পেট্রোল পাম্প ধর্মঘটে তেল বিক্রি বন্ধ তিন বিভাগে

তেল বিক্রির কমিশন বৃদ্ধিসহ ১৫ দফা দাবিতে পেট্রোল পাম্প ও ট্যাংক লরি মালিক-শ্রমিকদের কর্মবিরতিতে রাজশাহী, রংপুর ও খুলনা বিভাগে জ্বালানি তেল বিক্রি বন্ধ রয়েছে।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 Dec 2019, 06:03 AM
Updated : 2 Dec 2019, 04:35 AM

রোববার সকাল ৬টা থেকে বাংলাদেশ পেট্রোল পাম্প ও ট্যাংক লরি মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদ ও জ্বালানি তেল পরিবেশক সমিতির ডাকে ২৬ জেলায় অনির্দিষ্টকালের এই কর্মবিরতির কারণে যানবাহন চলাচল বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে।

পেট্রোল পাম্প ও ট্যাংক লরি মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদের সিনিয়র সহ-সভাপতি এম এ মোমিন দুলাল বলেন, তাদের ১৫ দফা দাবি পূরণ করতে সরকারকে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত সময় দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু জ্বালানি মন্ত্রণালয় কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ায় তারা ধর্মঘটে যেতে ‘বাধ্য হয়েছেন’।

তাদের ১৫ দফা দাবির মধ্যে রয়েছে- জ্বালানি তেল বিক্রিতে কমপক্ষে সাড়ে ৭ শতাংশ কমিশন দেওয়া,  জ্বালানি তেল ব্যবসায়ীরা কমিশন এজেন্ট নাকি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান- বিষয়টি সুনির্দিষ্ট করা, প্রিমিয়াম পরিশোধ সাপেক্ষে ট্যাংকলরি শ্রমিকদের জন্য ৫ লাখ টাকার দুর্ঘটনা বীমা,  ট্যাংকলরির ভাড়া বৃদ্ধি, পেট্রোল পাম্পের জন্য কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান অধিদপ্তরের লাইসেন্স গ্রহণের নিয়ম বাতিল, পেট্রোল পাম্পের জন্য পরিবেশ অধিদপ্তরের লাইসেন্স নেওয়ার নিয়ম বাতিল, পেট্রোল পাম্পে অতিরিক্ত পাবলিক টয়লেট করা, জেনারেল স্টোর ও ক্লিনার নিয়োগের বিধান বাতিল করা, সড়ক ও জনপথ বিভাগ কর্তৃক পেট্রোল পাম্পের প্রবেশ দ্বারের ভূমির জন্য ইজারা নেওয়ার নিয়ম বাতিল, ট্রেড লাইসেন্স ও বিস্ফোরক লাইসেন্স ছাড়া অন্য দপ্তর বা প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স নেওয়ার নিয়ম বাতিল, আন্ডারগ্রাউন্ড ট্যাংক ৫ বছর অন্তর বাধ্যতামূলকভাবে ক্যালিব্রেশনের নিয়ম বাতিল, ট্যাংকলরি চলাচলে পুলিশি হয়রানি বন্ধ করা, সুনির্দিষ্ট দপ্তর ছাড়া ডিলার বা এজেন্টদের অযথা হয়রানি বন্ধ করা, নতুন কোনো পেট্রোল পাম্প নির্মাণের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বিভাগীয় জ্বালানী তেল মালিক সমিতির ছাড়পত্রের বিধান চালু করা, পেট্রোল পাম্পের পাশে যে কোনো স্থাপনা নির্মাণের আগে জেলা প্রশাসকের অনাপত্তিপত্র গ্রহণ বাধ্যতামূলক করা এবং বিভিন্ন জেলায় ট্যাংকলরি থেকে চাঁদা গ্রহণ বন্ধ করা।

এম এ মোমিন দুলাল বলেন, “আমাদের মূল দাবি তেলের কমিশন। আমরা তেল উত্তোলন, বিপণন এবং পরিবহন করি, কিন্তু উৎপাদন করি না। কিন্তু কল কারখানা আইনে শব্দ দূষণসহ অনেক বিষয়ই আমাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে।”

দাবি পূরণ না হলে তিন বিভাগের বাইরেও ধর্মঘট শুরু হবে বলে হুঁশিয়ার করেন দুলাল।

রংপুর

পেট্রোল পাম্প ও ট্যাংক লরি মালিক-শ্রমিকদের কর্মবিরতিতে রংপুর বিভাগের ৮ জেলায় রোবার ভোর ৬টা থেকে জ্বালানি তেল উত্তোলন, পরিবহন ও বিপণন বন্ধ রয়েছে।

কেন্দ্রীয় কমিটির সিদ্ধান্তে অনির্দিষ্টকালের এই ধর্মঘট চলছে বলে রংপুর জেলা পেট্রোল পাম্প ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা সোহরাব চৌধুরি টিটু জানিয়েছেন।

রংপুর জ্বালানি তেল সংরক্ষণাগারের আওতায় রংপুর, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম ও লালমনিরহাটে মোট ১৫২টি ফিলিং স্টেশনের রয়েছে। এর মধ্যে রংপুরে রয়েছে ৮৫টি।

এসব ফিলিং স্টেশনে ১ কোটি ২৫ লাখ লিটার ডিজেল, ২৫ লাখ ৫০ হাজার লিটার পেট্রোল ও ৪ লাখ ৪০ হাজার লিটার অকটেনের চাহিদা থাকলেও অর্ধেকেরও কম জ্বালানি তেল সরবরাহ করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে মালিকদের।

সাপরা ফিলিং স্টেশনের মালিক পিন্টু বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “চাহিদার ২৫ শতাংশ তেলও আমার পাম্পে পাই না। এতে ব্যবসায়িকভাবে আমরা ক্ষতির মুখে পড়ছি।”

পেট্রোল পাম্প মালিক ও জ্বালানি তেল ব্যবসায়ী সমিতি রংপুর বিভাগীয় কমিটির আহ্বায়ক শাহ মো. সেলিম বিডিনিউজ টোয়েন্টি ফোর ডটকমকে বলেন, “দীর্ঘদিন ধরে দাবি আদায়ে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরসহ সংশ্লিষ্টদের কাছে ধর্ণা দিয়ে কাজ হয়নি। বরং আলোচনার নামে কালক্ষেপণ করা হয়েছে। আমরা বাধ্য হয়ে অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘটের কর্মসূচি দিয়েছি।”

এদিকে সকাল থেকে রংপুর মহানগরীর পেট্রোল পাম্পগুলো বন্ধ থাকায় কোনো গাড়ি তেল নিতে পারছে না। ফলে মোটরসাইকেলসহ বিভিন্ন পরিবহনের মালিক-শ্রমিকরা ভোগান্তিতে পড়েছেন। ধর্মঘটের বিষয়টি জানা না  থাকায় অনেকে পাম্পে এসে তেল না পেয়ে ফিরে গেছেন।

লিটন নামে এক মোটরসাইকেল চালক বলেন, “ভাই আমিতো জানতাম না। আগে থেকে তেল নিই নাই। এখন গাড়ি ঠেলে আমাকে ফিরতে হবে। পাম্প মালিকরা এটা ঠিক করে নাই।

দিনাজপুর

আমাদের দিনাজপুর প্রতিনিধি জানান, অনির্দিষ্টকালের এই কর্মবিরতিতে তেল উত্তোলন, বিপণন ও পরিবহন বন্ধ থাকায় পার্বতীপুর রেলওয়ের তেল হেড ডিপো থেকে তেল নিচ্ছে না কোনো ট্যাংক লরি। এই ডিপো থেকে উত্তরাঞ্চলের আট জেলার তেল সরবরাহ করা হয়।

এছাড়া জেলার কোনো পেট্রোল পাম্পেও জ্বালানি তেল বিক্রি করা হচ্ছে না বলে দিনাজপুর পেট্রোল পাম্প মালিক গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক রওশন কবীর জানান।

রাজশাহী

জ্বালানি তেলের পাম্পে ধর্মঘটের প্রথম দিনেই রাজশাহীতে দুর্ভোগে পড়েছে মানুষ। নগরীর কোনো পেট্রোল পাম্প তেল বিক্রি না করায় সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছেন মোটরসাইকেল চালকরা।

যারা ধর্মঘটের খবরে আগাম জ্বালানি তেল সংগ্রহ করে রেখেছিলেন তারাই কেবল মোটরসাইকেল চালাতে পারছেন।

নগরীর শালবাগান এলাকার আলম ফিলিং স্টেশনের সেলসম্যান মুরাদ হোসেন বলেন, কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তে ভোর ৬টা থেকে তাদের ধর্মঘট শুরু হয়েছে। সকাল থেকে কাউকে তেল বিক্রি করা হয়নি।

নগরীর কুমারপাড়ার গুল গফুর পেট্রোল পাম্পে মোটর সাইকেলে তেল নিতে আসা জাহিদুল ইসলাম বলেন, “ধর্মঘটের খবর আগে সেভাবে প্রচার হয়নি। তাই আগে জানতে পারিনি। সকালে এসে দেখি দড়ি দিয়ে ঘিরে রেখেছে, তেল বিক্রি বন্ধ। খোলা বাজারেও তেল মিলছে না।”

জাহিদুল ইসলামের মত অনেকেই পাম্পে গিয়ে তেল না পেয়ে ফিরে গেছেন। বিভিন্ন পরিবহনের মালিকরাও পড়েছেন দুর্ভোগে। সকাল থেকেই মহানগরীর বিভিন্ন সড়কে যাত্রীবাহী বাসের সংখ্যা কমে এসেছে।

বগুড়া

গত ২৬ নভেম্বর বগুড়া প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করেই ১ ডিসেম্বর থেকে অনির্দিষ্টকালের এই ধর্মঘটের ঘোষণা দিয়েছিলেন পেট্রোল পাম্প ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন ও ট্যাংক লরি মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদের কেন্দ্রীয় মহাসচিব ও রাজশাহী বিভাগীয় সভাপতি মিজানুর রহমান রতন।

সে অনুযায়ী তিন বিভাগের অন্যান্য জেলার মত বগুড়াতেও রোববার সকাল থেকে সব পেট্রোল পাম্পে তেল বিক্রি বন্ধ রয়েছে। যানবাহনের চালকরা তেল নিতে পাম্পে এসে ফিরে যাচ্ছেন।

সকালে কয়েকটি ফিলিং স্টেশনে ঘুরে দেখা যায় পাম্পগুলো কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে। টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছে ১৫ দফা দাবি সম্বলিত পোস্টার। 

মিজানুর রহমান রতন বলেন, “দাবির বিষয়ে সরকারের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও শুধু মৌখিক আশ্বাস ছাড়া আর কিছু পাওয়া যায়নি। এ অবস্থায় পেট্রোল পাম্প পরিচালনা করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। কারণ এ খাতটি এরই মধ্যে অলাভজনক হয়ে পড়েছে। তাই বাধ্য হয়ে চূড়ান্ত কর্মসূচি পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমরা।”

খুলনা

অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতিতে রোববার ভোর থেকে খুলনায় সব ফিলিং স্টেশনে সব ধরনের জ্বালানি তেল বিক্রি বন্ধ রেখেছে মালিকপক্ষ।

পাশাপাশি পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা তেল ডিপোর শ্রমিকরা তেল উত্তোলন, বিপণন ও সরবরাহ বন্ধ রাখায় খুলনা বিভাগের ১৫ জেলায় তেল সরবরাহ বন্ধ রয়েছে।

জ্বালানি তেল পরিবেশক সমিতির সাধারণ সম্পাদক শেখ মুরাদ হোসেন বলেন, “কর্মবিরতির কারণে খুলনার পদ্মা, মেঘনা, যমুনা তেল ডিপো থেকে তেল উত্তোলন ও বিপণন বন্ধ রয়েছে। খুলনা বিভাগের ১০ জেলাসহ বৃহত্তর ফরিদপুরের পাঁচ জেলায় ট্যাংক লরি যাচ্ছে না । পাম্পে তেল বিক্রিও বন্ধ রয়েছে।”

এদিকে ধর্মঘটের ফলে অতিরিক্ত ট্রাক-লরির চাপে ফিলিং স্টেশন, ট্রাক-লরি স্ট্যান্ডে জায়গা হচ্ছে না। বহু ট্রাক ও লরিকে সড়কের দুই পাশে বিভিন্ন জায়গায় দাঁড় করিয়ে রাখতে দেখা গেছে।

বাংলাদেশ পেট্রোল পাম্প ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের খুলনা বিভাগীয় কমিটির সভাপতি সাজ্জাদুল করিম কাবুল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের বেনাপোল প্রতিনিধিকে বলেন, “যানবাহন চলাচল একেবারে যাতে বন্ধ না হয় সে কারণে দেশব্যাপী ধর্মঘটের ঘোষণা দেয়া হয়নি। তবে সরকারের পক্ষ থেকে সাড়া না পেলে দেশব্যাপী ধর্মঘট পালনের বিষয়টি চিন্তা ভাবনায় আছে।”