখি বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এবছর পাখি আগমনের শুরুর সময় থেকেই বসবাস উপযোগী পরিবেশ পাওয়ায় পাখির সংখ্যা গত কয়েক বছরের তুলনায় বেড়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত নিবন্ধক রহিমা কানিজ বলেন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে কমবেশি ২২টির মতো জলাশয় আছে। এর মধ্যে এবছর পাখির আনাগোনা বেশি প্রশাসনিক ভবনের সামনে ও পরিবহন চত্বরের পেছনের দুটি জলাশয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের বোটানিক্যাল গার্ডেনের পেছনে ‘বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ কেন্দ্র’ সংলগ্ন দুটি জলাশয়ে।
পাখি বিশেষজ্ঞ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক মনোয়ার হোসেন বলেন, এই ক্যাম্পাসে গত কয়েক বছরের তুলনায় এ বছর পরিযায়ী পাখির সংখ্যা বেড়েছে। ক্যাম্পাস গত এক মাস বন্ধ থাকায় তেমন কোলাহল ছিল না, তাই পাখিরা বেশি সংখ্যায় এই পরিবেশে অবস্থান নিয়েছে।
“বর্তমানে ক্যাম্পাসের জলাশয়ে প্রায় পাঁচ হাজারের মতো পাখি অবস্থান করছে। শীত মৌসুম শেষে এই সংখ্যা দশ হাজার ছাড়াবে বলে ধারণা করছি।”
শীত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জলাশয়গুলোতে পাখির সংখ্যা ও প্রজাতি সাধারণত বেড়ে থাকে বলে জানান তিনি।
অধ্যাপক মনোয়ার আরও বলেন, আগত পাখিদের মধ্যে সরালির প্রাধান্যই বেশি। ছোট ও বড় দুই প্রজাতির সরালিই দেখা যায় এখানে। এছাড়া মাঝে মাঝে লেঞ্জা প্রজাতির পাখিরও দেখা মিলবে।
লেকগুলোতে দেশীয় পাখির মধ্যে শামুক খোল, জলপিপি, ডাহুক, জিরিয়া প্রজাতির পাখির দেখা মিলবে বলে জানান তিনি।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও এসব পাখি আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় তাদের সাময়িক আবাস খুঁজে নেয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকগুলো ছাড়া আশপাশের এলাকার মধ্যে সবচেয়ে বড় ঝাঁক দেখা যায় সাভারের বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটে (বিএলআরই)।
অনেকটা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকগুলোর মতো বিএলআরই-এর বিভিন্ন লেকের পানিতে পাখা নাচিয়ে ভেসে বেড়ায় এসব অতিথিরা।
ক্যাম্পাসে পাখি দেখার সবচেয়ে ভালো সময় সকাল এবং বিকালবেলা। তাই পাখিপ্রেমীরা খুব সকালে গিয়ে সারাদিন কাটাতে পারেন ক্যাম্পাসে।
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ক্যাম্পাস এলাকাটিকে পাখির অভয়ারণ্য হিসেবে গুরুত্ব দিয়ে আসছে। তাই সেখানকার কর্তৃপক্ষের নিয়ম কানুন মেনে চলা প্রয়োজন বলে মনে করে কর্তৃপক্ষ।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত নিবন্ধক রহিমা কানিজ বলেন, “যারা পাখি দেখতে আসবেন তারা অবশ্যই লেকের পাড়ে দেওয়া নিরাপত্তা বেষ্টনীর বাইরে থেকে পাখি দেখেবেন। লেকের মধ্যে খাদ্যদ্রব্যের প্যাকেট কিংবা কোনো ধরনের ময়লা-আবর্জনা ফেলবেন না। গাড়ির হর্ন বাজনোসহ পাখিরা বিরক্ত হয় এমন যেকোনো আচরণ থেকে বিরত থাকার অনুরোধ থাকবে সবার প্রতি।”
যারা গাড়ি নিয়ে আসেন তাদের নির্দিষ্ট স্থানে গাড়ি পার্ক করে হেঁটে কিংবা রিকশা-ভ্যানে চড়ে ক্যাম্পাসে ঘুরতে আসার অনুরোধ করেন তিনি।
কোথা থেকে আসে অতিথি পাখি?
পাখি বিশেষজ্ঞ ও জাবির প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মো. কামরুল হাসান জানালেন শীতপ্রধান দেশের এসব পাখিদের পরিযায়ী হওয়ার গল্প।
তিনি বলেন, এদেশে দেশে যখন আরামদায়ক ঠাণ্ডা, তখন শীতপ্রধান দেশগুলোতে রক্ত জমিয়ে দেওয়ার মতো ঠাণ্ডা পড়ে। তাপমাত্রা কমে যাওয়ার ফলে সেখানকার পানি ও মাটি বরফ-তুষারে ঢেকে যায়। এমন বৈরী পরিবেশে প্রচণ্ড খাদ্যাভাব ও আবাসের সংকট দেখা দেয়।
“এছাড়া অধিকাংশ পরিব্রাজক পাখি বাচ্চা দেয় শীতকালে। তাই নিজেদের ও পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বেঁচে থাকার তাগিদে পাখিগুলো নিজের দেশ ছেড়ে বাংলাদেশের মতো তুলনামূলক উষ্ণ আর আরামদায়ক কোনো দেশে পাড়ি জমায়।”
তিনি জানান, মূলত সাইবেরিয়া, চীনের জিনজিয়াং, মঙ্গোলিয়া ও নেপালে প্রচুর তুষারপাত থাকায় নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে পাখিরা কম শীতল এলাকা বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় পাড়ি জমায়।
তাদের এই দীর্ঘ ভ্রমণে আগে গরমের দেশে গিয়েছে এমন অর্থাৎ তুলনামূলক অভিজ্ঞ পাখিরা পথ দেখায় বলে জানান এই প্রাণিবিদ।
তবে পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্রের আবেশ পাখিরা তাদের মস্তিষ্ক দিয়ে অনুভব করে পথ চলে এমন ধারণাও প্রচলিত আছে বলে জানান তিনি।
পাখি মেলা
পরিব্রাজক পাখিরা প্রাণী বৈচিত্র্যের দূত। তাই এই পাখিদের বিষয়ে সবাইকে জানোতে ও সচেতন করতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগ প্রতিবছর আয়োজন করে পাখিমেলার। একই সময়ে পরিযায়ী পাখির আগমন নিয়ে জরিপ করা হয়।
প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মো. কামরুল হাসান বলেন, এ বছর ১৭ই জানুয়ারি পাখিমেলার আয়োজনের সম্ভাব্য তারিখ ঠিক করা হয়েছে। সব ঠিকঠাক থাকলে সেই সময়ে এবারের পাখি মেলার আয়োজন করা যাবে।