টাঙ্গাইলের অজ গাঁয়ে যেভাবে আমেরিকান চিকিৎসক দম্পতি

মানবতার টানে যুক্তরাষ্ট্র থেকে চিকিৎসা সেবা দিতে টাঙ্গাইলের প্রত্যন্ত পাহাড়ি গ্রামে বসতি গড়া জেসিন-মেরিন্ডি চিকিৎসক দম্পতির প্রশংসায় ভাসছে সোশ্যাল মিডিয়া।

এম এ রাজ্জাক, টাঙ্গইল প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 Dec 2019, 03:55 PM
Updated : 1 Dec 2019, 06:53 PM

সম্প্রতি বাংলাদেশ টেলিভিশনের অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’-তে মধুপুর উপজেলা সদর থেকে ২৫ কিলোমিটার উত্তরে কালিয়াকুড়ি গ্রামে মাটির তৈরি এক স্বাস্থ্য কেন্দ্রে দরিদ্র মানুষের সেবায় নাম লেখানো এই দম্পতির কথা উঠে আসে।

সেখানে দরিদ্রদের জন্য প্রথম এই হাসপাতাল গড়ে তোলেন নিউ জিল্যান্ডের চিকিৎসক এড্রিক বেকার। তার মৃত্যুর পর হাসপাতালের দায়িত্ব নিয়েছেন এই চিকিৎসক দম্পত্তি।

ওই গ্রামীণ হাসপাতালের সেবিকা আখী রেমা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা সুযোগ পেলেই গ্রাম থেকে শহরে ছুটি। শহর থেকে বিদেশ পাড়ি দেই। শিশু জন্মের পর থেকেই চিন্তা থাকে যত দ্রুত সন্তানদের আধুনিক ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলে বাচ্চাকে পড়াব।

“আর তারা বেকারের চিকিৎসার হাল ধরলেন। ভাবতেই অবাক লাগছে!”

যার পথ ধরে জেসিন-মেরিন্ডি সন্তানদের নিয়ে এখানে এসে জীবনযাপন করছেন আর পাঁচটা সাধারণ বাঙালির মতো, সেই এড্রিক বেকার বাংলাদেশের এই গ্রামের মানুষের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন প্রায় চার দশক আগে। এলাকাবাসীর ‘ডাক্তার ভাই’ হয়ে ওঠা এই চিকিৎসক দূরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে ২০১৫ সালের পহেলা সেপ্টেম্বর মারা যান।

এড্রিক বেকার বেঁচে থাকা অবস্থায় প্রজেক্ট ম্যানেজার পিজন নংমিন এখন স্বাস্থ্য কেন্দ্রটির পরিচালক।

তিনি বলেন, এড্রিক মৃত্যুর আগে চেয়েছিলেন বাংলাদেশি কোনো ডাক্তার যেন গ্রামে এসে তার প্রতিষ্ঠিত এ হাসপাতালের হাল ধরেন। কিন্তু এ দেশের একজন ডাক্তারও তার সেই আহ্বানে সাড়া দেননি।

দেশের কেউ সাড়া না দিলেও  আগেই এড্রিক বেকারের কাজ দেখে যাওয়া ডাক্তার জেসিন চলে এসেছেন।

আমেরিকান ডাক্তার জেসিন বলেন, ডা. এড্রিক বেকার বেঁচে থাকার সময় কালিয়াকুড়ির এই হাসপাতালটি পরিদর্শনে এসেছিলেন।

“পরে ডাক্তার ভাইয়ের মৃত্যুর খবর শুনি। কিন্তু তখন নিজের প্রশিক্ষণ ও ছেলে-মেয়েরা ছোট থাকায় আসতে পারিনি। অবশেষে সব কিছু গুছিয়ে সম্পদ আর সুখের মোহ ত্যাগ করে ২০১৮ সালে পুরো পরিবার নিয়ে আমেরিকা ছেড়ে স্থায়ীভাবে চলে আসি টাঙ্গাইলের মধুপুরে। আর ‘নতুন ডাক্তার ভাই’ আর ‘মারিন্ডি দিদি’ হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠি।’

শুধু স্বামী-স্ত্রী নন তাদের সঙ্গে রয়েছে তাদের ছোট ছোট শিশু, যারা ওই গ্রামের স্কুলে পড়ছে। গ্রামের ছেলে-মেয়েরাই ওদের পড়ালেখা ও খেলাধুলার সাথী।

গ্রামে মাটির ঘরে বাস করা নতুন ‘ডাক্তার ভাই’ অবসরে লুঙ্গি পরে ঘুরে বেড়ান বলে জানালেন এই স্বাস্থ্য কেন্দ্রের পাশের বাসিন্দা মিরেন দফো।

তিনি জানান, এই আমেরিকান ডাক্তার সবার সাথেই খোলা মনে কথা বলেন। বাংলাদেশের ফল খুব পছন্দ করেন।

“আমাদের ডাক্তার ভাই ও দিদি বাংলায় কথা বলতে পারেন। তারা সন্তানদেরও বাংলা ভাষা শেখাচ্ছেন।”

প্রতিদিন সন্তানদের স্কুলে পাঠিয়ে হাসপাতালে চলে আসেন নতুন ডাক্তার ভাই।

পিজন নংমিন জানান, বেকার মারা যাওয়ার পর কোনো ডাক্তার এই স্বাস্থ্য কেন্দ্রের হাল না ধরায় নানা আইনি জটিলটায় চিকিৎসা সেবা ভেঙে পড়তে শুরু করে। তাই বাংলাদেশ এনজিও ব্যুরো এবং গত বছর সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে ডাক্তার বেকার অর্গানাইজেশন ফর ওয়েলবিং নামে রেজিস্ট্রেশন করা হয়।

তারপর থেকে মাটি ও আইপিডিএস নামের দুটি বেসরকারি সেবা সংস্থার মাধ্যমে চিকিৎসা সেবা চালানো হচ্ছে।

প্রতিষ্ঠানটি প্রথম গড়ে ৩২ বছর গ্রামের হতদরিদ্র মানুষদের চিকিৎসা দেন ১৯৪১ সালে নিউ জিল্যান্ডের এক ক্যাথলিক ধনী পরিবারে জন্মগ্রহণ করা এড্রিক। তার বাবা ছিলেন পরিসংখ্যানবিদ এবং মা বেট্রি বেকার শিক্ষক।

চার ভাই ও দুই বোনের মধ্যে দ্বিতীয় এড্রিক নিউ জিল্যান্ডের ডানেডিন শহরের ওটাগো মেডিকেল কলেজ থেকে ১৯৬৫ সালে এমবিবিএস পাশ করেন। ওয়েলিংটনে ইন্টার্ন শেষে নিউ জিল্যান্ড সরকারের সার্জিক্যাল টিমে যোগ দিয়ে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত যুদ্ধবিধ্বস্ত ভিয়েতনামে কাজ করেন।

এরপর ১৯৭৬ সালে পাপুয়া নিউগিনি ও জাম্বিয়ায় যান কিন্তু কোথাও মন টেকে না। এরই মধ্যে জন্ডিসে আক্রান্ত হয়ে চলে যান যুক্তরাজ্যে। এক বছর পর সুস্থ হয়ে ১৯৭৯ সালে তিনি বাংলাদেশে চলে আসেন বলে জানান পিজন।

তিনি বলেন, “হুট করে বেকার বাংলাদেশে চলে এসেছেন এমন নয়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় বাংলাদেশের মানুষের ওপর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বর্বরতা, ভারতগামী শরণার্থীদের ছবি নিয়মিত ছাপা হত। এসব ছবি দেখে নিউ জিল্যান্ডের তরুণ চিকিৎসক বেকারের মন কাঁদত বাংলাদেশের মানুষের জন্য। এড্রিক বেকার মনেমনে সংকল্প করেন একদিন এ দেশে আসবেন।”

১৯৭৯ সালে বাংলাদেশে এলেন আর ফেরেননি উল্লেখ করে পিজন জানান, ১৯৮৩ সালে দুই জন খণ্ডকালীন এবং তিনজন সার্বক্ষণিক কর্মী নিয়ে বেকারের যাত্রা শুরু হয়।

“দিন দিন বাড়তে থাকে রোগীর সংখ্যা। তখন থানার বাইরের পাশের গ্রাম কাইলাকুড়িতে ১৯৯৬ সালে উপকেন্দ্র খুলে চিকিৎসাসেবা দেওয়া শুরু করেন। ২০০২ সালে একটি পূর্ণাঙ্গ স্বাস্থ্যকেন্দ্র হিসেবে ৯৩ জন গ্রামীণ তরুণ-তরুণী প্রশিক্ষিত করে কাজ শুরু করেন।

“এলাকার আদিবাসী-বাঙালি প্রায় সবাই হতদরিদ্র। এ রকম একটি প্রত্যন্ত এলাকায় চার একর জমির ওপর ডা. এড্রিক বেকারের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ছোট-ছোট মাটির ২৩টি ঘরে হাসপাতালের ডায়াবেটিস বিভাগ, যক্ষা বিভাগ, মা ও শিশু বিভাগসহ আলাদা অনেক বিভাগ চালু করেন।”

ডা. এড্রিক বেকার তার দেশে নিউ জিল্যান্ড থেকে আর্থিক সাহায্য এনে এখানে কাজ করতেন জানিয়ে তিনি বলেন, এখানে ভর্তির সময় রোগীর জন্য ২০০ টাকা এবং রোগীর সঙ্গে আসা স্বজনের জন্য ১০০ টাকা নেওয়া হয়। এর মধ্যেই রোগীর থাকা-খাওয়াসহ যতদিন সময় লাগে হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হয়।