১৩ বছর ‘মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের অপেক্ষায়’ কক্সবাজারের শহীদ তালিকা

সব শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নাম উল্লেখ না করায় আপত্তির মুখে এক যুগের বেশি সময় ধরে আটকে আছে কক্সবাজার জেলার ‘শহীদ মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতিস্তম্ভ’র উদ্বোধন।

কক্সবাজার প্রতিনিধিশংকর বড়ুয়া রুমিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 Dec 2019, 07:14 AM
Updated : 5 Dec 2019, 07:15 AM

মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে নতুন করে পুরো নামের তালিকা কক্সবাজার জেলা প্রশাসন থেকে পাঠানো হলেও তার অনুমোদন মেলেনি বলে স্তম্ভ উদ্বোধন করতে পারেননি বলে জানিয়েছেন জেলা কর্মকর্তারা।

সব জেলায় ‘শহীদ মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতিস্তম্ভ’ নিমার্ণের উদ্যোগ নেয় মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রণালয়। সেই উদ্যোগের অংশ হিসেবে ২০০৬ সালে কক্সবাজার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পাশে ‘স্মৃতিস্তম্ভটি’ নির্মাণ করে গণপূর্ত বিভাগ।

তবে জেলা পরিষদের তত্ত্বাবধানে এ স্মৃতিস্তম্ভে ‘১০ জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার’ নাম লেখা হয়। এরা হলেন, শহীদ আব্দুল হামিদ, গোলাম কাদের, গোলাম সাত্তার, ক্যাপ্টেন মকবুল আহমদ, সিদ্দিক আহমদ, হাবিলদার আবুল কাশেম, এজাহার মিয়া, সিপাহী লাল মোহাম্মদ, শামসুল আলম ও এস এম জাহাঙ্গীর।

এতে জেলার সব শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নাম না থাকায় সে সময় আপত্তি ওঠে। আন্দোলনে নামে জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদসহ বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন।

জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ইউনিট কমান্ডের প্রতিষ্ঠাতা কমান্ডার ও সেক্টর কমান্ডারস্ ফোরাম জেলার সভাপতি মোহাম্মদ আলী বলেন, জেলা সব শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের নাম স্মৃতিস্তম্ভের ফলকে সংযোজন না হওয়ার বিষয়টি নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারাও আপত্তি জানিয়েছিল।

“মুক্তিযোদ্ধা সংসদের পক্ষ থেকে বাদপড়া শহীদদের নামের তালিকা প্রশাসনের কাছে জমা দেওয়া হয়।”

স্মৃতিস্তম্ভের নামফলকে বাদপড়া শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের নাম অন্তর্ভূক্তি আন্দোলনের সংগঠক ও জেলা ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি শহীদুল্লাহ শহীদ বলেন, ২০০৬ সালে স্মৃতিস্তম্ভটি নির্মাণের পরপরই ছাত্র ইউনিয়ন বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনকে সমন্বয় করে বাদপড়া শহীদদের নাম সংযোজনের দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলে।

সে আন্দোলনের প্রতীকী স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপন, মানববন্ধন, অবরোধ ও হরতাল কর্মসূচিতে অংশ নেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ।

সে সময় বাদপড়া শহীদদের নামের তালিকাও জেলা প্রশাসন ও জেলা পরিষদসহ সংশ্লিষ্টদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছিল বলে জানান সাবেক এ ছাত্রনেতা।

তিনি আক্ষেপ করে বলেন, “দীর্ঘ ১৩ বছরেও স্মৃতিস্তম্ভের নামফলকে বাদপড়া শহীদদের নাম সংযোজন করে উদ্বোধন করা হয়নি।

“অযত্ন-অবহেলায় পড়ে আছে স্মৃতিস্তম্ভটি।”

এ নিয়ে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারাসহ জেলার বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মীরা ক্ষুব্ধ।

স্মৃতিস্তম্ভটি বিএনপি-জামাত জোট সরকারের সময় নির্মিত হলেও এক দশকের বেশি মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেও নামফলকে বাদপড়া শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের নাম অন্তর্ভূক্ত না হওয়া দুঃখজনক ঘটনা বলে মন্তব্য করেন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট কক্সবাজারের সভাপতি সত্যপ্রিয় চৌধুরী দোলন।

দোলন বলেন, স্মৃতিস্তম্ভটির নামফলকে শুধুমাত্র ১০ জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নাম দেখে কক্সবাজারের সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক কর্মীরা ক্ষুব্ধ হন।

“বাদপড়া শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের নাম অন্তর্ভূক্তির দাবিতে বিক্ষোভও হয় কিন্তু এখনো পর্যন্ত সেটি বাস্তবায়নের আলোর মুখ দেখেনি “

স্মৃতিফলকে যাদের নাম বাদ পড়েছে বলে দাবি করা হয়েছে সেই শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন, কক্সবাজারের প্রথম শহীদ মোহাম্মদ শরীফ চেয়ারম্যান, শহীদ বুদ্ধিজীবী সাবের আহমদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ইকবাল হলের (জহুরুল হক হল) ছাত্র এটিএম জাফর আলম এবং চট্টগ্রাম বন্দরে অস্ত্র খালাসের সময় প্রতিবাদ করতে গিয়ে শহীদ হওয়া সিপাহী আকতার হোসাইন।

এছাড়াও শহীদ সুভাষ, ফরহাদ, মো. ইলিয়াছ মাস্টার, এনামুল হক, আমির হামজা, হাবিলদার রহিম বখশ, মেহের আহমদ, জোনাব আলী, ভট্ট মহাজন, সিপাহী আবুল হোসেন, মাস্টার শাহ আলম, বশির আহমদ, কবির আহমদ, অজিত পাল, নির্মল ধর, মোহাম্মদ আলী, পিয়ারী মহাজন, স্বপন মহাজন, মনিন্দ্র নাথ দে, নুরুচ্ছফা চৌধুরী, জ্ঞানেন্দ্র লাল চৌধুরী, সতীশ দে ওরফে সতীশ মহাজন, মো. শামসুল ইসলাম, আবদুস সাত্তার, অনিল কান্তি দাশ ও শশাঙ্ক বড়ুয়া প্রমুখের নাম অন্তর্ভূক্তের দাবি জানানো হয়েছে।

এ নিয়ে কক্সবাজার জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী হিল্লোল বিশ্বাস জানান, মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় বিগত ২০০৬ সালে ‘শহীদ মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতিস্তম্ভটি’ নির্মাণের জন্য জেলা পরিষদকে দায়িত্ব দেওয়া হয়।

“যেটির নির্মাণ কাজ সাড়ে ১১ লাখ টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়ন করেছিল গণপূর্ত বিভাগ।“

পরে সেটি দেখভালের দায়িত্ব জেলা প্রশাসনকে দেওয়া হয়েছিল বলে জানান জেলা পরিষদের এ প্রধান নির্বাহী।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন বলেন, “কক্সবাজারে নির্মিত শহীদ মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতিস্তম্ভের নামফলকে বেশ কয়েকজন শহীদদের নাম বাদপড়ার বিষয়টি নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা সংসদসহ বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে আপত্তি জানানো হয়েছিল।

“এ নিয়ে জেলা প্রশাসনের কাছে তারা বাদপড়া শহীদদের নামের একটি তালিকাও জমা দেয়। তালিকাটি মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।”

মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা পেলে বাদপড়া শহীদদের নাম স্মৃতিফলকে সংযোজনের ব্যাপারে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে জানান জেলা প্রশাসক।

এদিকে আগামী বিজয় দিবসের আগেই কক্সবাজারের বাদপড়া সব শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের নাম স্মৃতিফলকে অন্তর্ভূক্তির দাবি জানান মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠকরা।